স্বপ্ন ছিল স্বনির্ভর হওয়ার

স্বজনদের আহাজারি থামছেই না

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৪:৩৬ পূর্বাহ্ণ

কম্পিউটার সায়েন্সের প্রথম সেমিস্টারের ছাত্রী সাদিয়ার স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। তার বাবা মোহাম্মদ আলী মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করলেও সাদিয়ার এক কথা, আগে স্বপ্ন পূরণ করব, নিজের পায়ে দাঁড়াব। তারপর বিয়ে বা অন্যকিছু। গতকাল বিকেলে সাদিয়াদের হালিশহরের বাসায় গিয়ে স্বজনদের কাছে জানা যায় তার স্বপ্নের কথা; স্বপ্নভঙ্গের কথা। ঘরের সর্বত্র সাদিয়া-কোথাও তার আঁকা ছবি, কোথাও হাতের কাজের নকশা। ছবি আর নকশাগুলো তার হয়ে যেন বলছে, ‘যখন আমি থাকব না আর, আমায় রেখো মনে’।
মা শেলী আক্তার ছবিগুলো দেখিয়ে আর্তনাদ করছেন আর বলছেন, আমার মেয়ের মতো মেয়ে হয় না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। সারাক্ষণ পড়াশোনার মধ্যে ডুবে থাকে। সময় পেলে ছবি আঁকে, হাতের কাজ করে, ঘরকন্নার সব কাজ করে। তার এভাবে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না আত্মীয়স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশীদের কেউই। সাংবাদিক দেখলেই ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন তারা। মা শেলী আক্তার বলছেন, আঁর মাইয়া ত আঁর বুগত ফিরি আইয়নর কতা আছিল। মাইয়ার লাশ লইয়ারে আঁই কিত্তাম? সরকার কী ক্ষতি পূরণ দিবু? আঁর মাইয়ারে ফিরাই দিত পারিবু না? একনাগাড়ে কথা বলে হাঁফাতে থাকেন। ছোট মেয়ে সিনথিয়া পানির গ্লাস আর বিস্কুট এগিয়ে দেয়, সেও কাঁদছিল। মা ঝাঁঝিয়ে উঠেন, আঁর সাদিয়া কিছু খাইয়ে না? আঁই কেনে খাইয়ুম? গলা দি খানা লাইমতু নু। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া (১৯) সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাসায় ফেরার পথে নগরীর আগ্রাবাদ মোড় এলাকায় পা পিছলে নালায় তলিয়ে যায়। রাত ২টা ৫০ মিনিটের দিকে মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। সাদিয়া আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের (আইআইইউসি) কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের প্রথম সেমিস্টারের ছাত্রী ছিলেন। তিনি হালিশহর বড়পোলের মইন্যাপাড়ায় প্রবাসী মোহাম্মদ আলীর সন্তান। মোহাম্মদ আলী-শেলী আক্তার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সাদিয়া সবার বড়।
মা শেলী আক্তার আজাদীকে বলেন, ক’দিন ধরে তার চোখে একটু সমস্যা হচ্ছিল। আজ (মঙ্গলবার) তার পরীক্ষা ছিল। এজন্য সোমবার নানা ও মামার সাথে সে আগ্রাবাদ বাদামতলী এলাকার সুলতান মার্কেটে চোখের ডাক্তারের চেম্বারে যায়। যাওয়ার সময় ছোট বোন সিনথিয়ার সাথে দুষ্টুমিও করে। সিনথিয়াও যেতে চাইছিল। পরে আর যায়নি। সেখান থেকে বাসায় ফেরার পথে মাজার গেটের সামনে প্রাইম ব্যাংকের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটি বড় খোলা নালায় পড়ে যায় সাদিয়া।
সাদিয়ার বাবা সৌদি আরব প্রবাসী মোহাম্মদ আলী সমপ্রতি দেশে এসেছেন। তিনি বলেন, মেয়েকে কোনো কিছুর জন্য বলতে হতো না। এতটা লক্ষ্মী মা ছিল আমার। সব শেষ হয়ে গেল। এখন কাকে নিয়ে বাঁচব আমি?
সাদিয়া পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মামা মো. জাকির হোসেনও ঝাঁপ দেন। তিনি বলেন, আগ্রাবাদ মোড় থেকে মাজার গেট পর্যন্ত কোনো সড়ক বাতি নেই। সন্ধ্যার পর এই এলাকা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যায়। তখন বৃষ্টিও পড়ছিল। অন্ধকারে দেখতে না পেয়ে এবং বৃষ্টিতে রাস্তায় পা পিছলে সাদিয়া নালায় পড়ে যায়। তিনি জানান, নালায় ময়লা-আবর্জনা ছিল বেশি। তাই ১০ ফুট গভীর নালার স্রোত ও আবর্জনার কারণে সাদিয়াকে উদ্ধার করতে পারিনি। পরে ঘটনাস্থলের ৫০ ফুট দূর থেকে উদ্ধার করা হয় তার নিথর দেহ।
সাদিয়ার নানা হাজি জামাল মনকে কিছুতেই প্রবোধ দিতে পারছেন না। তিনি বলেন, নাতনি আমার সাথেই ছিল। হঠাৎ নালায় পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমিও ঝাঁপ দিলাম। আমার সাথে ছেলেও (সাদিয়ার মামা) লাফ দিল। কিন্তু নাতনিকে তো বাঁচাতে পারলাম না। মনকে কী করে বোঝাই? আমি আরেকটু সাবধান হলাম না কেন? তার হাত ধরে থাকলে এ ঘটনা তো ঘটত না।
তিনি বলেন, আল্লাহ তার বদলে আমাকে নিয়ে গেল না কেন? চশমার দোকানে অনেক চশমা দেখিয়েছে। কিন্তু কোন চশমা-ই পছন্দ হয়নি তার। সকালে আবার দোকানে গিয়ে চশমা পছন্দ করার কথা ছিল। তার আগেই আমার নাতনি চলে গেল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচারদিন ধরে মানুষ পড়ছিল ওই নালায়
পরবর্তী নিবন্ধদায়িত্ব সিডিএর, দায়ী নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের অবহেলাও : মেয়র