স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ

পিংকু দাশ | মঙ্গলবার , ১৪ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৯:০২ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ, বিশ্বে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা অপার বিস্ময়ের নাম। বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ডিসেম্বর মাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের কথা, লাখো শহীদের কথা, যুদ্ধাহত সৈনিকের কথা এবং সর্বোপরী শোষণ কুশাসনের কথা। এবারের বিজয় এসেছে ভিন্ন আমেজে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ অর্জন করেছে। বিজয় দিবসে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে?
আজ থেকে ৫০ বছর পূর্বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মর্যাদা লাভ করে বাংলাদেশ। পৃথিবীর বুকে নূতন একটি দেশের অভ্যুদয় ঘটে । এবছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী দুটো ঐতিহাসিক এবং গৌরবের দিন একসাথে পালন করছে জাতি। এই মাহেন্দ্রক্ষণকে সামনে রেখে এবারের বিজয় উৎসব অন্যবারের তুলনায় আরও বেশি উৎসবমুখর এবং তাৎপর্যপূর্ণ ।
ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যকে ছিনিয়ে এনে বাঙালি জাতিকে পূর্ণতা এনে দিয়েছেন যে মহানায়ক, তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও নেতৃত্বে ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ আর ভারত মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় নতুন দেশ বাংলাদেশ।
‘সাবাস বাংলাদেশ! এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয়,
জ্বলে- পুড়ে- মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়’।
বিজয় দিবস বাঙালির বহু ত্যাগ তিতীক্ষা এবং সাধনার ফল। শোষণ, নিপীড়ন এবং দুর্বিষহ অতীতকে ভুলে লাল সবুজের পতাকা তলে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখার দিন। বাঙালির জাতীয় জীবনে এর থেকে আনন্দের দিন আর নেই।
১৯৭১ সালে মাত্র ৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। এর পরের বছর প্রথম ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের জন্য ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে সেই বাংলাদেশ ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশে বাজেটের আকার বেড়েছে ৭৬৭ গুণ। সেদিনের ১২৯ ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশটিতে বর্তমানে মাথাপিছু আয় ২০৬৪ ডলার। অর্থাৎ ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের তুলনায় মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭৫ গুণ। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২.৫ শতাংশ । ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮.১৫ শতাংশ। মহামারী করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী যেখানে প্রবৃদ্ধির গতি থমকে গেছে সেখানে ২০২১ সালে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.৮ শতাংশ। বৈশ্বিক মহামারীতে ও রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে এসেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসীরা রেকর্ড পরিমাণ ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন দেশে। প্রবাসীদের পাঠানো রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্সের কারণে ৫ জুলাই প্রথম বারের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ৪৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৬৪২ কোটি ৯০ লাখ ডলারে উন্নীত হয়েছে। যা উন্নয়নের আরেক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। বৈদেশিক রপ্তানি আয়ে অর্জিত হয়েছে নতুন রেকর্ড । ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৪০ বিলিয়ন বা ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলার । যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে কমে এসেছে দারিদ্র্যের হার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী ২০১০ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল সাড়ে ৩১ শতাংশ। ২০১৬ সালের জরিপে তা কমে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসে। তৈরি পোশাক খাত এবং তথ্য প্রযুক্তি খাতে উল্লেখযোগ্য শ্রমিকের কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে ।
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। বিশ্ব দরবারে মর্যাদার আসনে উন্নীত হয়েছে আমাদের দেশ। এই উত্তরণ এমন এক সময়ে হয়েছে যখন আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি। ১৯৭৫ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে থাকা বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের উত্তরণে সিডিপির সব শর্ত পূরণ করেছে ২০১৮ সালে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্টের নিয়মানুযায়ী কোনো দেশ পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় উত্তরণের মানদণ্ড পূরণে সক্ষম হলে, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চুড়ান্ত সুপারিশ পায়। গত ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬ তম বৈঠকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ অর্জন করেছে। ২০১৮ থেকে ২০২১ এই তিন বছরে আমরা সূচকের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে, যা দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য অত্যন্ত গর্বের।
মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা এ তিনটি সূচকে শর্ত অনুযায়ী উন্নীত করায় জাতিসংঘের সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল দেশ হতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১৮২৭ মার্কিন ডলার। মানবসম্পদ সূচকে উন্নয়নশীল দেশ হতে ৬৬ পয়েন্টের প্রয়োজন, বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ৭৫.৩। অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকে কোনো দেশের পয়েন্ট ৩৬ এর বেশি হলে সেই দেশকে অনুন্নত দেশের পর্যায়ে রাখা হয়, ৩২ এ আসার পর উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জিত হয়। সেখানে বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ২৫.২। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটবে। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে দেশি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরো উৎসাহী হবেন। এতে করে দেশে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ বাড়বে এবং কর্মসংস্থান বাড়বে। শিল্পের আধুনিকায়নের পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্যের বহুমুখীকরণ ঘটবে এবং সার্বিক উৎপাদন বাড়বে।
২০০৯ সাল থেকে শুরু করে অদ্যাবধি এদেশের সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ আজ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। ছোট অর্থনীতির দেশটা আজ পরিচিতি পেয়েছে ‘এশিয়ার টাইগার ইকোনমি’ হিসেবে।
বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু একে অপরের পরিপূরক। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি কল্পনা করা যায় না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণায় এবং বঙ্গবন্ধুকে আশ্রয় করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধীরা এখনও ওৎ পেতে আছে। সুযোগ পেলেই তারা দেশের এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ক্ষতি সাধন করতে দ্বিধা করে না। তাই এবারের মহান বিজয় দিবস, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে আমাদের একমাত্র অঙ্গীকার হউক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ গঠন করে মানবতার পক্ষে, মানুষের পক্ষে, জীবনের পক্ষে কাজ করে দেশ ও জাতিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেয়া।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ,
বোয়ালখালী হাজী মোঃ নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধলাখো শহীদের রক্তে কেনা দেশ
পরবর্তী নিবন্ধমুক্তিযোদ্ধা সেল্টার : নোয়াজিশপুর ফতেহ্‌ মোহাম্মদ শিকদার বাড়ি