বিশ্ব মানবতার মুক্তি দূত, বিশ্ব শান্তির অগ্রসেনানী, বিশ্ব মুসলিমদের প্রাণস্পন্দন প্রাণপ্রিয় বিশ্বনবী যেখানে শুয়ে আছেন, সেই পবিত্র ভূমিতে পা ফেলার সাথে সাথে যেন সারা শরীরময় শির শির করে উঠে– হৃদয়ের সমস্ত উজাড় করা ভালোবাসা ঢেলে দেই এই আঙ্গিনায়।
সপরিবারে আমাদের যাত্রা শুরু হল ১২ জানুয়ারি বাদ মাগরিব। পরিবারের সব সদস্যদের নিয়ে আল্লাহর পবিত্র ঘর তাওয়াফ করতে যাওয়াটা কি যে সাবলীল আনন্দের, সেটা বুঝা যেন খুবই দূরূহ ব্যাপার। আরও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়–স্বজনসহ এবারের যাত্রা।
বাংলাদেশ বিমানের বিশাল বোয়িং উড়াল দিলো পবিত্র মদিনা শরীফের উদ্দেশ্যে বন্দরনগরী ছেড়ে। বুকে দুরু দুরু ভাব–অজানা এক সংশয় আছড়ে পড়ে হৃদয়ের অতলান্ত গভীরে। স্বপ্নীল আকাশে আমরা স্বপ্ন বুনি–হৃদয়ের মদিনায় যেন শেষ যাত্রা হয়।
এই প্রত্যাশাটুকু সবার মাঝে বিচারণ করে বেড়ায়। দুর্লভ অনুভূতি আকাশে এক গুচ্ছ কালো মেঘ ভেসে বেড়ায়, আমার প্রাণস্পন্দন উবে উবে যায় তবুও স্বপ্ন দেখার প্রাণ সঞ্চার যেন শেষ হয় না। মদিনা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাটাতনে পা রাখলো বোয়িংটা। নতুনদের চোখে যেন শতবর্ষী শর্ষেফুল–মেডিকেল পড়ুয়া বড় মেয়ে মালিহার স্বপ্ন যেন সত্যি হতে চললো। এই অগ্রযাত্রায় নতুন মুখ রয়েছে আরো দু’জন।
ওদিকে বড় মেয়ের ইমিগ্রেশনটা একটু কঠিন হয়ে গেল। ফিংগার প্রিন্ট না মেলায় সবাই অস্বস্তিতে ছিলাম, পড়ে অবশ্যই সব ঠিকঠাক। অপেক্ষমাণ গাড়িতে উঠে পড়লাম চটপট সবাই। পরদিন ছিল জুমাবার–সবাই ছুটে চললাম প্রাণের মদিনার দিকে হৃদয়ের সমস্ত আবেগ দিয়ে। প্রথমেই আমার রাসূল (সাঃ) এর রওজা মোবারক জিয়ারত করার অদম্য সাহস নিয়ে চললাম দৃঢ়লয়ে–সাথে গালিব ভাই ও মাশরুর।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ আমার প্রাণপ্রিয় নবীজির খুব কাছাকাছি চলে আসলাম–অঝোর ধারায় ঝরছে হৃদয়ের আটলান্টিক–নিজেকে সামাল দিতে পারছি না কেবলই। ভিনদেশি মানুষের কোলাহলে এই যেন নীরব পদযাত্রা। ধীরে ধীরে রাসূল (সাঃ) এর কাছাকাছি, হঠাৎ চোখে পড়ল সেই ঐতিহাসিক আল কোরআনের আয়াতটি, ‘হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, কখনো নিজেদের আওয়াজকে নবীর আওয়াজের উপর উঁচু কর না এবং নিজেরা যেভাবে একে অপরের সাথে উঁচু আওয়াজ ব্যবহার কর–নবীর সামনে কখনো সে ধরনের উঁচু আওয়াজে কথা বল না, এমন যেন কখনো না হয় যে, তোমাদের সব কাজকর্ম বরবাদ হয়ে যাবে এবং তোমরা তা জানতেও পারবে না’– সূরা হুজরাত–২। আমার রাসূল (সাঃ) এর পাশেই শুয়ে আছেন ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বক্কর সিদ্দিক (রাঃ)। পাশেই শুয়ে আছেন অর্ধ পৃথিবীর শাসক ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ইবন্খাত্তাব (রাঃ)।
পিনপতন নীরবতা সমস্ত উমরাহ হাজীরা আল্লাহ রাসূল (সাঃ) এর স্মরণে দরুদ পড়ছেন। রওজা শরীফ ছুঁয়ে দেখার কোনো অবকাশ নেই যেহেতু এখানে আমাদের দেশের মতন বেদআত এর লেশমাত্র নেই। সৌদি নিরাপত্তারক্ষী ও মতোয়া সার্বক্ষণিক দায়িত্বে নিয়োজিত।
যেন বেদআত না হয় আল্লাহ রাসূল (সাঃ) এর সামনে। চিৎকার করে কাঁদা যায় না এমনকি মুনাজাত ও করা যায় না। আর এটাই আমার প্রাণপ্রিয় রাসূল (সাঃ) এর শিক্ষা। নীরবে চলে আসলাম আমরা ৩ জন। হারাম শরীফের একটি জায়গায় বসে পড়লাম। জুমার নামাজের আগেই সালাত ও কোরআন তেলওয়াত–এ মনোনিবেশ, এর পরেই মদিনা শরীফের সম্মানিত খতিব সম্মানিত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে সালাম প্রদানপূর্বক খুতবা শুরু করলেন।
খুতবার মমার্থ হলো: আমাদেরকে এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। শত বাধার প্রাচীর সামনে এলেও এই সত্য উপেক্ষা করার কোন উপায় নেই। তিনি আল্লাহর কোরআনের আয়াতের রেফারেন্স দিয়ে বলেছেন, ‘প্রত্যেক প্রাণীই মরণের স্বাদ ভোগ করবে; তোমাদের পাওনা কেয়ামতের দিন পুরোপুরি আদায় করে দেওয়া হবে, যাকে আগুন থেকে বাঁচিয়ে দেওয়া হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করা হবে; সেই সফলতা পাবে।
এই পার্থিব জীবন ছলনার মাল সামানা ছাড়া আর কিছুই না’– সূরা ইমরান– ১৮৫। মৃত্যুর প্রস্তুতি হিসাবে তিনি বেশ কিছু দিক নির্দেশনা দিলেন। নামাজের প্রথম রাকাতে সূরা জুময়াহ দিয়ে শুরু করলেন এবং ২য় রাকাতে সূরা মোনাফেকুন দিয়ে শেষ করলেন। এই যেন এক কাকতালীয় আমার মনে হয়েছে।
কখন যে তিন রাত অতিবাহিত হয়ে গেল তা টেরই পাইনি। কোনো একদিন মদিনার প্রথম মসজিদে কু’বা, রক্তাক্ত উহুদপ্রান্তর ঘুরে এলাম–হৃদয়টা ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায় যখন উহুদের প্রান্তরে আমরা পৌঁছি। ৭০ জন সাহাবীর রক্তে রঞ্জিত এই প্রান্তর।
উহুদ পাহাড় যেন সাহাবীগণের পবিত্র রক্তে এখনো আচ্ছাদন করে আছে। আমার রাসূল (সাঃ) এর দন্ত মোবারক এখানেই তো শহীদ হয়েছিল। এখানেই তো সায়্যিদুশ শুহাদা হযরত আমির হামজা (রাঃ) এর বক্ষ বিদীর্ণ করে কাফের মহিলা হানজালার উদরপূর্তি হয়েছে।
এখানেই তো স্বামী সন্তানহারা মহিলার কোন আক্ষেপ ছিল না শুধুমাত্র আমার রাসূল (সাঃ) কে জীবিত পেয়ে। এটি ইসলামের ইতিহাসের এক মহান রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ–যেখানে ইক্বামতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য হাসিমুখে নিজের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন ৭০ সাহাবী। বিদায়ের ঘনঘটা–পবিত্র ওমরার উদ্দেশ্যে আমরা রওনা দিব আগামীকাল। প্রাণের মদিনাকে বিদায় দিতে খুবই কষ্ট হচ্ছে দারুণ। তবুও যেত হয় বহুদূর–হয়তো আবারও আসবো এই আঙ্গিনায়, এই প্রান্তরে আমার রাসূল (সাঃ) এর মদিনা সনদ আচ্ছাদিত এই শহরে।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল