স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মৃণাল ভট্টাচার্য

জয়ন্তী লালা | বৃহস্পতিবার , ৭ জুলাই, ২০২২ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের এক বরেণ্য কণ্ঠসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃণাল ভট্টাচার্য। যিনি একাধারে সঙ্গীতযোদ্ধা এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের গৌরবদীপ্ত মুক্তিযুদ্ধে তিনি যেমন উদ্দীপনামূলক গানে গানে মুক্তিযোদ্ধাদের কঠোর যুদ্ধে প্রণোদিত করেছেন অন্যদিকে স্বাধীন দেশে একটি উদার সাংস্কৃতিক বাতাবরণ সৃষ্টির লক্ষে আমৃত্যু সংস্কৃতির সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন।
বাংলাদেশ বেতার এবং টেলিভিশনের বিশেষ শ্রেণির শিল্পী ও সংগীত পরিচালক মৃণাল ভট্টাচার্য ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলাধীন মহাদেবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা স্বনামখ্যাত ডা. নীরদ রঞ্জন ভট্টাচার্য ও মাতা শ্রীমতি প্রতিভাময়ী ভট্টাচার্য। আশৈশব গানের প্রতি অনুরক্ত মৃণাল ভট্টাচার্য নিজ গ্রামের সংগীত শিক্ষক মদন বাবুর কাছে গানে প্রথম তালিম নেন। এরপর পর্যায়ক্রমিক ভাবে তিনি সঙ্গীতজ্ঞ আব্দুল হালিম চৌধুরী, মোহন লাল দাশ, সৈয়দ আনোয়ার মুফতি এবং পণ্ডিত শ্রী মিহির লালার কাছে সঙ্গীতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। একাত্তরের ২৬ মার্চ দেশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে তিনি চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে সীতাকুণ্ডে, গ্রামের বাড়িতে চলে যান। ঐ সময় সীতাকুণ্ড বর্ণালি ক্লাবে সংগঠিত যুদ্ধকালীন কমিটিতে তিনি যুক্ত হন। ২৮ মার্চ কুমিরায় পাকসেনাদের বিরুদ্ধে ইপিআর বাহিনির সরাসরি যুদ্ধে তিনি ডা. এখলাছউদ্দিনের নেতৃত্বে চিকিৎসা ক্যাম্পে যোগ দেন। ১০ এপ্রিল ইপিআর বাহিনির সাথে পাকহানাদার বাহিনির প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১১ এপ্রিল ইপিআর কিছুটা পিছু হটে ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি চলে যান। ইপিআর বাহিনির সহযাত্রী হন দেশমাতৃকার সূর্যসৈনিক মুক্তির শপথে বলীয়ান টগবগে যুবক মৃণাল। এরপর কোলকাতা। যুক্ত হয়ে যান মুক্তিযুদ্ধে, সংস্কৃতির মূল সংগ্রামে। কোলকাতা গিয়ে দেখা হয়ে যায় শিল্পী কল্যাণী ঘোষ এবং প্রবাল চৌধুরীর সাথে। বাংলাদেশ শিল্পী সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী সহায়ক সমিতির সদস্য হন তিনি। গণসঙ্গীত এবং মুক্তিযুদ্ধের গান নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে বিশাল ভূমিকা রাখেন সেখানে। যার প্রতিফলন অমর চলচ্চিত্র ‘মুক্তির গান’ ছায়াছবি। এই সংগঠনের কিছু কর্মকাণ্ডের ফুটেজ নিয়ে ঐ চলচ্চিত্র তৈরি হয়। ১৯৭১’র প্রথম সপ্তাহে রাউজানের মহামুনি গ্রামের প্রণোদিত বড়ুয়ার সহায়তায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ‘শব্দসৈনিক’ হিসেবে ভূমিকা রাখেন তিনি ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিন পর্যন্ত।
প্রথিতযশা সঙ্গীত পরিচালক সুজেয় শ্যাম-এর তত্ত্বাবধানে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ২৪/২৫ টি গানে অংশ নেন। স্বাধীনদেশে তিনি বেতার, টেলিভিশন, বিভিন্ন মঞ্চের অনুষ্ঠানে একজন অপরিহার্য শিল্পী হিসেবে নিজেকে পরিগণিত করেন। এছাড়া আর্যসঙ্গীত সমিতি, নজরুল সংগীত শিল্পী সংস্থা সহ বিভিন্ন স্বনামখ্যাত সংগঠনে তিনি সভাপতি হিসেবে বিশাল ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক দিল্লিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি শিল্পী হিসেবে অংশ গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর দেশে এসে সহায় সম্বলহীন মৃণাল ভট্টাচার্য সরকারি অগ্রণী ব্যাংকে অফিসার পদে চাকুরীতে যোগদান করেন এবং ২০০৫ সনে চাকুরী হতে অবসর গ্রহণ করেন।
বর্তমানে স্ত্রী রত্না ভট্টাচার্য্য, বড় ছেলে সনজীব ভট্টাচার্য ঢাকা ইনস্যুরেন্স লিমিটেড এর সহকারি ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পুত্রবধূ দেবাঞ্জনা ভট্টাচার্য্য চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের সিনিয়র শিক্ষিকা এবং এক নাতনী ও এক নাতি নিয়ে তাঁর সংসার। ছোট ছেলে সুমিত দুরারোগ্য ব্যাধিতে মৃত্যুবরণ করেন ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি চট্টগ্রাম বেতার ও টেলিভিশন শিল্পী সংস্থার উপদেষ্টা, সীতাকুণ্ড বর্ণালী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং বর্ণালী লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। বাজারে তাঁর গানের একটি একক ও তিনটি যৌথ অ্যালবাম রয়েছে। তাঁর এই দীর্ঘ চলার পথে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননা লাভ করেছেন।
তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমাণ্ড কাউন্সিল, ঢাকা, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ রজত জয়ন্তী কমিটি, সেন্ট জেভিয়ার্স হল কলিকাতা, শাপলা কুঁড়ির আসর, ব্রজবাণী ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম: সরগম সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, চট্টগ্রাম: মহামুণি সাংস্কৃতিক সংঘ রাউজান, চট্টগ্রাম; পাঁচখাইন সাংস্কৃতিক সংঘ, রাউজান, চট্টগ্রাম, বাঙালি সাংস্কৃতিক মেলা, চট্টগ্রাম আমাদের পাঠশালা, চট্টগ্রাম; বিজয় উৎসব, চট্টগ্রাম: কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম: অবসর সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, চট্টগ্রাম: কচিকণ্ঠ, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম: মেয়র, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম: শহীদ স্মৃতি পাঠাগার, চট্টগ্রাম; সীতাকুণ্ড পৌরসভা, চট্টগ্রাম মহানগরী পূজা কমিটি, চট্টগ্রাম: ‘মুক্তির গান’ ছায়াছবি সম্মাননা চ্যানেল আই, ঢাকা: চলচ্চিত্র সমিতি, চট্টগ্রাম; ফৌজদারহাট বিজয় মেলা, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম: বার বিজয়া সম্মাননা, চট্টগ্রাম: লায়ন্স ক্লাব, চট্টগ্রাম; সঙ্গীত পরিষদ, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম একাডেমি, চট্টগ্রাম: উদীচী, চট্টগ্রাম; বাংলাদেশ টেলিভিশন যন্ত্রসংগীত শিল্পী সংস্থা, ঢাকা: সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মোহসীন আলী, মৌলভীবাজার, বর্ণালী ক্লাব, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম; বিজয় দিবস উদযাপন পরিষদ, চট্টগ্রাম; বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী সাংস্কৃতিক স্কোয়াড, চট্টগ্রাম: আনন্দী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, চট্টগ্রাম: শ্রুতি অঙ্গন বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম: খেলাঘর, চট্টগ্রাম: চাটগাঁর বাণী, চট্টগ্রাম; সুর-অঞ্জলি, আগরতলা, ত্রিপুরা, ভারত। তিনি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার সুর-অগুলি সংগঠন থেকে নজরুল গবেষণার উপর সম্মাননা পান।
আরো উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে বর্তমান ২০২১ ইং এর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এর ৭ম শ্রেণির জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষা বইয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিকদের ছবি ও নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যার মধ্যে মৃণাল ভট্টাচার্য্য এর ছবি ও নাম অন্তর্ভুক্ত আছে। এছাড়া ও জাতীয় যাদু ঘর ঢাকাতে তাঁর নাম ও ছবি রয়েছে। শিল্পী মৃণাল ভট্টাচার্য্য গত ৭ জুলাই ২০২০ খৃ. মঙ্গলবার, চট্টগ্রাম এর মা ও শিশু হাসপাতালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অনন্ত লোকে যাত্রা করেন। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি। নজরুল সংগীত শিল্পী সংস্থা, চট্টগ্রাম মহান কণ্ঠসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃণাল ভট্টাচার্য্যের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছে।
লেখক: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী; সভাপতি,
নজরুল সঙ্গীত শিল্পী সংস্থা, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধযত্নে থাকুক স্মৃতিকথা
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজ কাল