বিশ্ব নারী দিবস ও আমাদের নারীদের অবস্থান

করবী চৌধুরী | শনিবার , ৬ মার্চ, ২০২১ at ৫:৩৬ পূর্বাহ্ণ

১১২ বছর হয়ে গেল পৃথিবীজুড়ে ‘বিশ্ব নারী দিবস’ পালনের। অথচ যেই উদ্দেশ্য নিয়ে ‘নারী দিবস’ এর জন্ম, আমাদের দেশে সেই উদ্দেশ্য কতটা সফল হয়েছে, তা যথেষ্ট প্রশ্নের সম্মুখীন। ‘প্রজন্ম হোক সমতার; সকল নারীর অধিকার’… জাতিসংঘের এবারের প্রতিপাদ্য কতখানি বাস্তব কিংবা আমাদের দেশের অতীত ও বর্তমান সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রতিপাদ্যের বাস্তবায়ন কতখানি সম্ভব, ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে স্বাভাবিক কারণেই মনে অনেক প্রশ্ন উঠে আসাটা মোটেও অবান্তর নয়।
প্রথমেই ফিরে দেখা যাক, ‘বিশ্ব নারী দিবস’ উদযাপনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এই দিবস উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ সালে মজুরি বৈষম্য, কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশ, ইত্যাদি অন্যায়ের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে যুক্তরাষ্ট্রের সুতা কারখানার নারীশ্রমিকেরা নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন। মিছিল চলাকালীন চলে সরকারি লেঠেলবাহিনীর নিষ্ঠুর দমনপীড়ন। এর প্রতিবাদে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক নারীসংগঠনের পক্ষ থেকে এক আন্তর্জাতিক নারী সমাবেশের আয়োজন করা হয়, যার নেতৃত্ব দেন জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন। এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। এতে ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারীনেত্রী যোগ দিয়েছিলেন। এই সম্মেলনেই ক্লারা প্রস্তাব দেন, প্রতিবছর ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে পালন করার। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, ১৯১১ সাল থেকেই ‘নারীদের সমঅধিকার দিবস’ হিসেবে দিনটি পালিত হবে। ১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ‘নারীদের সমঅধিকার দিবস’ হিসেবে দিনটি পালিত হতে লাগলো।
তারপর অনেক দাবি-আন্দোলনের পথ পেরিয়ে ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয় এবং তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন রাষ্ট্রকে এই দিবসটি পালনের জন্য আহবানও জানানো হয়। তারপর থেকেই সারা পৃথিবীসহ আমাদের দেশেও নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় ও প্রত্যাশা নিয়ে পালিত হচ্ছে ‘নারী দিবস’। ‘বিশ্ব নারী দিবস’ জন্মের ইতিহাস বিবেচনা করে আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটকে বিচার করলে দেখা যায়, বর্তমানের নারী এখন শিক্ষা-দীক্ষায়, কর্মক্ষেত্রে কিছুটা বৈষম্য ঘোচাতে পারলেও সামাজিক ক্ষেত্রে কিন্তু আমাদের নারীদের অবস্থান আজও বড় সড় এক প্রশ্নের সম্মুখীন। আমাদের সমাজে এখনো সিংহভাগ মানুষের কাছে নারী শুধুই একটা শরীর, সন্তান জন্মদানের একটা মেশিন মাত্র। সে অজ পাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত গরীব মানুষের কাছেই হোক কিংবা শহুরে শিক্ষিত ধনীর কাছেই হোক।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে আমাদের দেশের নারীরা এখনো ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার। শিক্ষা, প্রযুক্তি, কারিগরি, অর্থনীতিতে তথাকথিত আধুনিকতার জয়ধ্বজা ওড়ানো হলেও সামাজিক মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে বাংলাদেশ এখন বহু যুগ পিছিয়ে আছে। এদেশে নারীরা এখনো অনেকক্ষেত্রেই অনাকাঙ্ক্ষিত ও অবাঞ্ছিত।
নারীদের মানসিক ও শারিরীকভাবে এখনো পুরুষদের চেয়ে দুর্বল ভাবা হয়। দেশে শিক্ষিত নারীর সংখ্যা মাত্র ২৬ শতাংশ। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, নারী-পুরুষের বৈষম্য, আর্থিক সমস্যা ইত্যাদি পেরিয়ে খুব কম নারীই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে। এছাড়া গ্রামের অধিকাংশ মেয়েরই অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সংসার সামলিয়ে তারা কোন কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে পারে না। এদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান এখনো পুরুষদের অনেকটাই পেছনে।
‘শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো’ (ব্যানবেইস)র ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রাথমিকস্তরে শিক্ষার হার সন্তোষজনক হলেও উচ্চমাধ্যমিক থেকে মেয়েদের পেছানো শুরু হয়। তারপর উচ্চশিক্ষা আর পেশাগতশিক্ষার স্তরে নারীর সংখ্যা ধপ্‌ করে পড়ে যাচ্ছে। ‘ব্যানবেইস’ এর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মেয়েরা মাত্র এক তৃতীয়াংশের কিছু বেশি। অবশ্য চিকিৎসা ও আইন সহ কিছু পেশাগত শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের হার সামান্য বেশি। কর্মক্ষেত্রে একজন নারীকে এখনো পুরুষের তুলনায় ৩০০ মিনিট বেশি কাজ করতে হয় অথচ সেই তুলনায় অনেক সংগঠিত-অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে বেতনের পরিমাণ নারীদের অনেক কম।
রাশিয়া, কিউবা, ভিয়েতনাম প্রভৃতি অনেক সমাজতান্ত্রিক দেশে এই দিনটি সরকারি ছুটি হিসেবে পালিত হয়, আবার চীন, নেপাল প্রভৃতি দেশে কেবল নারীরা এই ছুটি ভোগ করে। আর বাংলাদেশে এই দুই ব্যবস্থার কোনটিই নেই। শুধুমাত্র র‌্যালি, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমেই দিনটি সীমাবদ্ধ রয়েছে। একটা শিশুর বেড়ে ওঠার প্রথম স্থান হলো তার পরিবার। এখনো পরিবারগুলোতে সন্তান লালনপালন হয়না। হয় পুত্র বা কন্যা লালন-পালন। পরিবারে একটা পুত্র সন্তান যে পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা আর ভালোবাসা নিয়ে বড় হয়, কন্যাদের ক্ষেত্রে তার সিকিভাগও হয়না। গ্রামাঞ্চলের পরিবারগুলোতে তারা বড় হয় বিভিন্ন অনুশাসন, প্রতিবন্ধকতা, তাচ্ছিল্য ইত্যাদি নিয়ে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকলপ্রকার মৌলিক অধিকার থেকে তারা হয় বঞ্চিত।
ফলে সন্তানের সর্বোচ্চ আশ্রয়টিই হয়ে ওঠে মেয়েদের জন্য বৈষম্যের আঁতুড়ঘর। এখানে নারীরা এখনো শিকার হচ্ছে যৌতুক, এসিডনিক্ষেপ, ধর্ষণ, অপহরণসহ বিভিন্ন ঘৃণ্য অপরাধের। কিছুকিছু ক্ষেত্রে এসবের বিচার হলেও বেশিরভাগ অপরাধীই আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যায়। নারীর প্রতি সহিংসতার হার আমাদের দেশে উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। বিগত বছরগুলোতে নারী লাঞ্ছনা ও ধর্ষণের পরিসংখ্যান দেখলে রীতিমতো ঘাবড়ে যেতে হয়। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ১৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জন নারীকে। অথচ ২০১৮ সালে এর সংখ্যা ছিল ৭২৩ জন। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এই ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ! আর ২০১৭ সালে এর সংখ্যা ছিল ৮১৮ জন। এমনকি এই করোনার সময়েও নারীর প্রতি সহিংসতার এতটুকু কমতি নেই। বেসরকারি সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ তাদের এক জরিপে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের এক তথ্য তুলে ধরেছে। তারা বলেছে, এই মাসেই ২৭টি জেলায় ২৪৯ জন নারী ও ৪৫৬ জন শিশু পারিবারিক সহিংসতার শিকার বাল্যবিবাহ হয়েছে ৩৩টি। জরিপের তথ্য অনুযায়ী স্বামীর হাতে শারীরিক নির্যাতিত ৮৪৮ জন। মানসিক নির্যাতিত ২০০৮ জন। যৌন নির্যাতিত ৮৫ জন। শিশু ধর্ষণের শিকার ১৪ জন। ধর্ষণের শিকার নারী ২০ জন। মাত্র ২৭টি জেলায় একমাসে যদি নারী নির্যাতনের এই সংখ্যা হয়, তাহলে সারাদেশে, সারা বছরের এই নারী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র মেলে। নারীদের প্রতি পাশবিক অত্যাচারের ক্ষেত্রে ২ বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধা, কেউই ছাড় পায় না। ১১২ বছর ধরে ‘নারী দিবস’ পালন, ৪৩ বছরের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, এগুলো কি শুধু সংখ্যা হয়েই থাকবে? নাকি সত্যি সত্যিই কোনদিন নারীর সম অধিকার সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হবে? একটাই শুধু প্রশ্ন, নারীর সার্বিক অবস্থানের উন্নতি ঘটবে কবে? কবে নারীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে? মূলত ‘নারী দিবস’ পালনের সার্থকতা সেদিনই আসবে, যেদিন রাস্তাঘাট, ঘরে বাইরে আর কোন শিশুকন্যা, কিশোরী, যুবতী বা পৌঢ়াকে দেখে কোন পুরুষের নোংরামি করার ইচ্ছে জাগবে না।
‘নারী দিবস’ পালনের সার্থকতা সেদিনই আসবে যেদিন ‘stop rape’ শিরোনামে কোন সামাজিক মাধ্যমে শ্লোগান তুলতে হবে না। ‘নারী দিবস’ সেদিনই সার্থকতা পাবে, যেদিন মেয়েদের শিক্ষায় তাদের পরিবারের জন্য সরকারের তরফ থেকে আলাদা কোন প্রকল্পের প্রয়োজন হবে না। পরিশেষে এটাই বলতে চাই, আমাদের সমাজের দৃষ্টিতে একজন নারী যেদিন শুধু মেয়ে মানুষ না হয়ে পরিপূর্ণ একজন মানুষ হিসেবে পরিগণিত হবে, সেদিনই হবে ‘নারী দিবস’ পালনের প্রকৃত সার্থকতা।
লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধডিজিটাল যুগেও অসহায় মানুষ!
পরবর্তী নিবন্ধস্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ