স্মরণ : ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির প্রবক্তা মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক

শহীদুল ইসলাম শহীদ | শনিবার , ১৬ জুলাই, ২০২২ at ৬:৪৯ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধু উপাধির প্রণেতা, সাবেক ছাত্রনেতা,সমাজসেবী ও সংগঠক মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক এর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী ১৫ জুলাই৤ তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ এক ব্যক্তিত্ব। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়ে তিনি শুধু ইতিহাসের অংশ হননি, নিজেই পরিণত হয়েছেন ইতিহাসের স্রষ্টায়। বঙ্গবন্ধু- এই শব্দটি কত সহজ, অথচ কত গভীর, গম্ভীর এবং দিগন্তবিস্তারী, তা তাঁর আগে কেউ ভাবে নি। তাঁর দেয়া বঙ্গবন্ধু হয়ে গেলো এক শাশ্বত, চিরকালীন ও জনপ্রিয় খেতাব। বঙ্গবন্ধু শব্দের মধ্যে যে দ্যোতনা আছে, ব্যঞ্জনা আছে, তার কোনো বিকল্প শব্দ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আজ শেখ মুজিবুর রহমান নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যে শব্দটি উচ্চারিত হয়, সেটি বঙ্গবন্ধু। আর এই গৌরবের কৃতিত্ব চট্টগ্রামের গর্বিত সন্তান রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক-এর৤
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাকের জন্ম ১১ আগস্ট, ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ভিংরোল গ্রামের মিয়া বাড়িতে। তাঁর পিতা মরহুম নূরুল হক চৌধুরী এবং মাতা মরহুমা মুসলিম আরা৤ জন্ম গ্রামে হলেও তাঁর শৈশব কেটেছে চট্টগ্রাম শহরে পাথরঘাটায়। পারিবারিক সুত্রে তাঁর পূর্বপুরুষরা জমিদার ছিলেন। দাদা মরহুম দানুমিয়া চৌধুরী ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক৤ বাবা মরহুম নূরুল হক চৌধুরী একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন৤
ঐতিহ্যবাহী জেএমসেন স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষায় তাঁর হাতেখড়ি। পরবর্তীকালে মুসলিম হাই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং এখান থেকেই ১৯৬৭ সালে এসএসসি পাস করেন। এসএসসি পাস করার পর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে এইচএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স এবং ১৯৭৫ সালে এম এ পাস করেন।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার চলছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বিশেষ সামরিক আদালতে এসময় শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখতে যান রেজাউল হক চৌধুরী৤ এই প্রসঙ্গে এক লেখায় তিনি বলেন, ‘আমি তখন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। একদিন ইচ্ছা হলো নেতাকে দেখতে যাব। কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব? অনেক ভেবে চেন্তে মাথায় আসল আমার বন্ধুর বাবা এডভোকেট মশিউর চাচা এই মামলার কৌসুলি। চাচাকে আমার ইচ্ছার কথা বলতেই তিনি অপরাগতা প্রকাশ করলেন। কিন্তু আমার অনমনীয়তায় তিনি শেষ পর্যন্ত রাজী হলেন তাঁর সাথে আমাকে নিতে। ৮/৮/১৯৬৮ সালে ক্যান্টনমেন্টের সামরিক আদালতের একটি বিশেষ পাস নিয়ে আমি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করি। সমপ্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেমোরিয়াল ট্রাস্ট কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পাদিত INTELLIGENCE BRANCH (IB) DOCUMENTS OF THE AGARTALA CONSPIRACY CASE Vol-4এ প্রকাশিত গ্রন্থে আমার ঐতিহাসিক এই পাসটি স্থান পেয়েছে। ৮/৮/১৯৬৮ সালে ক্যান্টনমেন্টের সামরিক আদালতে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখতে যাওয়ার মহামূল্যবান এই পাসটি আমি গভীর যতনে এতদিন আগলিয়ে রেখেছিলাম। কিছুদিন পূর্বে এই পাসটি আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টকে হস্তান্তর করি।’ উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও এইরকম একটি পাস আছে। বইটিতে সেটিও স্থান পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি কী রকম দরদ থাকলে জীবনের ঝুঁকি নিতে পারে- রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক তা প্রমাণ করেছিলেন৤
‘প্রতিধ্বনি’-তে প্রকাশিত রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক এর প্রবন্ধের ’বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের বিভিন্ন লিফলেট প্রচারপত্র ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হতে থাকে। রাজনৈতিক মঞ্চে বক্তাগণ তাঁদের বক্তৃতায় ’বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি উচ্চারণ করতে থাকেন। তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক ১৯৬৮ সালে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধু নামকরণ করার পাশাপাশি ১৯৭০ সালের সর্বপ্রথম ’বঙ্গবন্ধু’র জীবনী বিষয়ে একটি পুস্তিকাও প্রণয়ন করেন। ২৪ পৃষ্ঠার পুস্তিকাটির নাম ছিল ‘এই দেশেতে জন্ম আমার’। প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন কালাম মাহমুদ। এই পুস্তিকাটি ’বঙ্গবন্ধু’ জীবনী বিষয়ক প্রথম রচনা। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিব বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৬৯ এর ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে গণসংবর্ধনায় ছাত্র জনতার পক্ষ থেকে ডাকসুর তৎকালীন ভিপি তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক কর্তৃক লিখিত ’বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এই সময় থেকেই শেখ মুজিবের নামের সাথে এতদিনের প্রচলিত মুজিব ভাই, বঙ্গ শার্দুল, সিংহর্শাদুল ইত্যাদি বিশেষণকে রীতিমত প্লাবিত করে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটি সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ৬৯ এর মার্চ/এপ্রিল মাসে ফজলুল হক হলের ক্যান্টিনে নগর ছাত্রলীগের সম্মেলনে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র এবং কালিগঞ্জের মফিজুর রহমান খানকে সভাপতি এবং ঢাকা কলেজের ছাত্র হিসেবে এই প্রথম রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাককে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়৤ ইতিপূর্বে নগর কমিটিতে সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হত পুরান ঢাকার কলেজ থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা৤রেজাউল হক চৌধুরী গণ আন্দোলন সংগঠনের পাশাপাশি ঢাকা নগরে বিভিন্ন স্কুল কলেজে কমিটি গঠনের মাধ্যমে ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেন। উল্লেখ্য যে, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল উক্ত কমিটির ক্রীড়া সম্পাদিকা ছিলেন। বকশীবাজারস্থ ইন্টারমিডিয়েট গার্লস্‌ কলেজ তথা বর্তমানে বদরুন্নেসা গার্লস্‌ কলেজ এর শিক্ষার্থী ছিলেন বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ সুলতানা কামাল৤
রেজাউল হক চৌধুরী ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৭০-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন কার্যক্রমে ছাত্র সমাজের পক্ষে কেন্দ্রীয় প্রচার কার্যক্রমে নিজ থানা আনোয়ারা’য় নির্বাচনী প্রচারে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন এবং পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে সফলতার সাথে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সহ-সভাপতি ছিলেন। ছাত্র ও রাজনৈতিক পর্যায় শেষে তিনি ব্যবসা ও সমাজসেবা মূলক কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতাও সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ছিল কিংবদন্তির মতো। ১৯১২ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম সমিতি নানা চড়াই উতরায় পেরিয়ে ৩২ তোপখানায় স্থায়ী হয়৤ চট্টগ্রাম সমিতির সংকটকালে এর সৃজনশীল পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় একটি সুদৃঢ় সাংগঠনিক ভিত্তি ও নীতিমালার উপর প্রতিষ্ঠানটিকে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে যে মানুষটি অক্লান্ত শ্রম এবং মেধা নিয়োগ করেছেন, তিনি হচ্ছেন রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক।
‘ঢাকার বুকে একখন্ড চট্টগ্রাম’ খ্যাত চট্টগ্রাম ভবন নির্মাণ কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে এই সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মকাণ্ডের সুসমন্বয় এবং ভবন চূড়ান্তকরণের প্রক্রিয়ার তিনি সফল সমাপ্তি টানেন। ২০১১ সালে চট্টগ্রাম সমিতির শতবর্য উদযাপন ছিল সমিতির ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। শতবর্ষ উদযাপন কমিটির আহবায়ক হিসেবে তিনি বছরব্যাপী নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেন।
২০১২ সালে সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর জীবন সদস্যদের সমিতিমুখী করার জন্য নতুন কর্মসূচি তিনি গ্রহণ করেন। জীবন সদস্যদের সন্তানদের কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য সংবর্ধনা, সাহিত্য সম্মেলন, চট্টলশিখা বুলেটিনের নিয়মিত প্রকাশনার ব্যবস্থা, চট্টগ্রামের লেখকদের বই এর প্রকাশনা উৎসব, চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে পৃষ্ঠপোষকতা, জনপ্রশাসনে কর্মরত চট্টগ্রামের কর্মকর্তাদের প্রীতি সম্মেলনের আয়োজন করা-এই সব কর্মকাণ্ড সমিতির ইতিহাসে সংযোজন করে নতুন মাত্রা। বস্তুত বর্তমানে চট্টগ্রাম সমিতির নেয়া বিভিন্ন কর্মসূচিতে, প্রকাশনা-প্রচারণায় যে শৈল্পিক দ্যোতনার ছোঁয়া আমরা লক্ষ্য করছি তার অন্যতম প্রধান রূপকার ছিলেন জনাব রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক। তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক : সাবেক দফতর সম্পাদক, চট্টগ্রাম সমিতি-ঢাকা

পূর্ববর্তী নিবন্ধসড়ক দুর্ঘটনা মহামারীতে রূপ নিয়েছে
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে