স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ

প্রফেসর সালমা রহমান | শনিবার , ৬ মার্চ, ২০২১ at ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ

জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হল-গত ২২ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (ইউএন-সিডিপি) সভা শুরু হয় নিউইয়র্কে, ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে এই কমিটির ত্রিবার্ষিক সভায় বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকাভুক্ত করতে চূড়ান্ত সুপারিশের সিদ্ধান্ত নেয়। এই উত্তরণ ঘটল এমন এক সময়ে যখন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে এবং জাতি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের জন্য প্রস্তুত। এটি সমগ্র জাতির জন্য এক মহা গৌরবময় অর্জন। ইউএন- সিডিপির নিয়মানুযায়ী এলডিসি থেকে বের হতে দুটি ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে নির্দিষ্ট মান অর্জন করতে হয়। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ননীতি সংক্রান্ত কমিটি ২০১৮ সালের ১৫ মার্চ প্রথম মূল্যায়নে এলডিসি থেকে উত্তরণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। উন্নয়নশীল দেশের ক্যাটাগরিতে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ সূচক এবং অর্থনেতিক ভঙ্গুরতা সূচক এই তিনটি সূচকের যেকোন দুটি অর্জন করা আবশ্যকীয় শর্ত, বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদণ্ডই পূরণ করেছে। জাতিসংঘের মানদণ্ড অনুযায়ী গড় মাথাপিছু আয় প্রয়োজন ১২৩০ মার্কিন ডলার, ঐ সময়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১৯০৯-মানব সম্পদ সূচক প্রয়োজন ৬৬,আমাদের দেশের অর্জন ছিল ৭২.৯ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা থাকতে হয় ৩২ বা তারচেয়ে কম, বাংলাদেশের ছিল ২৪.৮।
২০২১ সালে জাতিসংঘ যখন চূড়ান্ত সুপারিশ করল তখন বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয় ২০৬৪ মার্কিন ডলার, মানব সম্পদ সূচক ৭৫.৪, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা ২৭। তিনটি নির্দিষ্ট সূচকের বাইরে করোনার প্রভাবও বিবেচনা করা হয়েছে,সেদিক থেকেও বাংলাদেশের অবস্থান অনেক ভাল। করোনার কারণে যখন বিশ্বব্যাপী তীব্র মন্দা চলছে তখন বাংলাদেশ সফলভাবে সংকট মোকাবেলা করেছে। করোনার সময়ে সবচেয়ে বেশি সহায়তা পাওয়া গেছে কৃষক ও প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে। কৃষক কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রেখে খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করেছে এবং ঐ সময়ে প্রবাসী শ্রমিকেরা রেকর্ড পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। এছাড়া সরকার ঘোষিত বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা প্যাকেজ, একই সাথে জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে ঝুঁকি নিয়ে উৎপাদন প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়াসহ নানামুখী উদ্যোগ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সাহায্য করেছিল। এ বছরের প্রথমে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ বলেছিল, “কোভিড-১৯ মহামারি সত্ত্বেও ২০২০ সালে বাংলাদেশ সংকোচনের হাত থেকে বাঁচতে পেরেছিল। অর্থনৈতিক গতি বাড়াতে সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিল, ফলে অর্থনীতির চাকা সচল ছিল।” মহামারি সত্ত্বেও ২০১৯-২০ অর্থ বছরে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫.২৪ শতাংশ। বাংলাদেশের অগ্রগতি এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেছে যেকোন সংকটই মোকাবেলা করতে পারবে।
উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের বিষয়টি যেমন গৌরবের তেমনি রয়েছে সংকট, ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ। কারণ এলডিসি হিসাবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যে সকল সুবিধা ভোগ করত স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেসব বাতিল হবে। তবে ইইউতে জিএসপির আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধা আরও তিন বছর থাকবে। ২০২৬ সালের পর বিশ্ববাজারে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা না পাওয়ায় রপ্তানি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়তে পারে তৈরি পোশাক খাতে। তবে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, যথাযথ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বন্দরের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি ও সুষ্ঠু নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি খাতের নিশ্চয়তা পেলে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মত বাংলাদেশও প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে পারবে। ওষুধ শিল্পসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব আইন কড়াকড়ি হবে, এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে অর্থনীতিতে প্রতিকূল প্রভাব পড়বে। কৃষিতে ভর্তুকি ও নতুন শিল্পকে সহযোগিতা দেয়া সীমিত করতে হবে, ফলে কৃষি ও শিল্প উভয় খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার জন্য রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ে নগদ সহায়তা দেয়া হয়, এসব ক্ষেত্রে আপত্তি উঠতে পারে। উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে অনুদান ও সহজ শর্তে লোন প্রাপ্তি আস্তে আস্তে কমে যাবে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষাবৃত্তির সংখ্যা কমবে। এছাড়া জাতিসংঘে বাড়বে চাঁদার পরিমাণ। গত বছর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও ) বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে বাড়তি শুল্ক চাপে পড়ে রপ্তানি আয় কমবে সে ব্যাপারে তথ্য প্রকাশ করে। ডব্লিউটিওর হিসেব অনুযায়ী ৪৮৪ কোটি ডলারের পোশাক,১৮ কোটি ডলারের বস্ত্র, ১৬ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ১ কোটি ডলারের মাছ ও হিমায়িত পণ্য রপ্তানি কমে যেতে পারে। শূন্য শুল্ক সুবিধা বাতিল হয়ে সম্ভাব্য বাড়তি শুল্ক আরোপ করবে কানাডা ১৮ শতাংশ, চীন ১৩ শতাংশ, কোরিয়া ১২ শতাংশ, জাপান ১১ শতাংশ, ইইউ ১০ শতাংশ, ভারত ১০ শতাংশ।
অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ায় যেসব সুবিধা আসবে সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাওয়া যাবে না, সেজন্য আমদানি-রপ্তানি নীতি, আর্থিক নীতি, অন্যান্য নীতির মধ্যে সামঞ্জস্য করতে হবে। মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার অব্যাহত রাখা ,মানব সম্পদ উন্নয়ন, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ,নারীর প্রতি সকল বৈষম্য কমানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। করোনার কারণে বিশ্ব জুড়ে মন্দা চলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা উপযোগী কৌশল গ্রহণ করতে হবে। উত্তরণ হলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে, তৈরি করতে হবে উপযুক্ত পরিবেশ। পর্যটন খাতে আয় বাড়ার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। প্রয়োজন হবে শ্রম পরিবেশের উন্নতি, ব্যবসা সূচকে উন্নতি, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোসহ নানা উদ্যোগ। কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করতে কাজের ন্যূনতম মজুরি, কাজের পরিবেশ, শ্রম ব্যবস্থাপনা, শ্রমিকের দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ এবং মাতৃত্বজনিত ছুটিসহ সুযোগ সুবিধা বাড়াতে হবে। ব্যবসায়ের খরচ কমালে ব্যবসা সূচকে উন্নতি হবে। প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে- এর কোন বিকল্প নেই। সম্প্রতি বাংলাদেশ বৈশ্বিক টেকসই প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে, তবে এখনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে- এদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এগুলোর পাশাপাশি বর্তমান বিশ্ব উন্নয়নে দুটি বিষয় খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে-প্রথমত: জাতীয় উন্নয়ন কতটুকু অন্তর্ভুক্তিমূলক হচ্ছে অর্থাৎ আর্থ- সামাজিক ও প্রথাগত বৈষম্য কমছে কী না। দ্বিতীয়ত: উন্নয়ন পরিপূরক সুশাসন রাষ্ট্র নিশ্চিত করছে কী না- অর্থাৎ নাগরিক অধিকার তথা মানবাধিকার রক্ষা হচ্ছে কী না। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে এগোতে হবে। তবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি আজ বিশ্বে রোল মডেল হিসাবে দেখা হচ্ছে। আমরা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই এমডিজি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, চমকপ্রদভাবে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি সহ নানা অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়েছে আশা করা যায় উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সকল শর্ত পূরণে সক্ষম হবে। পদ্মা সেতু, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরো গতিশীল করবে। এছাড়া সরকারকে উত্তরণকালীন কৌশলপত্র এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, ১০০ বছর মেয়াদী ডেল্টা পরিকল্পনা, জলবায়ু, প্রযুক্তি ও মানব সম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো যায়। আশা করা যায় সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করলে বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বে জায়গা করে নিবে।

লেখক : প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্ব নারী দিবস ও আমাদের নারীদের অবস্থান
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে