যত্নে থাকুক স্মৃতিকথা

রোকসানা বন্যা | বৃহস্পতিবার , ৭ জুলাই, ২০২২ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

আমাদের পাড়াটা ছিলো শহরেই। শহরে হলেও পরিবেশটা ছিল গ্রামীণ। আমাদের পাড়ায় বিশাল এক দিঘি আছে। দিঘির ঠিক অপর দিকেই আমাদের বাড়ি। বাড়ির ভিতরের পুকুরটাও বেশ বড়। ঘাট বাঁধানো, একেবারেই শান বাঁধানো ঘাট বলতে যা বুঝায় ঠিক তাই। পুকুরের চারপাশে অনেক রকম ফলাদি গাছ। তার ছায়ায় জলের রঙে ভিন্নতা আনতো সময়ে সময়ে। শুনেছি আমার পূর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন। বাড়ির ফটকে খাজনা নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষের বিশ্রামের জন্য পাকা বেঞ্চ ছিল। তারপর সিড়ি বেয়ে নেমে বাড়ি ভিতরে প্রবেশ করতে হতো। রাস্তা থেকে বাড়ি দেখা যেতো ইংরেজীর টি প্যাটার্নের। সামনে, পিছনে উঠোন।
খুব ছোটবেলায় দেখা আমার মানসপটে আরেকটি বাড়ির স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল। সে বাড়িটার অপরূপ সৌন্দর্য্য আমি জেগে থেকেও কল্পনায় আঁকি। আমাদের বাড়ির পরে ঐ বাড়ি। মাঝখানে সরু একটা গলি তারপর মাঠ পেরিয়ে বাড়ি। বাড়িটি কাঠের তৈরি। উঠোন থেকে অনেক উঁচুতে বাড়ি। বেশ চওড়া ঘরের দাওয়া। এই দাওয়ায় বসে পা দুলে দুলে আমরা সুর করে ছড়া কাটতাম।
বাড়ির সামনেই উঠোন। খুব পরিচ্ছন্ন। দেখে মনে হবে কেউ মাটি দিয়ে লেপে রেখেছে। ঠিক উঠোনের সাথেই লাগানো বড় খাল। নৌকা ভিড়তো উঠোনের গা ঘেঁষে। রঙিন পালতোলা নৌকা জোয়ারের জলে বৈঠা বেয়ে চলে যেত। খালের পাশে হরেক রকমের গাছ। বাতাসে খালের জলের দুলুনি আর নৌকার বৈঠার শব্দ এখনও আমার নিঃসঙ্গতার সঙ্গী। আমাদের পুরোনো বাড়ি। নতুন বাড়ি করে চলে আসেন জমিদারবাবু। বিশাল জায়গা জুড়ে আমাদের নতুন বাড়ি। ইট, সিমেন্টের গাঁথুনিতে তৈরি। খালের পাড়ের পুরোনো বাড়িটার অপরূপ ছবি এখনও আমার স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। আমি বড় হয়েও পাড়ার ঐ খালে পালতোলা নৌকা যেতে দেখেছি। এখন এসব কথা বললেও যারা দেখেনি, বিশ্বাস করবে না এখানে খাল ছিল। বাড়ি থেকে দেখতে পেতাম নৌ চলাচল।
জমিদার বাড়ি বলে কথা! তাই ভূত প্রেতের আনাগোনা লেগেই থাকতো বাড়িতে। ছোটকালে আড্ডায় প্রায় ভূতের কথা শুনতে পেতাম। গা ছমছম করা গল্প। ভূতের আস্তানা ছিল, তেতুলগাছ, সুপারিগাছ, পুকুরঘাট, আর বাড়ির এক কোণায় একটা টয়লেট আর স্নানঘরে। অনেকেই সেখানে ভূত দেখতে পেতো। ভূতের কথোপকথনও শুনেছিল। দিনের বেলায় সে’সব গল্প শুনে গায়ে কাঁটা দিতো। অঙ্গভঙ্গি করেও দেখাতো কেউ কেউ। সন্ধ্যারাতে কখনও পুকুর পাড় দিয়ে যদি আসতে হতো ভয়ে সিঁটিয়ে যেতাম। কাছাকাছি এলেই এক দৌঁড়ে সে জায়গা পেরিয়ে আসতাম। স্নানঘরে একা যেতে ভয় পেতাম। কারো সঙ্গি হয়ে ইলেক্টিক বাতি থাকার পরও চেরাগ জ্বালিয়েই যেতে হতো। শুনেছি আগুনকে ভয় পায় ভূতেরা।
আমার এক তুতোভাই প্রায় বলতে শুনতাম আমার মাকে, চাচি আম্মা আপনি এতো রাতে কলের ওখানে কী করছিলেন ? মা বলতো না রে বাবা আমি কী করবো ওখানে এতো রাতে! ভাইটা বলতো সাদা শাড়ি পরেছিলেন, কত ডাকলাম পিছনে তাকালেন না একবারও। আমি ভয়ে মায়ের থেকে দূরত্বে যেতাম সে’সময়ে। দুপুরে, সন্ধ্যার পর চুল খুলে চলাফেরা বারণ ছিল বড়দের। আমার দাদির দু’তিনজন সাহায্যকারী রাত দিনের কাজের জন্য ঘরে থাকতেন। একদিন এদের একজনের গোঙ্গানির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। আব্বা দরজা খুলে বের হয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে দেখলো এদের মধ্যে বয়স্ক যে’জন উনি এমনটা করছেন। ছোট যে দ’ুজন ছিলেন তাদের ভাষ্যানুযায়ী যা বুঝতে পারলেন টয়লেট থেকে আসার পর এমন করছেন। এক সময়ে ওনার গোঙ্গানির শব্দ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। তখন সবাই বলাবলি করছিলেন অন্ধকারে একা টয়লেটে যাওয়া ঠিক হয়নি। আমার তুতো দাদা ভাই পুকুর পাড়ের গম্বুজের উপর বসে চাঁদনি রাতে বাঁশি, হারমনিকা বাজাতো খুব সুন্দর করে। বেচারাকে অনেক বকা শুনতে হতো এসবের কারণে। পুরুষ মানুষদের ভূত বোধহয় পছন্দ করতেন না। নয়তো তখনই একটা কিছু ঘটতে পারতো ভাইয়ের সাথে। একদিন মা’কে দেখলাম পুকুর পাড়ের জানালা দিয়ে কথা বলছে বিড়বিড় করে। হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বেঁহুশ হয়ে পড়েছেন। আমরা সবাই কান্নাকাটি করছি। মাকে দরুদ পড়ে ফুঁ দিয়ে চোখে মুখে পানির ছিটানি দেয়ার পর সুস্থ হলেন। অনেক দিন মায়ের কাছে ভয়ে ঘেঁষিনি। অনেক সময় এসব কথা রয়ে সয়ে দীর্ঘদিন যাবত চলাফেরা করতো বৌ ঝিয়ের ভাত ঘুমের আড্ডায়। পরবর্তীতে যখনই ভূতের গল্প হতো তখন পুকুর পাড়ের, স্নানঘরের ভূত এসে আমাদের গল্পে ঢুকে পড়তো আর ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে দিয়ে চলে যেতো। এখন হররমুভি, আর এফ এম রেডিওতে নানান রকমের ভূতের গল্প শুনতে পাওয়া যায়। আমি ভাবছি ভূতবেটারা এমন গল্প শুনে লজ্জায় গাছ ছেড়ে, ঝোপ জঙ্গল থেকে পালালো কি না। নয়তো এমন ভর দুপুরে আর সন্ধ্যাবেলায় হাওয়ায় চুল এলিয়ে গাছ গাছালির এলোমেলো বাতাসে ফটোস্যুাট অন্তত করতে পারতাম না! আমাদের ভূত কি আপনাদের পাড়ায়? বলেন শুনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানুষের মহত্ত্ব
পরবর্তী নিবন্ধস্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মৃণাল ভট্টাচার্য