স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও একান্ত ভাবনা

নেছার আহমদ | রবিবার , ২৮ মার্চ, ২০২১ at ৮:৫৪ পূর্বাহ্ণ

২০২১ এর মার্চ মাস! এ সময়ে জাতি পালন করলো স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। স্বাধীনতার সুবর্র্ণ জয়ন্তী পালনের মাইল ফলক সামনে রেখে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে তৈরি হয়েছে, ‘রূপকল্প-২০২১’। স্বাধীনতার সুবর্র্ণ জয়ন্তী যখন পালন করছি তখন স্বাভাবিকভাবে মনের মাঝে কিছুটা আনন্দ ও স্বস্তি কাজ করছে। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ অর্ধেক সময় এদেশ শাসন করেছে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। আমরা হারিয়েছি স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এক সময় আমরা মনে করেছিলাম এ স্বাধীনতা অর্থহীন, মূল্যহীন, স্বাদহীন, রঙবিহীন। আজ স্বাধীনতার সুবর্র্ণজয়ন্তীর এ সময়ে ‘আমার স্বাধীনতা যেন আমার জন্য রঙিন’।
১৯৭১ এর ২৬ মার্চ, এ দিনটি আমাদের অনেকদিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত মুহূর্ত। গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা ওয়ারলেসে চট্টগ্রামে তাঁর বন্ধু ও দীর্ঘদিনের সহকর্মী, চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জহুর আহমদ চৌধুরীর নিকট প্রেরণ করেন। সেই ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণাটি ছিল : “পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজাবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে।
সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ-দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপস নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা”
শেখ মুজিবুর রহমান
২৬ মার্চ ১৯৭১
মূল ঘোষণাটা ইংরেজিতে ছিলো; জহুর আহমদ চৌধুরীর পারিবারিক সংগ্রহশালায় সেটি সংরক্ষিত আছে। ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার (স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র) থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এম.এ. হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী স্বকণ্ঠে প্রচার করেন।
প্রায় ১০ মিনিটের সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানটি প্রচার শুরু হয় বেলা প্রায় দুইটায়। রাখাল চন্দ্র বণিক ঘোষণা করেন “চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র। একটি বিশেষ ঘোষণা, একটু পরেই জাতির উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের বিপ্লবী সাধারণ সম্পাদক জনাব এম এ হান্নান। আপনারা যাঁরা রেডিও খুলে বসে আছেন তাঁরা রেডিও বন্ধ করবেন না”। বেতার কেন্দ্রের নাম ‘চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র’ ছাড়াও ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ বলেও উল্লেখ করেছিলেন রাখাল চন্দ্র বণিক।
এভাবে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক স্বাধীনতা ঘোষণা দেশে বিদেশে প্রচারের জন্য বেতারে সর্বপ্রথম প্রচারের গৌরব অর্জন করেন সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা এম এ হান্নান।
শুরু হলো স্বাধীনতার মরণপণ যুদ্ধ। এ দিকে আমি হারিয়েছি আমার ভাইকে। আমার ভাই শহীদ মাহবুব আহমদ চৌধুরী ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক। নির্মম নিপীড়ন, অবিশ্বাস্য ব্যাপক নরহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে বহুকালের পুঞ্জীভূত ও বিক্ষোভকে দমন করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতে আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে এদেশের লক্ষ কোটি বঞ্চিত, শোষিত ও বিক্ষুব্ধ মানুষের ওপর। আর সেটাই ছিল ইতিহাসের গতিরুদ্ধ করার পাকিস্তানীদের ব্যর্থ প্রয়াস ও অবান্তর দুর্ভিলাষ। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে মানব সভ্যতাকে কালিমা লিপ্ত করে অপারেশন জেনোসাইডের মাধ্যমে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করে পাকিস্তানী শাসক শ্রেণী।
দেশে শুরু হলো স্বতঃস্ফুর্ত এক জনযুদ্ধ। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পর্যুদস্ত পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী যুদ্ধ বিরতির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেককোর্স ময়দানে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। এ সময় পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে দলিলে স্বাক্ষর করেন আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। এ দিনের মাধ্যমে নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান হয়। ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত আভ্রুর বিনিময়ে বিশ্বের ইতিহাসে রক্তিম সূর্যের আভা ছড়িয়ে জেগে উঠে এক নতুন দেশ। যার নাম “বাংলাদেশ”।
স্বাধীনতার সুবর্র্ণ জয়ন্তীর এ সময়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এ সময়কালে বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য উত্থান হয়েছে, যা অভূতপূর্ব ও বিস্ময়কর। বিগত দশকে বাংলাদেশের সাফল্যগাথা নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে বোধ হয় কোনো স্বল্পোন্নত দেশ বা উন্নয়নশীল দেশ নিয়ে এতো হয়নি। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০২০ সালে বাংলাদেশ মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে সমুদ্রসীমা জয় করেছে বাংলাদেশ। এ জয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ তাঁর শক্ত অবস্থান তুলে ধরেছে। বাঙালির স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান, ২০২১ সালের মধ্যে এর নির্মাণ কাজ শেষ হবে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ৩.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলের নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে। ২০২২ এর শেষে এটির নির্মাণ কাজ শেষ হবে। ঢাকা শহরের উত্তরা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রো রেলের কাজ চলছে যা ২০২১ এর মধ্যে শেষ হবে। পটুয়াখালীতে দেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দর পায়রা বন্দর অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কঙবাজারের মাতার বাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ। ২০২২ এর পর দেশের অগ্রযাত্রায় এক বিপ্লব সাধিত হবে। সকল কর্মযজ্ঞ এক প্রকার দৃষ্টিসীমায় এসে যাবে। সে সময় বাংলার উন্নয়নের প্রকৃত চিত্র জনগণের দৃষ্টিগোচর হবে।
বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে ১০০ বছর মেয়াদি ডেল্টা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। সরকার পাঁচটি প্রাধিকার বিষয়ে পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। অর্থনৈতিক স্থীতিশীলতা বজায় রাখা ও দ্রব্যেমূল্যের উর্ধ্বগতির ওপর নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ, তেল, গ্যাস, কয়লা, জ্বালানীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিশ্চিতকরণ, দারিদ্র ও অসমতা দূরীকরণ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ডিজিটাল বাংলাদেশ, মানব সম্পদ উন্নয়ন, তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ, শিল্পের প্রসার, নাগরিকের সংযুক্তি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় ও ক্যারেশমেটিক সাহসী নেতৃত্বের কারণে ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয় অতি বাস্তবতা। সরকারের এবং দেশের উন্নয়নের অগ্রগতি এবং দৃশ্যমান পদ্মাসেতু দেখলে আমরা আরো সাহস পাই। গর্বে আমাদের বুক ভরে যায়। ভেতর থেকে আওয়াজ ওঠে “আমরাও পারি করে দেখাতে, আমরাও পারব করোনাকে জয় করতে”।
এত এত কিছু প্রাপ্তির ভিড়ে কিছু প্রত্যাশা রয়েছে আমাদের। এদেশের লাল সবুজ পতাকাটির সাথে রয়েছে আমার পরিবারের রক্ত। সুতরাং এদেশে আমার প্রত্যশার অনেক অনেক বেশি স্বাধীনতার সুবর্র্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে আমি প্রত্যাশা করি এবং স্বপ্ন দেখি দারিদ্রমুক্ত এক বাংলাদেশের, স্বপ্ন দেখি এমন একটি নিরাপদ দেশের যেখানে কোন নারীকে হতে হবেনা ধর্ষিতা, স্বপ্ন দেখি নিরাপদ সড়কের, যে সড়কে ঝরবেনা কোন নিরীহ মানুষের প্রাণ।
আমাদের বর্তমান বিশ্ব বিষাক্তময় ২০২০ সাল অতিক্রান্ত করেছে। ২০২১ এর এ সময়ে স্বাধীনতার সুবর্র্ণ জয়ন্তীতে বলতে চাই, অতীতের সকল প্রকার গ্লানি ভুলে নতুনকে ঘিরে আমাদের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। সুখ, শান্তি আর সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক দেশ। সকল অন্যায় অবিচার ধর্মীয় উগ্রতাকে পদদলিত করে নতুন স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলার প্রত্যাশা নিয়ে আমরা গড়ে তুলবো নতুন একটি দেশ, তারই নাম স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদক : শিল্পশৈলী

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাঙালি জাতির জনক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর যথার্থতা
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে