গত শতকে বাংলাদেশের ছোটগল্প দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে অবলম্বন কওে ছোটগল্পের ধারাটিকে অধিকতর বিকাশ ও বৈচিত্র্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। এ–শতকের দু’টি দশক পাড়ি দিতে গিয়ে বেশ ক’জন আধুনিক জীবনবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছোটগল্পকারদের সরব উপস্থিতি আমরা লক্ষ করি। তাঁদের মধ্যে– ভাষার কাব্যময়তা, বর্ণনার আত্মবিশ্লেষণ ও বাক্যবিন্যাসের শিল্পিত মাধুর্যের সমন্বয় থাকায় বিশ্বজিৎ চৌধুরী (জন্ম:১৯৬০) একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছেন। মানব মনের উত্তাপ ও সময়ের নিবিড় সম্পৃক্ততা, ক্রমসঞ্চারণশীল শৈল্পিক প্রকাশরীতির কারণে তার গল্প সুপাঠ্য এবং অবশ্যপাঠ্য– এর মর্যাদা লাভ করেছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো আর সবচেয়ে নতুন বিষয় প্রেম। যে–কোনো বয়সের পাঠক প্রেমের গল্পে বুঁদ হয়ে থাকে। বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রেমের গল্প’ বইটি তাই সব বয়সের পাঠকের কাছে প্রিয়তা লাভ করেছে, এ–কথা বলাই বাহুল্য।
‘স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রেমের গল্প’ গল্পগ্রন্থটি ২০১৩ সালে প্রকাশিত। গল্পগ্রন্থে ১৪টি স্বল্পপরিসরের গল্প স্থান পেয়েছে। লেখকের দ্রুত গল্প বলার প্রবণতা গল্পগুলোকে আকৃতিগতভাবে ‘ক্ষুদ্র’ করলেও প্রতিটি গল্পের পটভূমিকায় রয়েছে অনন্য জীবনশৈলী। গত শতকের নব্বই এর দশকের নস্টালজিক সময়, এ–শতকের প্রথম দশকের বিক্ষুব্ধ আলোড়ন, তরুণদের জীবনে প্রযুক্তির উত্থান –তার গল্পের ভাবস্বর ও প্রধান অবলম্বন। বাংলা ছোটগল্পের যে শ্রেণিভিত্তিক আশ্রয় তা সহজেই পাশ কাটিয়ে, জীবনরূপকে তরুণ পাঠকের কাছে উদ্ভাসিত করার লক্ষ্যে এ–গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো নিরীক্ষাধর্মীতার চূড়ান্ত রূপ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
গল্পগুলোর পরিবেশ ও ব্যবহৃত স্থান আমাদের পরিচিত। রাজধানীকেন্দ্রিক গল্পে আমরা আঞ্চলিক পাঠকেরা অভ্যস্ত হলেও যখন গল্পের পটভূমিকায় পলোগ্রাউন্ডের রেলওয়ে স্টাফ কোয়ার্টারে দৃশ্য চিত্রিত হয়, তখন ভালোলাগার অনন্য এক আবেগ তৈরি হয়। ‘এমনি করিয়া….. ’ গল্পের টুকটুকি’কে সেজন্য আমাদের অতি আপন মনে হয়। প্রথম প্রেম কখনও মুছে যায় না। চিরন্তন এই গল্প ‘এমনি করিয়া…. ’ গল্পের কেন্দ্রীয় বলয়। ছেলেবেলার প্রেম এ–গল্পের মূল প্রেরণা। গল্পের শেষে টুকটুকি–শাহজাহানের মিলন গল্পটিকে একটি মিষ্টি প্রেমের গল্পে পরিণত করে। আর আমরা দেখি একজন পরিণত লেখকের জীবনের নভোচারী ভঙ্গি।
বিশ্বজিৎ চৌধুরীর গল্পে প্রবাদ বাক্য, বাগধারা, প্রবচনকে নিজের মতো করে বলার সতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সহজে পাঠকের দৃষ্টিগোচর হয়। পাঠক কিছুটা কৌতূহলে আবিষ্ট হয়– কেননা নির্মল আনন্দ লাভই উন্মীলিত এখানে। ‘দুঃখিত’ গল্পের ফারহানা আর ‘লীলাবসান’ গল্পের জিনাতের মধ্যে সাধারণ একটি মিল রয়েছে। লেখকের ভাষায়-‘ আমার ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা ঘেঁটে এমন একটি মুখেরও সন্ধান পাই না, জিনাতের চেয়ে যা সুন্দর।’ আবার– ‘আমি তো মেয়েদের চোখের দিকে তাকাতে পারি না, তবু কৌশলে লক্ষ্য করে দেখলাম, কথাটা ঠিক, মেয়েটি অসম্ভব সুন্দরী’। দু’গল্পের অন্য একটি বিষয়ের চমৎকার মিল আছে। নায়ক ‘আমি’ দু’গল্পেই নায়িকার গৃহশিক্ষক। দু’জনই প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকে। ‘লীলাবসান’ গল্পে অনেক ট্রাজেডির পর মিলন হলেও ‘দুঃখিত’ গল্প অসমাপ্তই থেকে যায়। ফারহানার ‘না’ বালাটা পাঠক হৃদয়ে মর্মমূলে স্পর্শ করে। প্রেম ও বিরহের এমন মিলন বাংলা ছোটগল্পের ক্ষেত্রে বেশি ঘটেনি।
বর্ণনাধর্মী জীবনের প্রবহমানাতার ইঙ্গিতবাহী বিশেষ আবেদনাশ্রয়ী গল্প– ‘আমি কেন আর হাত দেখি না’ এ গল্পেরও কথক ‘আমি’। প্রেমের গল্প যেহেতু অবশ্যই নায়িকা আছে। লীলা আর থার্ড ইয়ারের গল্পের কথকের প্রেম হাত দেখাকে কেন্দ্র করে। এ গল্পের বুনন অসাধারণ। অতি স্বল্প দৈর্ঘ্যের গল্প হলেও, গল্পের শেষে রেশ রয়ে যায় অনেকক্ষণ। শেষটা এরকম–
“সেই থেকে আমি আর কারো হাত দেখি না, ক্লাস শেষে লীলার সাথে কেন্টিনে যাই, বিকালে অডিটোরিয়ামের সামনে নিরিবিলি জায়গাটাতে দু’জনে বসে বাদাম চিবোই। সন্ধায় ও হোস্টেলে ফিরে গেলে পরের দিনটার জন্য অপেক্ষা করি।’’
যেনো গল্পের আড়ালে একটি প্রেমের কবিতা পড়াছি। নিবিড় ভালোলাগা থেকেই মনে হয় একরকম বোধের সৃষ্টি হয়। প্রেম ও আশার চিরায়ত সুরটি ধ্বনিত এ–গল্পের দৃশ্যপটে।
আলোচ্য গ্রন্থের প্রতিটি গল্পে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছবি আছে। কিছু দঃখের, কিছু সুখের, প্রেম মানেইতো সুখ–দুঃখের মিশ্রণ। দুঃখের চিত্র অল্পই, সচল জীবনধারার একটি লয় গল্পের আবহে ক্রিয়াশীল। জীবনের মমতার বন্ধন এখানে গাঢ়ভাবে উচ্চারিত। যেমনটা আমরা দেখি-‘আকাশে শুধু একটি ঘুড়ি’ গল্পের নায়ক শাহেদের মধ্যে। ডাক্তার–রোগীর প্রেম, যার পটভূমিকায় বন্ধুর দুষ্টু বুদ্ধি। অন্যসব গল্পের মতো এ– গল্পের নায়িকাও রীতিমতো সুন্দরী। গল্পের লেখকের ভাষায়-‘পড়ন্ত বিকেলে এমন রূপ কী এক বিভ্রম তৈরি করে।’ মিলনাত্মক এ–গল্পের শেষেও পাঠক এক অপার্থিব অনুভব নিয়ে অপেক্ষা করে। বর্ণনা আর সংলাপ সৃজনে বিশ্বজিৎ চৌধুরীর নিজস্ব কাব্যিক স্টাইল এ–গল্পের আরেক বৈশিষ্ট্য। সাধারণ শব্দ ব্যবহার করেও যে পরিবেশ এবং চরিত্রের একটি অন্তরঙ্গ পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব-‘আকাশে শুধু একটি ঘুড়ি’তে তার চমৎকার উদাহরণ আছে।
গত শতকের কোনো প্রেমের গল্পে– ক্রাশ, ব্রেকআপ শব্দগুলো খুঁজে পাওয়ার কথা না। ‘মনোরোগ’ গল্পে যখন শব্দগুলো পাঠক লক্ষ করে, তখন এ–শতকের পাঠকরা গল্পটিকে সহজেই আপন করে নেবে। অন্যরা ‘কি ব্যাপার ……’ বলে এড়িয়ে যাবে। তবে যাই হোক, গল্প বলার গতিশীলতাও এ–গল্পে বেশ উপস্থিত। রানু আর মোহিত স্যারের প্রেমের এ–গল্প এতো দ্রুত এগিয়ে যায়– পাঠক এক নিমিষে পড়ে শেষ করে গল্পের বুনন দেখে একরাশ তৃপ্তি নিয়ে বসে থাকবে কিছুক্ষণ।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী এ–সময়ের পাঠকের জীবনের রূপকার, গল্প বলার প্রথাসিদ্ধ নিয়মকে ভেঙ্গে নিজের মতো করে আমাদের গল্প আমাদেরকেই শুনিয়েছেন। সময়কে উপস্থাপন করেছে গল্পের প্রয়োজনে। চরিত্রের অনিবার্যতা এসেছে ভাষার প্রবাহে।
‘স্বল্প দৈর্ঘ্য প্রেমের গল্প’ বই এর সবচেয়ে বড় সার্থকতা হলো, এখানের ১৪টি গল্পের যে কোনো একটিতে আপনি নিজেকে খুঁেজ পাবেন। নায়ক কিংবা নায়িকার ছায়ায় অথবা ব্যর্থ প্রেমিকের দীর্ঘশ্বাসে। গ্রন্থের শেষের দু’টি গল্প-‘বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল’ ও ‘যে আঁখিতে’ অন্য গল্পগুলোর চেয়ে আকারে কিছুটা বড়। আর প্রেম এখানে প্রধান উপজীব্য। গল্পের নীলু আপা কিংবা আঁখি আমাদেরকে স্মৃতির বুদ বুদ বাষ্পে বিমোহিত করে। আউটার স্টেডিয়ামের দারুল কাবাবে যখন শাহীন ভাই আর রূপা বসে থাকে, তখন আমাদেরও সমনে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে কবে। নিজেদের পরিচিত জগৎ দেখার আপার আনন্দ নিয়ে আমরা বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টোই।
বিশ্বজিৎ চৌধুরীর গল্পের চমকপ্রদ বর্ণনা, গল্পের গতিবেগ এবং প্রেমকে আধুনিক পটভূমিতে উপস্থাপন– দর্শকচিত্তে যে আবেদন জাগায় তা সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে দুর্লভ। প্রেম, ঈর্ষা, ভালোবাসার মানবাত্মার চিরন্তন প্রকাশ– ‘স্বল্প দৈর্ঘ্য প্রেমের গল্প’। ‘গাঁইয়া’ গল্পে আমরা রূপবতী নায়িকার খোঁজ পাই নাম– রূমকি, কথক ‘আমি’ আমাদের অন্য গল্পের মতই নায়িকার সৌন্দর্য জানাচ্ছে ‘‘এ–লেভেলের ছাত্রীটি ঘরে স্কার্ট টপস অথবা হাঁটু দৈর্ঘ্যের জিনসের ট্রাউজার আর স্লিভলেস টিশার্ট পরে থাকে। বাদামি কটা চোখ, গোলগাল ফরসা মুখ আর পিঠ পযর্ন্ত সোজা ঝরঝরে চুল সব মিলিয়ে একটা আদুরে বেড়ালের মতো।’’ এ গল্পের নায়কও মেডিকেল কলেজের ছাত্র। গ্রামের ছেলের সাথে শহরের এ–লেভেলের ছাত্রীর প্রেম। চমৎকার কিছু অনুষঙ্গ গল্পকে মুগ্ধতার পর্যায়ে নিয়ে যায়। সাধারণ পটভূমিকায় একটি অনন্য প্রেমের গল্পের ফাঁদ– একজন দক্ষ লেখকের বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য।
স্বাভাবিকভাবে এ–বইয়ের প্রতিটি গল্পের সমান্তরালে আমরা একজন কবিকে খুঁজে পাই, ফলত কাব্যিক সৌন্দর্য এ–গ্রন্থের প্রতিটি গল্পের অলংকার। বিশ্বজিৎ চৌধুরীর গল্প পাঠে এ–অনুভুতি হয় যে– আধুনিক সময় এবং বর্তমান প্রজন্মের মননের পরিচয় এত বিবৃত। সমসাময়িক মানুষের জীবনের প্রেমের মাত্রাবহুল বৈচিত্র্য তার গল্পের বিষয়কে একটি বিশেষ প্রাপ্তিতে প্রদীপ্ত করেছে। বিশ্বজিৎ চৌধুরীর শিল্পচেতনার ক্রমবিকাশের ধারা প্রনিধানযোগ্য–বাস্তব বা অবাস্তব পৃথিবী থেকে উর্ত্তীণ হয়ে জীবনের সহজ সরল গতিপথ খুঁজে নেওয়ার তৎপরতা বেশ সূক্ষ্মভাবে উপসথাপিত। ছোট পরিসরে হলেও প্রতিটি গল্পে লেখক ক্রমান্বয়ে গভীরতার স্বাদ দিয়েছেন। এ সমৃদ্ধি জীবনকে অনুভব করার প্রবণতাকে প্রয়াসী করে। বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রেমে অবিষ্ট কিন্তু চলমান জীবনের মেঘাচ্ছন্ন পৃথিবীর অধিবাসী।