মুক্তিযোদ্ধা সেল্টার : নোয়াজিশপুর ফতেহ্‌ মোহাম্মদ শিকদার বাড়ি

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন | মঙ্গলবার , ১৪ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৯:০৩ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ এর মার্চ মাসে যুদ্ধ শুরু হলে আমরা পরিবারের সবাই চট্টগ্রাম শহর থেকে আমাদের গ্রামের বাড়ি ফতেহ্‌ মোহাম্মদ শিকদার বাড়ি, নোয়াজিশপুরে চলে আসি। নোয়াজিশপুর চট্টগ্রামের রাউজান উপজিলায় অবস্থিত। চট্টগ্রাম রাঙামাটি প্রধান সড়কের গহিরা পয়েন্ট থেকে উত্তর দিকে অদুদিয়া সড়ক দিয়ে ২ কিলোমিটার দূরে গেলেই নোয়াজিশপুর। ১৯৭১ এ সড়কটি ছিল মাটির। আমাদের বাড়ির অবস্থান অদুদিয়া স্কুলের ঠিক উত্তর পাশের প্রথম ঘরটি। আমার বাবার নাম ছিলেন মোহাম্মদ ইসহাক, তিনি তৎকালীন পাকিস্তান রেলওয়েতে চাকুরী করতেন, সেই সূত্রে আমরা আগ্রাবাদের ঢেবার পাড় রেলওয়ে কলোনীতে থাকতাম। কিন্তু গ্রামের বাড়ির সাথে আমার আব্বা ও আমাদের খুব ভালো যোগাযোগ ছিল। প্রতি নভেম্বর-ডিসেম্বরে আমরা সবাই গ্রামের বাড়িতে আসতাম। ধান কাটা ও ধান গোলায় তোলার মৌসুম চলতো তখন।
আমাদের মূল ঘরটি ছিল মাটির দেয়াল ও টিনের চাল দেয়া। মাটির ঘরকে আমাদের এলাকায় বলতো গুদাম ঘর। বর্তমানে মাটির তৈরী ঘরের দেখা পাওয়া যায় না। ঘরের সামনে ছিল বেশ বড় উঠান। উঠানের দক্ষিণে ছিল আমাদের ধানের গোলা। তারপর ছিলো আরেকটি মেহমান থাকার ঘর। এই ঘরটি চতুরা (কাচারী) ঘর হিসাবে পরিচিত ছিল। আমাদের চতুরা ঘরটি বেশ বড় ছিল। মাটিতে বিছানা পাতালে ২৫- ৩০ জন লোক ঘুমাতে পারতো।
কাচারী ঘরের পরে পূর্বদিকে ছিল ছোট্ট একটা এবাদত খানা। এখানেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হতো। তখন আমাদের গ্রামে কোনো মসজিদ ছিল না। এখন মাশাআল্লাহ দুইটি পরিপূর্ণ মসজিদ আছে।
এপ্রিল-মে মাসের কোনো এক সময় থেকে লক্ষ্য করলাম আমার মা আনজুমন-আরা-খানম অনেক বড় বড় ডেকচিতে ভাত তরকারী রান্না বান্না শুরু করলেন। আমার মায়ের বাড়ি ছিল সুলতান পুরের বড়বাড়ি পাড়া গ্রামে।
আমাদের চতুরা ঘরে অপরিচিত অনেক নতুন লোক জনের আগমন হলো। কেমন যেন ভয় ও আনন্দে মিশানো সময় চলছিল। আমরা যারা ছোট ছিলাম, আমাদের সাথে তেমন কোনো ইনফরমেশন শেয়ার করা হতো না। সবাই যেন একটা আতংকের মধ্যে থাকতো। আমার বড় ভাইয়েরা রেডিওতে বিবিসি/আকাশ বাংলার খবর শুনার জন্য উদগ্রীব থাকতো।
মুক্তিযোদ্ধারা দিনের বেলা অনেকেই চতুরা ঘরে ঘুমাতো অথবা পরবর্তী অপারেশনের পরিকল্পনা করতো। আমরা বাইরে থেকে উনাদের কথার আওয়াজ শুনতাম। ঘর থেকে কেউ বের হতো না। আমরা ছোটরা বাড়ির উঠানে খেলাধুলা করতাম এবং বুঝতে পারতাম চতুরা ঘরের ভেতর লোকজনের কথাবার্তা ও অবস্থান। সন্ধ্যা হলে ওরা কোথায় যেন বেরিয়ে যেত। মা বললো ওরা মুক্তিবাহিনীর দল। আমাদের নোয়াজিশপুর তখন অনেকটা মুক্ত এলাকা। সেই কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান নোয়াজিশপুরে ছিল অনেকটা নিরাপদ।
মুক্তিযোদ্ধারা মূলত ভারতের বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শেষে রামগড় বর্ডার পার হয়ে ফটিকছড়ি ও খিরাম এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতো। তারপর চট্টগ্রাম এর বিভিন্ন জায়গায় অপারেশনের জন্য চলে যেতো। সেই চলার পথে কিছু মুক্তিযোদ্ধার দল এক/ দুই রাত আমাদের কাচারী ঘরে ঘুমাতো।
আমাদের এলাকায় আরো অনেকের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের সেলটার ছিল কিন্তু অন্য সেলটার এর অবস্থান আমাদের জানা ছিল না। নিরাপত্তার কারণে এই নিয়ম ছিল।
নোয়াজিশপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা খাওয়ার এই ব্যাপারগুলো কমুনিক্যাট করতেন আমাদের এলাকার কয়েকজন মুরব্বী। উনাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কাজী আনোয়ারুল আজিম (প্রকাশ আজিম সাব), ইদ্রিস চৌধুরী (ঈদু চৌধুরী-মদুন চৌধুরী বাড়ি), জনাব জমির চৌধুরী এবং আরো অনেকে।
উনারা আমার বাবা মোহাম্মদ ইসহাক এবং বড় ভাই মোরশেদ (জাহাংগীর), আলমগীর ও চাচাতো ভাই মোজাহের শিকদার এর সাথে যোগাযোগ করে মুক্তিযোদ্ধাদের আগমনের খবর দিতেন। সেই অনুসারে উনাদের বিছানা, বালিশ ও খাবারের ব্যবস্থা করা হতো।
আমাদের সব ভাইদের কাজ ছিল ওদের খাবার দাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র চতুরায় নিয়ে যাওয়া।
মাঝে মাঝে আমি ও আমার ভাই জসীমকে আমাদের চতুরায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা ভেতরে ডাকতেন এবং একটা লিস্ট ও কিছু টাকা দিতেন উনাদের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিষ কিনে আনার জন্য। তাতে থাকতো স্টার সিগারেট, বিড়ি , ম্যাচ (আমরা বলতাম মাশিস) ও টর্চলাইটের ব্যাটারী। আমরা ‘গাগগুলাতলা’য় মুনুক কাক্কু (মোহাম্মদ আনোয়ার) অথবা দানু হাজী চাচার দোকান থেকে কিনে নিয়ে আসতাম মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। চতুরার ভেতর ঢুকার সুবাদে উনাদের সাথে থাকা অস্ত্র হাতে নিয়ে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ হয়েছিল। আমার এখোনো মনে আছে কালো রঙের সেই অস্ত্রটি, যার সামনের অংশটি ছিল কালোছিদ্র যুক্ত নল। এখন ছবি দেখে বুঝতে পারি ওটা ছিল সাবমেশিনগান।
আমাদের বাড়ির কালু দাদা (রফিকের বাবা) ও ফয়জ আহমদ চাচার ঘর থেকেও মাঝে মাঝে ভাত তরকারী আসতো মুক্তি বাহিনীদের জন্য। আমাদের চতুরা ঘরে তখন অবস্থানকরা মুক্তিযাদ্ধাদের অনেকেরই নাম আমার বড়ভাই জানতেন। উল্লেখযোগ্য মুক্তিযোদ্ধারা হলেন জনাব কমান্ডার তোফায়েল আহমেদ (সুলতানপুর), ডা. সরফরাজ খান বাবুল, সারজেন্ট জাফর (মোহাম্মদপুর-তৎকালীন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন), ফেরদৌস খান রুমী (কাগতিয়া), মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব (সাপলং)সহ আরো অনেকেই। ঝয়ঁধফৎড়হ খবধফবৎ সুলতান মাহমুদ (পরবর্তীতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান) উনার দল নিয়ে একরাত আমাদের এই কাচারী ঘরে অবস্থান করেছিলেন।
এই মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। ওদের ঋণ কখনো শোধ করা যাবে না।
লেখক: কানাডা প্রবাসী রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ
পরবর্তী নিবন্ধশহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের ভাবনা