জুম্‌’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২২ জানুয়ারি, ২০২১ at ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ

ঈমানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
ঈমানের সংজ্ঞা: ঈমান শব্দটি আরবি, এটি মাসদার তথা ক্রিয়ামূল এর আভিধানিক অর্থ বিশ্বাস করা, আনুগত্য করা, বশ্যতা স্বীকার করা, নির্ভর করা, অবনত হওয়া, তথা প্রশান্তি। শরীয়তের দৃষ্টিতে জমহুর আলেমদের মতে-মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন সেসব বিষয়ের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা ও মৌখিক স্বীকৃতিকে ঈমান বলা হয়।
ঈমানের তিনটি মাধ্যম: ১. মৌখিক স্বীকারোক্তি, ২.অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস, ৩. ইসলামের বিধান কাজে বাস্তবায়ন করা।
ঈমান ও ইসলামের সম্পর্ক: ঈমান অর্থ বিশ্বাস স্থাপন করা, ইসলাম অর্থ বিনয়াবনত হওয়া, আত্মসমর্পণ করা ইত্যাদি। ঈমান ও ইসলাম এক ও অভিন্ন। অন্তরের বিশ্বাসকে ঈমান, ঈমানের দাবি অনুসারে জীবন গঠন ও আমল করাকে ইসলাম বলা হয়। একটি অপরটির পরিপূরক। অন্তরের গোপন বিশ্বাসের নাম ঈমান, আর অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বাহ্যিক আনুগত্য হলো ইসলাম। (‘আল ঈমান’ কৃত: ড. মুহাম্মদ নাঈম ইয়াসিন, পৃ: ১৩৬ কায়রো)
ঈমান প্রসঙ্গে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অভিমত হচ্ছে-
ঈমান ও ঈসলাম এ দুটি, পেটের সাথে পিটের সম্পর্কের ন্যায়, যার একটি অপরটি থেকে পৃথক হতে পারেনা। প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ আল্লামা মোল্লা আলী কারী (র.)’র মতে ঈমান ও ইসলামের সম্পর্ক দেহ ও আত্মার সম্পর্ক।
মৌলিক বিষয়ে ঈমান আনা ফরজ : মহাগ্রন্থ আল কুরআন ইসলামী জীবন বিধানের প্রধান উৎস। যে সব মৌলিক বিষয়ে ঈমান আনা একজন বান্দার উপর ফরজ বা অপরিহার্য করা হয়েছে তা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে সুস্পষ্টরূপে উপস্থাপিত হয়েছে। ১. আল্লাহর প্রতি ঈমান, ২. ফিরিস্তাগণের প্রতি ঈমান, ৩.নবী রাসূল আলাইহিমুস সালাম’র প্রতি ঈমান, ৪. আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান, ৫. তাকদীরের উপর ঈমান, ৬. আখিরাত তথা কিয়ামত পরকালের প্রতি ঈমান, ৭. পুনরুত্থান দিবসের প্রতি ঈমান. (ফতহুলবারী ১ম খন্ড, পৃ. ৯৬,৯৭)
কলেমার মাধ্যমে ঈমানের ঘোষণা:একজন বান্দা আল্লাহর তাওহীদ ও নবীজির রিসালতের প্রতি পূর্ণ স্থাপন করত: বলবে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও প্রিয় রাসূল। কলেমার প্রথম অংশ তাওহীদ সম্পর্কিত, দ্বিতীয় অংশ নবূওয়াত ও রিসালত সম্পর্কিত। তাওহীদ ও রিসালতের ঘোষণার মাধ্যমে ঈমানের পূর্ণতা। হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন আমি মিরাজে গমন করলাম আরশে আজীমে লিপিবদ্ধ দেখতে পেলাম “লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ” (ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ুতি, আদ্‌দূররুল মনছুর/৫ খন্ড, পৃ: ২১৯, খতিবে বাগদাদী, তারিখে বাগদাদ ১২/পৃ: ৫০৩)
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম বলেন-ইসলামী মনীষীগণ এ বিষয়ে একমত যে, কোন কাফির যখন “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” বলবে সে ইসলামে প্রবেশ করল। তাফসীরে কাইয়্যুম ১/পৃ: ১৭৯
আল কুরআনে আল্লাহর প্রতি ঈমান: আল্লাহর প্রতি ঈমানের সারকথা হলো, আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি ঈমান আনা। তিনি এক অদ্বিতীয় শাশ্বত চিরন্তন। তিনিই একমাত্র অনাদি অনন্ত, তিনি সর্বজ্ঞ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্ঠা, তিনিই মহা বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা পালনকর্তা রিযকদাতা, তিনি সকল পরিপূর্ণ গুনাবলীর আঁধার। তিনি স্ব-অস্তিত্বে সর্বদা সর্বত্র বিরাজমান। আসমান জমীন, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, তৃণলতা, গাছ-পালা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, জ্বীন ইনসান, আরশ-কুরসী, লওহ-কলম, নভোমন্ডল-ভূমন্ডলের দৃশ্য অদৃশ্য সমগ্র সৃষ্টিরাজির, তিনিই একমাত্র স্রষ্টা। পৃথিবীর কোন ভাষায় “আল্লাহ” শব্দের বিকল্প নেই। পবিত্র কুরআনসহ পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব সমূহে আল্লাহ শব্দটি পাওয়া যায়। আল্লাহ শব্দের কোন দ্বিবচন বা বহুবচন হয় না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ শব্দটি ২৭৫১ বার বিভিন্ন আয়াতে উল্লেখ হয়েছে। অন্য কোন শব্দ এতবেশী উল্লেখ করা হয়নি। পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলার প্রতি ঈমান আনার নির্দেশনা এসেছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের উপর ঈমান আন। তোমরা ঈমান আনলে ও তাকওয়া অবলম্বন করলে তোমাদের জন্য মহা পুরস্কার রয়েছে। (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ১৭৯)
মু’মিনদের প্রতি সুসংবাদ: আল্লাহর প্রতি ঈমান, পরকালে বিশ্বাসসহ নেক আমল সম্পাদনকারী বান্দাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ রয়েছে এরশাদ হয়েছে, “যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং সৎ কাজ করেছে তাদের প্রভূর নিকট তাদের জন্য রয়েছে পুরস্কার। (সূরা: বাকারা: আয়াত: ৬২)
হায়াত ও মওতের মালিক আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখা: সুস্থতা অসুস্থতা জীবন ও মৃত্যু তিনিই দান করেন। সকল প্রকার কল্যাণ, অকল্যাণ, সম্মান অসম্মান, তাঁরই কুদরতী হস্তে ন্যস্ত। তিনি এরশাদ করেন, “তিনিই (আল্লাহই) জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান এবং তাঁরই নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।” (সূরা: ইউনুস, আয়াত: ৫৬)
তিনি আরো এরশাদ করেন, (হে প্রিয় হাবীব) বলুন! দয়া অনুগ্রহ আল্লাহরই হাতে তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ৭৩)
আল্লাহর অবিনশ্বর সত্তায় ঈমান আনা: সৃষ্টির প্রতিটি বস্তু পরিবর্তনশীল, প্রত্যেক পরিবর্তনশীল বস্তু ধ্বংশশীল সুতরাং পৃথিবীও ধ্বংশশীল, একমাত্র তিনিই চিরঞ্জীব চিরস্থায়ী। তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ মাবুদ নেই। তন্দ্রা ও নিদ্রা তাঁকে স্পর্শ করেনা। তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। কোন কিছুই তাঁর (আল্লাহর) সদৃশ্য নয় (সূরা: শূরা: ১১)
মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছন, “ভূপৃষ্ঠে যা কিছু আছে সবই নশ্বর, অবিনশ্বর কেবল তোমার প্রতিপালকের সত্তা যিনি মহিমাময়, মহানুভব।” (সূরা: আর রাহমান, আয়াত: ২৬-২৭)
হাদীস শরীফের আলোকে ঈমানের শাখা প্রশাখা: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ঈমানের সত্তরটির অধিক শাখা-প্রশাখা রয়েছে, তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম শাখা হচ্ছে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” আর সর্বনিম্ন শাখা হচ্ছে রাস্তার মধ্যে থেকে কষ্ট দায়ক বস্তু দূর করে দেয়া এবং লজ্জা হলো ঈমানের একটি শাখা। বর্ণিত হাদীসের ব্যাখ্যায় হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (র.) বলেন, মানুষের যাতায়াত ও চলার পথ থেকে পাথর, ইট-কঙ্কর, কাটা ইত্যাদি বস্তু যা দ্বারা মানুষ হোঁচট খায় কষ্ট পায় তা সরিয়ে ফেলা সওয়াবের কাজ। লজ্জা দ্বারা “ঈমানী লজ্জা” বুঝানো হয়েছে, যা যাবতীয় গুনাহ থেকে বিরত রাখে। বান্দা মাখলুক কে আল্লাহ ও তদীয় রাসূল ও ফিরিস্তাদেরকে লজ্জা করবে যেমনি প্রকাশ্যে কোন প্রকার গুনাহ করবেনা তেমনি ভাবে গোপনেও কোন গুনাহ করবেনা। কারণ আল্লাহ রাসূল ও ফিরিশতাগন তা দেখতে পাচ্ছেন। (মিরআতুল মানাজীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, ১ম খন্ড, পৃ: ২৫)
হযরত ওবাদাহ ইবনে সামিত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এরশাদ করতে শুনেছি, যে ব্যক্তি এ মর্মে সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ব্যাতীত কোন মাবুদ নেই এবং নিশ্চয়ই মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। আল্লাহ তা’আলা তার উপর দোজখ হারাম করে দেবেন। (মুসলিম শরীফ, ১ম খন্ড, পৃ: ২২৯)
বর্ণিত হাদীসের আলোকে শুধু কলেমা পাঠই যথেষ্ট আমলের কোন প্রয়োজন নেই এ ব্যাখ্যা করা যাবে না। বরং হাদীসের ব্যাখ্যা হচ্ছে কলেমার দাবী অনুসারে সকল ইসলামী আক্বিদা কবুল করে নেওয়া। আরো কয়েকটি ব্যাখ্যা রয়েছে যথা: ১. যার আক্বিদা বিশুদ্ধ হবে সে দোজখে স্থায়ী হবেনা। ২. হাদীসের বর্ণনায় ঐ ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যে ঈমান গ্রহণ মাত্রই মৃত্যু বরণ করেছে। ৩.অথবা নবীজির এ হাদীস ওই সময়ের যখন শরীয়তের বিধি-বিধান মোটেই অবতীর্ণ হয়নি। (মিরাআতুল মানাজীহ, ১ম খন্ড, পৃ: ৫২)
নবীজির ভালবাসায় ঈমানের পূর্ণতা: নবীপ্রেম খোদা প্রাপ্তির পূর্বশর্ত। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, (হে হাবীব) আপনি বলুন! যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসতে চাও, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো। তাহলে আল্লাহ পাকও তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ সমূহ মার্জনা করবেন, আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ৩১)
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার মাতা-পিতা সন্তান-সন্তুতি এবং সকল লোকের চেয়েও অধিক প্রিয় হব। বোখারী শরীফ, ঈমান অধ্যায়, হাদীস: ১৫, সহীহ মুসলিম, ঈমান অধ্যায়, হাদীস:-৪৪)
ঈমানের আলামত:আলামত অর্থ চিহ্ন নিদর্শন, একজন মু’মিনের পরিচয়ের অসংখ্য নিদর্শন ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, বর্ণিত আছে একদিন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের সম্মুখে বের হয়ে আসেন এবং এরশাদ করেন আজ তোমরা কোন অবস্থায় সকাল করেছ? তদুত্তরে সাহাবাগণ বললেন, আল্লাহর উপর ঈমান অবস্থায় আমরা সকাল করেছি। নবীজি এরশাদ করেন তোমাদের ঈমানের আলামত কী? সাহাবাগণ বললেন- ১. আমরা বিপদে ধৈর্য অবলম্বন করি। ২. সচ্ছলতা ও সুখ-শান্তি অবস্থায় আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। ৩. তাকদীরের উপর আমরা সন্তুষ্ট থাকি। নবীজি এরশাদ করেন, পবিত্র কা’বা ঘরের কসম নি:সন্দেহে তোমরা সত্যিকার মু’মিন। (ইমাম ইবন হাজর আসকালানী (র.) কৃত. আল-মুনাব্বিহাত) হে আল্লাহ আমাদেরকে মু’মিন হিসেবে কবুল করুন, আমাদের ঈমানে পূর্ণতা দান করুন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী),
বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মৃতিতে সমুজ্জ্বল আমার বাবা বিমলেন্দু বড়ুয়া
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে