স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সব ধরনের প্রস্তুতি থাকতে হবে

চট্টগ্রামে নেভাল একাডেমিতে রাষ্ট্রপতি কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা নেভাল একাডেমিতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর রাষ্ট্রপতি কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্বভৌমত্ব রক্ষার সব প্রস্তুতি থাকতে হবে বলে উল্লেখ করে নৌবাহিনীর নবীন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, সততা, নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগে বলীয়ান হয়ে সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় তোমাদের সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। শৃঙ্খলাবোধ ও কর্তব্য নিষ্ঠা, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ মাতৃকার দায়িত্ব পালন করতে হবে। যদি কখনো, খোদা না করুক বহিঃশত্রুর আক্রমণ হয়, সেটা যেন আমরা প্রতিহত করতে পারি। আর যে কোনো যুদ্ধে যেন জয়ী হতে পারি, সেভাবে সশস্ত্র বাহিনীকে আমি প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।

আমাদের নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী সব বাহিনী; অর্থাৎ সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন, আধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে আমি প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। প্রশিক্ষণের ওপর তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দেন বলেও বক্তব্যে উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সকাল ১০টা নাগাদ হেলিকপ্টারযোগে নেভাল একাডেমিতে পৌঁছালে নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম শাহীন ইকবাল তাঁকে স্বাগত জানান। পরে প্রধানমন্ত্রী নৌবাহিনীর মিডশিপম্যান ২০২০/এ এবং ডাইরেক্ট এন্ট্রি অফিসার (ডিইও) ২০২২/বি ব্যাচের শীতকালীন রাষ্ট্রপতি কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন।

তিনি নবীন অফিসারদের কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করেন। কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, সেনা ও বিমান বাহিনীর প্রধান, সংসদ সদস্য, নৌ সদর দপ্তরের পিএসও, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডারসহ ঊর্ধ্বতন সামরিক ও অসামরিক কর্মকর্তা, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নৌ কমান্ডোসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা, দেশী-বিদেশী কূটনীতিক এবং শিক্ষা সমাপনী ব্যাচের অভিভাবকরা উপস্থিত থেকে মনোজ্ঞ এ কুচকাওয়াজ উপভোগ করেন।

কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ২০২০/এ ব্যাচের ৩৭ জন মিডশিপম্যান এবং ২০২২/বি ব্যাচের ৬ জন ডাইরেক্ট এন্ট্রি অফিসারসহ সর্বমোট ৪৩ জন নবীন কর্মকর্তাকে কমিশন প্রদান করা হয়। এদের মধ্যে ৯ জন মহিলা এবং ২ জন প্যালেস্টাইনের কর্মকর্তা রয়েছেন। নৌবাহিনীর নবীন সদস্যরা দেশরক্ষার শপথ গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী কমিশনপ্রাপ্ত নবীন কর্মকর্তাদের অভিনন্দন জানান। তিনি তাদেরকে বাহিনীর শৃক্সখলা মেনে চলার দিকনির্দেশনা দেন। নৌবাহিনীর আধুনিকায়নে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প তুলে ধরেন সরকারপ্রধান। তিনি যে কোনো দুর্যোগ এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌম অক্ষুণ্ন রাখতে সশস্ত্র বাহিনীকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অত্যন্ত স্পষ্ট। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে পররাষ্ট্রনীতি আমাদের দিয়ে গেছেন- ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়।’ আমরা কারো সাথে যুদ্ধ করবো না। আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখেই চলব।

আমাদের দেশ স্বাধীন। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি থাকতে হবে।

নবীন অফিসারদের উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষার্থে তোমরাই আমাদের নৌবাহিনীর ভবিষ্যৎ কান্ডারী। নবীন কর্মকর্তারা নেভাল একাডেমি থেকে অর্জিত জ্ঞান যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে নিজেদেরকে যোগ্য কর্মকর্তা হিসেবে গড়ে তুলবে এবং ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে এই প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা ও অগ্রগতির পথে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে বলেও প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি পেশা হিসেবে দেশ সেবার এ পবিত্র দায়িত্বকে বেছে নেয়ায় নবীন কর্মকর্তাদেরকে আন্তরিক অভিনন্দন জানান।

‘ডিসেম্বর’ আমাদের বিজয়ের মাস বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শ্রদ্ধার সাথে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করেন। তিনি জাতীয় চার- নেতাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং সম্ভ্রমহারা ২ লাখ মা-বোনের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট ঘাতকদের হাতে আমার মা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ভাই- মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল এবং শিশু শেখ রাসেল, দুই ভ্রাতৃবধূ- সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, একমাত্র চাচা মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, ফুফাতো ভাই মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মণি, ফুফা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আব্দুর রব সেরনিয়াবত, রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল উদ্দীন আহমেদ, পুলিশ কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমানসহ মোট ১৮ জন শহীদ হন। প্রধানমন্ত্রী সকলের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।

তিনি বলেন, জাতির পিতা বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ভূ-রাজনৈতিক এবং সমুদ্র সম্পদের গুরুত্ব সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সে কারণেই তিনি বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পূর্বেই ঐতিহাসিক ৬ দফায় নৌবাহিনী সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থানান্তরের দাবি জানিয়েছিলেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই নৌবাহিনী আত্মপ্রকাশ করে এবং পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামে সফল অভিযান পরিচালনা করে। জাতির পিতা স্বাধীন দেশে দক্ষ, শক্তিশালী ও আধুনিক নৌবাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

সরকার প্রধান বলেন, বাংলাদেশ নৌবাহিনী রণতরী নির্মাতা ও সিস্টেমে পরিণত হচ্ছে এবং এর ফলে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ নিজস্ব ব্যবহারের জন্য স্থানীয় শিপইয়ার্ডেই জাহাজ নির্মাণ করছে।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ নৌবাহিনী খুলনা শিপইয়ার্ডে পাঁচটি টহল জাহাজ ও দুটি বৃহৎ টহল জাহাজ নির্মাণ সম্পন্ন করেছে। আরো পাঁচটি টহল জাহাজের নির্মাণকাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, আমাদের নৌবাহিনী তিন বাহিনীর জন্য আইএফএফ (আইডেন্টিফিকেশন অব ফ্রেন্ড এন্ড ফো) সিস্টেম প্রস্তুত করেছে। এখন নৌবাহিনী (রণতরী ও সিস্টেমের) ক্রেতা থেকে একটি ‘নির্মাতা’ বাহিনীতে পরিণত হতে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ নৌবাহিনী কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টালেনের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত- যেটি দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল।
তিনি আরো বলেন, বিএনএস শের-এ-বাংলার নির্মাণকাজ চলছে। কক্সবাজারের পেকুয়ায় একটি স্থায়ী সাবমেরিন ঘাঁটি নির্মিত হচ্ছে।

২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর ১৯৭৪ সালের প্রতিরক্ষানীতির আলোকে ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কাজ শুরু করার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ১৪ বছরে নৌবাহিনীতে ৪টি ফ্রিগেট, ৬টি করভেট, ৪টি লার্জ পেট্রোল ক্রাফট, ৫টি পেট্রোল ক্রাফট এবং ২টি ট্রেনিং শিপসহ মোট ৩১টি যুদ্ধজাহাজ সংযোজন করি। দক্ষ কমান্ডো ও উদ্ধারকারী দল হিসেবে ‘স্পেশাল ওয়ারফেয়ার ডাইভিং এন্ড স্যালভেজ কমান্ড’ এবং নৌবাহিনীর এভিয়েশন উইং প্রতিষ্ঠা করি। ২০১৭ সালে ২টি সাবমেরিন সংযোজনের মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ ত্রি-মাত্রিক নৌ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হয় বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চলমান আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে আরও ২টি নতুন মেরিটাইম পেট্রোল এয়ারক্রাফট সংযোজন করেছি। এছাড়া নৌবাহিনীতে অচিরেই দুইটি ইউটিলিটি হেলিকপ্টার সংযোজন করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। নৌবাহিনীতে ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রবর্তন করা হয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ সমপ্রতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুর্বণ জয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষ্যে নৌবাহিনী ‘ইন্টারন্যাশনাল ফ্লিট রিভিউ-২০২২’ আয়োজন করে। এতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।

২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, এই বাংলাদেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। বাংলাদেশের জনগণ হবে প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন। ডিজিটাল ডিভাইসে শিক্ষা নিয়ে তারা প্রত্যেকে প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। আমাদের অর্থনীতি, যে কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, সব কিছু আমরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিয়ে যাব। বাংলাদেশ হবে স্মার্ট উন্নত বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ জাতির পিতা চেয়েছিলেন- ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

সদ্য কমিশনপ্রাপ্তদের মধ্যে মিডশিপম্যান ২০২০/এ ব্যাচের মিডশিপম্যান শাহীদ আবেদীন আকিফ সেরা চৌকস মিডশিপম্যান হিসেবে ‘সোর্ড অব অনার’ পান।
এছাড়া মিডশিপম্যান এ এইচ এম মাহমুদুন নবী প্রশিক্ষণে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মান অর্জনকারী হিসেবে ‘নৌ প্রধান স্বর্ণ পদক’ এবং ডাইরেক্ট এন্ট্রি অফিসার ২০২২/বি ব্যাচ হতে অ্যাক্টিং সাব লেফটেন্যান্ট আল রেদুয়ান মাজরু শ্রেষ্ঠ ফলাফল অর্জনকারী হিসেবে ‘বীর শ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন স্বর্ণ পদক’ লাভ করেন। প্রধানমন্ত্রী নবীন এসব কৃতী কর্মকর্তার হাতে পদক তুলে দেন। তিনি গতকাল বিকেলেই হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় ফিরে যান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিএনপি কীভাবে আবার ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছে : প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধনাইক্ষ্যংছড়িতে একদিনেই ৫৭ গরু ও ৮ মহিষ জব্দ