নদী–পাহাড় আর সবুজ বন–বনানী পেরিয়ে এ যেন রোমাঞ্চকর যাত্রা। কার্তিকের হালকা শীতের সকাল। নরম রোদের আলো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ক্রমশ। স্বপ্নের ট্রেন যাত্রা করল কক্সবাজারের দিকে। পথে পথে মানুষের উচ্ছ্বাস, অভ্যর্থনা। দিন শেষে সন্ধ্যায় কক্সবাজারে বেজে উঠল হুইসেল। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজকের হুইসেলটি চট্টগ্রাম–কক্সবাজারসহ সারা দেশের মানুষের জন্য অনেক বেশি আনন্দের। কারণ প্রথমবারের মতো এই ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল পর্যটন নগরী কক্সবাজারে।
সকাল ৯টা ২০ মিনিটে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে জিআইবিআর স্পেশাল ট্রেনটি যে হুইসেল বাজিয়ে ছেড়েছে তা সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে কক্সবাজার আইকনিক স্টেশন বিল্ডিংয়ে পৌঁছে শেষ হুইসেল বাজিয়ে কক্সবাজারবাসীকে স্বাগত জানায়। দোহাজারী–কক্সবাজার নতুন রেলপথের সবকিছু ঠিক আছে কিনা সেটি যাচাই করতেই গতকাল রোববার এই পরিদর্শন ট্রেন চালানো হয়। সঙ্গে পরিদর্শক টিমের সদস্যরা। দোহাজারী–কক্সবাজার রেল প্রকল্পের বিভিন্ন স্থানে ট্রেন থামিয়ে রেললাইনসহ ইন্টারলকিং, সিগন্যালিং ব্যবস্থা, প্লার্টফর্ম উঁচু কিনা, কালভার্ট, লেভেল ক্রসিং গেট সবকিছুর সঠিকতা যাচাই করছেন পরিদর্শন টিমের সদস্যরা।
দুপুর থেকে উৎসুক মানুষ স্বপ্নের ট্রেন দেখার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। অবশেষে তাদের সেই অপেক্ষার অবসান ঘটে সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে। এ সময় হাজার হাজার উৎসুক মানুষ প্রথম ট্রেনকে করতালিতে বরণ করে নেয়। কক্সবাজারে আসা ট্রেনে জিআইবিআর রুহুল কাদের আজাদের সাথে ছিলেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. নাজমুল ইসলাম, দোহাজারী–কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীন, রেলের পূর্বঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু জাফর মিঞা, অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মুহম্মদ আবুল কালাম চৌধুরীসহ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ব্রিটিশ আমলে নির্মিত রেললাইন ছিল। দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথের দূরত্ব ৪৭ কিলোমিটার। দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ১০২ কিলোমিটার। মূলত রেলের বিশেষ জিআইবিআর ইন্সপেকশন ট্রেনটি দোহাজারী স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার পর প্রথম রেলপথে ট্রেন দেখতে পেয়ে রেললাইনের দুই পাশে শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে উল্লাস প্রকাশ করে। এর মধ্যে বিকাল ৪টায় ডুলাহাজারার মালুমঘাট এলাকায় এলে উল্লসিত জনতা চলন্ত ট্রেন থামিয়ে ফুল ছিটিয়ে দেয়।
এর আগে কয়েকটি স্থানে মানুষজন চলন্ত ট্রেনে ফুল নিক্ষেপ করে আনন্দ প্রকাশ করে। সকালে প্রথমবারের মতো পর্যটন নগরী কক্সবাজারের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করে ৮টি কোচ ও একটি ইঞ্জিনের বিশেষ ট্রেনটি। পথে নির্মাণাধীন প্রকল্পটির বিভিন্ন কারিগরি দিক সরেজমিনে দেখেন রেলওয়ে পরিদর্শন অধিদপ্তরের সরকারি রেল পরিদর্শক (জিআইবিআর) রুহুল কাদের আজাদ। পরিদর্শন শেষে তার প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে রেলপথটি উদ্বোধন ও বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচলের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে বলে জানান রেল কর্মকর্তারা। অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও এটিই কক্সবাজারে যাওয়া বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রথম ট্রেন। আগামী ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটি উদ্বোধন করবেন। এর মাধ্যমে কক্সবাজারের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণ হতে চলেছে।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর প্রথমবারের মতো গতকাল ট্রেন গেল কক্সবাজারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় ২০১৭ সালে দোহাজারী–কক্সবাজার ১০২ কিলোমিটার কাজ শুরু হয়। পুরো রেললাইনের দুই পাশে হাজার হাজার উৎসুক জনতার ভিড়। খুশিতে হাত নেড়ে আনন্দ আর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন রেললাইনের দুই পাশের মানুষ। বাড়ির পাশ দিয়ে ট্রেন যেতে দেখে খুশিতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন নারী–শিশুরা। অনেকে মোবাইল দিয়ে ছবি তোলেন।
চট্টগ্রাম–কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। দোহাজারী থেকে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, রামু হয়ে পাহাড় ও নদীপথ দিয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজার পর্যন্ত এই রেললাইন চলে গেছে। এই পথে আছে ৯টি রেলওয়ে স্টেশন, চারটি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু, ১৪৯টি বক্স কালভার্ট এবং ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট। চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে সকাল ৯টা ২ মিনিটে ছেড়ে আসা ট্রেনটি সকাল ১০টায় দোহাজারী স্টেশনে পৌঁছায়। এরপর সেখান থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দেয়।
পরীক্ষামূলক যাত্রার প্রথম এই ট্রেনটি চালিয়েছেন লোকোমাস্টার মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান এবং সহকারী লোকোমাস্টার রুখন মিয়া। ট্রেনে একাধিক গার্ড, রেলওয়ে পুলিশ, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য (আরএনবি), রেল ট্র্যাক সংক্রান্ত কর্মী, প্রকৌশল, বাণিজ্যিক ও পরিবহন বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা ছিলেন।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, নিয়ম অনুযায়ী নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হলে তা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হয়। আজ (গতকাল) ট্রেনটির ট্রায়াল রান না হলেও কক্সবাজারে যাওয়া প্রথম ট্রেন। রেলপথ পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শকের অনুমোদন ছাড়া প্রকল্প উদ্বোধনের সুযোগ নেই।
এদিকে সন্ধ্যা সাড়ে ৫টায় রামু পৌঁছলে সেখানে শত শত উৎসুক মানুষ ভিড় করে। এর আগে বিকাল ৪টায় কক্সবাজারের ডুলাহাজারা মালুমঘাট এলাকায় ট্রেনটি পৌঁছলে স্থানীয় স্কুলের কয়েকশ শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় জনগণ ট্রেনটি আটকে চালকসহ ট্রেনের যাত্রীদের ফুল ছিটিয়ে অভিনন্দন জানান এবং উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। এটা শুধু ডুলাহাজারার চিত্র নয়, কালুরঘাট সেতুর পর থেকে ট্রেন যতই কক্সবাজারে দিকে এগিয়েছে হুইসেলের আওয়াজে রেললাইনের দুই পাশে শত শত নারী–পুরুষ, শিশু, এমনকি বৃদ্ধরাও ভিড় করতে থাকেন এক নজরে স্বপ্নের ট্রেন দেখার জন্য। ট্রেনের হুইসেল শুনে কোলের ছোট্ট শিশুটিকে নিয়ে রেললাইনে আসেন অনেক গৃহিণী। আবার অনেকে বাড়ির আঙিনা থেকে, অনেক মহিলা বাড়ির ছাদ থেকে দল বেঁধে প্রথম ট্রেন চলার ছবি তোলেন।
বিকাল ৪টা ২৪ মিনিটে ট্রেন পৌঁছে ঈদগাঁ ইসলামাবাদ স্টেশনে। ঈদগাঁ পোকখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিউল আলম বলেন, আমার বাপ–দাদা কখনো ট্রেনে করে কক্সবাজার যেতে পারেনি। আমি শেষ বয়সে ট্রেনে করে কক্সবাজার যেতে পারব। এর থেকে আনন্দের আর কিছু হতে পারে না। পর্যটন নগরীর সাথে সারা দেশের ট্রেন যোগাযোগের মধ্য দিয়ে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে বলে মনে করেন তিনি।
অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও এটিই কক্সবাজারে যাওয়া রেলওয়ের প্রথম ট্রেন। এই কারণে মানুষের মাঝে উৎসাহ–উদ্দীপনা বেশি ছিল। দুপুর ১টায় সাতকানিয়া উপজেলার তেমোহনী এলাকায় ট্রেনটি পৌঁছলে দুই পাশে অসংখ্য নারী–পুরুষ ও শিশু ভিড় করে। এ সময় তারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। কথা হয় স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. জমিরের সঙ্গে। নিজের ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়া রেললাইনে প্রথম ট্রেন দেখতে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা জমির বলেন, আমাদের ঘরের পাশে এগুলো আগে ধানি জমি ছিল। ভাবতে অবাক লাগে, কি থেকে কি হয়ে গেল! আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল, এ এলাকা দিয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে ট্রেন যাবে। এটা আজ কল্পনা নয়, বাস্তবতা। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
নিজের এলাকা দিয়ে প্রথমবারের মতো ট্রেন চলতে দেখে মো. জমিরের মতো চকরিয়ার আজিজনগর এলাকার চা দোকানী মো. ওসমানও খুশিতে আত্মহারা। আজিজ এলাকায় ট্রেনটি দাঁড়ালে পার্শ্ববর্তী চা দোকানদার মো. ওসমান দৌড়ে আসেন ট্রেন দেখতে। জীবনে প্রথম ট্রেন দেখার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ওসমান বলেন, এই এলাকা দিয়ে ট্রেন যাবে তা কখনো কল্পনাও করিনি। এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান। আমাদের এলাকা বদলে গেছে। কী বলব বুঝতে পারছি না।
দুপুর আড়াইটায় চকরিয়ার শাহার বিল এলাকায় ট্রেনটি পৌঁছতেই দুই পাশে হাজারেরও অধিক গ্রামবাসী ট্রেনটি ঘিরে ধরে। গ্রাম পুলিশ মো. ফরিদুল আলম বলেন, আমাদের এই এলাকায় একসময় হাওড়ের মতো জলাশয় ছিল। আমি একটি টং ঘর করে থাকতাম। আস্তে আস্তে আমাদের এলাকার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন এই এলাকার উপর দিয়ে ট্রেন লাইন হয়েছে। নতুন রেললাইনে আজকে ট্রেন এসেছে। এটা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। গ্রামের শিশু, বৃদ্ধ থেকে শুরু নারী–পুরুষ সবাই ট্রেন দেখার জন্য চলে এসেছে।
সন্ধ্যায় কক্সবাজার পৌঁছে গভর্নমেন্ট ইন্সপেক্টর অব বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিদর্শক রুহুল কাদের আজাদ বলেন, আমিসহ আমাদের টিম সকাল থেকে পথে পথে ট্রেন দাঁড় করিয়ে নবনির্মিত রেললাইন, স্টেশন বিল্ডিং, সকল ব্রিজ, হাতি চলাচলের ওভারপাস এবং আন্ডারপাসসহ সকল কিছু পর্যবেক্ষণ করেছি। আমি ঢাকায় গিয়ে রিপোর্ট দেব।