কাল আজ কাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ৭ জুলাই, ২০২২ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

তুলনামূলক ভাল অবস্থানে বাংলাদেশ
আবারও কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে আমেরিকায়। গত ২৭ জুন দেশটির ওহাইও অঙ্গরাজ্যের অ্যাক্রন এলাকায় জেল্যান্ড ওয়াকার নামের এক কৃষ্ণাঙ্গকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। তবে একবার-দুবার নয়, তাঁকে ৬০ বার গুলি করা হয়েছে বলে জানা গেছে । পুলিশ নিজ থেকে রোববার এ ঘটনার একটি ভিডিও প্রকাশ করে। তবে তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিয়মিত তল্লাশির অংশ হিসেবে জেল্যান্ডকে থামানোর চেষ্টা করেছিল পুলিশ। কিন্তু জেল্যান্ড ওই সময় গাড়ি রেখে পালানোর চেষ্টা করে। জেল্যান্ড আগে গুলি চালিয়েছে। পরে জানা গেছে, পুলিশ এ কথা বললেও যখন গুলি চালানো হয়, তখন জেল্যান্ডের কাছে কোনো পিস্তল ছিল না। ২৫ বছর বয়সী ওই ব্যক্তির গাড়িতেই ছিল পিস্তলটি। হত্যার পরই তাঁর গাড়ি থেকে পিস্তলটি উদ্ধার করা হয়। এই ভিডিও প্রকাশের পর থেকে পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে ওঠে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অ্যাক্রনের মেয়র ডেনিয়েল হরিগ্যান সেখানকার বাসিন্দাদের বিক্ষোভ না করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, যে ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে, সেটি হৃদয়বিদারক। এ ঘটনা মেনে নেওয়ার মতো নয়।
যে আমেরিকা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের শিক্ষা দেয় সে আমেরিকায় মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করার কোনো অবকাশ নেই।
২০ জুন ২০১৭ সালে প্রকাশিত বিবিসির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর বন্দুকের গুলিতে এক হাজার তিনশ শিশু নিহত হয়। সরকারের তৈরি করা এক পরিসংখ্যানে এ কথা বলা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন-এর গবেষকরা জানিয়েছেন, প্রতি বছর পাঁচ হাজার আট শত শিশু বন্দুকের গুলিতে গুরুতর আহত হয়। গবেষণায় বলা হয়েছে, আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে যেসব শিশু নিহত হয় তাদের মধ্যে মাত্র ছয় শতাংশ দুর্ঘটনাবশত। বাকিগুলো হত্যাকাণ্ড কিংবা আত্মহত্যার মতো ঘটনা। মূলত এক বছর থেকে সতের বছর বয়সী শিশুরা বন্দুক সহিংসতার শিকার হচ্ছে।’
বিবিসির প্রতিবেদনে ক্যাথরিন ফোলারের গবেষণার উদ্ধৃতিতে বলা হয়, “প্রতিবছর আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে শিশু মৃত্যুর ঘটনা একটি উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। প্রতিদিন ১৯ শিশু আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে মারা যাচ্ছে নয়তো গুরুতর আহত হচ্ছে।”
গবেষকরা বলছেন, আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে শিশু মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে এর আগে এতো ব্যাপক মাত্রায় গবেষণা হয়নি। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডিসট্রিক্ট অব কলম্বিয়া এবং লুইজিয়ানায় আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে শিশুমৃত্যু বেশি । গবেষকরা বলেছেন, পৃথিবীর অন্য উন্নত দেশগুলোতে আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে শিশু মৃত্যুর ঘটনা আমেরিকার তুলনায় অনেক কম।
আমেরিকায় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন করতে বেশ কয়েকবার সরব হয়েছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। কিন্তু তার সে চেষ্টা ব্যর্থ হলেও এবার বাইডেন প্রশাসন বন্দুক আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। অনেক বাধা পেড়িয়ে এবার আইনটি হতে যাচ্ছে। শিশুমৃত্যু ছাড়াও বিভিন্ন সময় আমেরিকায় বন্দুকধারীদের অতর্কিত হামলায় বহু মানুষ প্রাণ হারায়। সংবাদমাধ্যম থেকে সংগৃহীত তথ্যে শিশু হত্যার খবরে বলা হয়েছে, গত চব্বিশে মে টেক্সাসের ইউভ্যালডে এলেমেন্টারি স্কুলে এক বন্দুকধারীর নির্বিচার গুলিতে উনিশটি শিশু ও দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এরই মাত্র দশদিন আগে নিউইয়র্কের বাফালো শহরের একটি সুপারমার্কেটে আরেক ঘটনায় নিহত হয় দশ জন। ২০১৮ সালে, পার্কল্যান্ডের একটি স্কুল শুটিংয়ে ১৪জন শিক্ষার্থী ও তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক নিহত হয়েছিলেন। ২০১২ সালে কানেকটিকাটের স্যান্ডি হুক এলেমেন্টারি স্কুলে হামলায় বারো শিশুসহ ২৬ জন নিহত হয়েছিল। তার আগে টেক্সাসের একটি স্কুলে বন্দুকধারীর গুলিতে ১৯ শিশু নিহতের ঘটনা ঘটে।
জর্জ ফ্লয়েডের কথা বিশ্ববাসী এখনো ভোলেনি। আমেরিকায় নিরস্ত্র এই কৃষ্ণাঙ্গকে গ্রেপ্তার করার পর একজন পুলিশ অফিসার হাঁটু দিয়ে তার গলা চেপে ধরার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েচিল বিশ্বব্যাপী। ওই ব্যক্তির মৃত্যু দেশটিতে সংখ্যালঘু বর্ণ সমপ্রদায়ের বিরুদ্ধে পুলিশের নৃশংসতাকে আবার সামনে এনেছিল। মিনিয়াপোলিস অঙ্গরাজ্যের একটি রেস্তোরাঁয় নিরাপত্তা কর্মী হিসাবে কাজ করতেন ৪৬ বছর বয়স্ক জর্জ ফ্লয়েড। সন্দেহভাজন একটি প্রতারণার ব্যাপারে কল পেয়ে পুলিশ তাকে ধরে।
একজন প্রত্যক্ষদর্শীর তোলা ১০ মিনিটের ওই ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় জর্জ ফ্লয়েড নি:শ্বাস না নিতে পেরে কাতরাচ্ছেন এবং বারবার সেই শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারকে বলছেন, “আমি নি:শ্বাস নিতে পারছি না”। এই ঘটনা যেদিন ঘটে সেইদিনই আর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। নিউইয়র্কে এক শ্বেতাঙ্গ নারীর পোষা কুকুর নিয়ে তুচ্ছ একটা বিতর্কের জেরে পুলিশ ডাকা এবং এর জন্য এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির ওপর পুলিশের চড়াও হবার ঘটনার।
ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্রের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে মারা গেছে ১০১৪ জন এবং বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে নিহতদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান।
ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স নামে একটি বেসরকারি সংস্থার চালানো জরিপে দাবি করা হয়েছে যে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় তিনগুণ বেশি মারা যায় কৃষ্ণাঙ্গরা।
আসলে মানুষ কোথাও ভালো নেই। যে আমেরিকা বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে, মানবাধিকার নিয়ে, নির্বাচন নিয়ে কয়েকদিন পরপর উদ্বেগ জানায় সে আমেরিকায় তো মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় প্রতি পদে পদে। বর্ণবাদের শিকার হতে হয় প্রতিটি ক্ষেত্রে। সে অভিযোগ তুলবে কে? ইরাকে গণতন্ত্র লাগবে, লিবিয়ায় গণতন্ত্র লাগবে, সিরিয়ায় গণতন্ত্র লাগবে, এসব ছিল আমেরিকার অজুহাত। সে দেশগুলোর জনগণের দাবি নয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি তুলে আমেরিকা মূলত সে দেশগুলোকেই ধ্বংস করেছে। আমেরিকার চাপিয়ে দেওয়া গণতন্ত্রের বলি হতে হচ্ছে লাখ লাখ মানুষকে। যে নিজের ঘর সামলাতে পারে না সে সারাবিশ্বের দায়িত্ব নিতে চায় কীভাবে তা ভেবে পাই না।
বাংলাদেশে নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই ওয়াশিংটন থেকে বাণী আসতে থাকে। এ দেশে নিযুক্ত মার্কিন দূতের তৎপরতা তখন লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। আর আমাদের মিডিয়ার লোকজনও সে রাষ্ট্রদূতের মুখনিঃসৃত বাণী প্রচারের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। যদিও আমেরিকার অন্তত গত দুটি নির্বাচন নিয়ে আমাদেরই উদ্বেগ প্রকাশ করার অনেককিছু ছিল। যদি আমরা হিসাব মিলাই দেখতে পাবো গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও হত্যাকাণ্ডের তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান আমেরিকার চেয়ে যথেষ্ট ভালো। যদিও আমি জানি আমার এই বক্তব্যে মার্কিন প্রশাসনের চেয়ে বেশি খেপবে এ দেশেরই অনেক নাগরিক।
লেখক : কবি-সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মৃণাল ভট্টাচার্য
পরবর্তী নিবন্ধড.মইনুল ইসলামের কলাম