স্বতন্ত্র ভাষা ও স্বরের কবি নুরুল আমিন

নিজামুল ইসলাম সরফী | শুক্রবার , ৩ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

জীবনের সাতষট্টিতম বসন্তে পা রেখেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক, কবি ও গবেষক ড. নুরুল আমিন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের সদ্যবিদায়ী অধ্যাপক ও প্রাক্তন সভাপতি তিনি। বাংলাদেশের উত্তর আধুনিক যুগের একজন সুপরিচিত কবি নুরুল আমিন। তাঁর নবম কাব্যগ্রন্থ ‘জীবনবোধের কাব্য’ ঢাকার গ্রন্থরাজ্য প্রকাশনী থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছে। ৩৪টি কবিতার নির্বাচিত সঞ্চয়নে বিচিত্র বিষয়াবলীর অভিনবত্বে কবিতার নবতর বিন্যাস নুরুল আমিনের কাব্যপ্রতিভার পরিচয় বহন করে। স্বতন্ত্র কাব্যভাষা ও কাব্যস্বরে নতুন মাত্রা পেয়েছে জীবনবোধের কাব্য। ২০২০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত সময়টা করোনা মহামারি, রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধ, দেশে ও বিশ্বে মানবতা বিমুখ রাজনীতির দু:সময়ে কবি এসব কবিতা রচনা করেছেন বলে করোনা কাব্যসহ যাপিত জীবনের বাস্তবতাগুলো এই কাব্যগ্রন্থে অনুপম বাঙ্ময়তায় ফুটে উঠেছে। কবি নুরুল আমিন দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরের অধিক সময় ধরে কবিতার সঙ্গে বসবাস করছেন। এতে তাঁর কাব্যভাষা ও কাব্যদর্শনে যের্চচাগত স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়েছে তা একাব্যগ্রন্থে সহজে ধরা পড়ে। তাই স্বপ্নাদ্য সুন্দরের কবি নুরুল আমিনের কবিতায় সারল্য ও ইঙ্গিতময়তা আধুনিক বা উত্তর আধুনিক সকল চেতনার চিত্তে আনন্দে পাঠককে দোলা দিয়ে যায়।

জীবনবোধের কাব্য’ গ্রন্থের কবিতার সূচিতে রয়েছে: নিউক্লিয়াস বঙ্গবন্ধু, কিছু সংখ্যা কিছু নাম, অলৌকিক ইন্‌শাল্লাহ, বোধোদয়, উষ্ণতা, দূষণ, নাবলা বাণী, শূন্য হাওয়ায়, অলৌকিক লাল গোলাপ, পদ্মা তীরের শাল্মলি বৃক্ষ, জীবনবোধের কাব্য, জীবনবোধের কাব্য, করোনা কাব্য, করোনা কাব্য, হে সভ্য মানুষ, সুন্দরের বিচ্ছুরিত আলোয়, পাহাড়ি বকুল, করোনা রুবাইয়াৎ, থাম, আমার যতো কবিতা, কাশ্মীরি ময়ূরের কান্না, কক্সবাজারে রুবাইয়াৎ, অনূর্ধ্ব উনিশ, কালের শপথ, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষেরা, গুরুত্রয়, পদ্মা, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, নজরুল যখন, নেতা হলে, কোন দেশে যে আছি, আমার রবীন্দ্রনাথ, আমি, রহস্যময়ী তুমি। লক্ষণীয়, প্রায় প্রতিটি কবিতাই কবির যাপিত জীবনের অভিজ্ঞানে সমৃদ্ধ ও মহোত্তম জীবনবোধের প্রকাশে অভিনব। বলাই বাহুল্য সহস্রকোটি মানুষের মধ্যে জীবনবোধ সম্পন্ন মানুষেরাই মানবমুকুটের ধ্বজাধারী। তাঁরা সহস্রকোটির মধ্যে আলাদা, সংখ্যায় বেশি নন, তাঁরাই মনুষ্যত্ববোধের গৌরব। একবির কাব্যে সেই ভাবটুকু প্রকাশিত হতে দেখা যায় তাঁর সহজাত ভঙ্গিতে। ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষেরা’ কবিতাটি তার উত্তম উদাহরণ। আজন্ম সৌন্দর্যের অভিসারী কবি একাব্যেও সত্যসুন্দরের সাধনা থেকে বিচ্যুত হননি, তার প্রমাণ একাব্যের একাধিক কবিতায় মেলে। ‘অলৌকিক লাল গোলাপ’, ‘সুন্দরের বিচ্ছুরিত আলোয়’, ‘পাহাড়ী বকুল’, ‘কাশ্মীরি ময়ূরের কান্না’ প্রভৃতি তার প্রমাণ। আত্মআবিষ্কার যেকোনো মানুষের জন্যে পরম কাম্য সাধনার বিষয়। এ কাব্যের ‘আমি’, ‘শূন্য হাওয়ায়’, ‘রহস্যময়ী তুমি’ প্রভৃতি কবিতায় সেই বিষয়টি উঠে এসছে। প্রেমিক কবির এই আত্মআবিষ্কারের প্রচেষ্টার ইঙ্গিত মেলে (১৯৭৩এ লেখা) ‘আমার যতো কবিতা’ এবং (২০২২এ লেখা) ‘রহস্যময়ী তুমি’ কবিতায়। এখানে কবির আজন্ম প্রেমিক পরম কাব্যলক্ষ্মীকে খুঁেজ পেতে কষ্ট হয় না। শুধু ভাবে নয়, ভাষা ও ছন্দেও যে একাব্য নিটোল, তারও প্রমাণ মেলে। তাই অক্ষর বৃত্ত, প্রবহমান গদ্য ছন্দের সঙ্গে ‘গুরুত্রয়ে’র মতো স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতাও একাব্যের রসবৈচিত্র্য নির্মাণ করেছে।

কবি অধ্যাপক ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ ২০০৫ সালেই বলেছিলেন, ‘আমার কবিতাভাবনা’ শীর্ষক আত্মবিবরণে কবি নুরুল আমিন ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন, তা আমাকে উদ্দীপ্ত করেছে। সমকালীন বাংলা কবিতা তাঁর সোনালি শস্যে উজ্জ্বলতর হোক এই কামনা করছি। (কথামুখ, ‘কবিকথা ও অন্যান্য’ পৃ.১৪)। ইতোমধ্যে কবি নুরুল আমিন তাঁর প্রতিশ্রুতি পালন করে চলেছেন। তাঁর ২০০৭ সালে প্রকাশিত ‘বুনো হাঁস পাতি হাঁস’, ২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘স্বপ্ন দেখি সুন্দরে’, ২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘ভালোবাসার গহীন নদী’ এবং ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘নির্বাচিত কবিতা’ এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

কবি ময়ুখ চৌধুরী ২০১৯ সালে এক আলোচনায় বলেছেন, ‘. নুরুল আমিন বাংলাদেশের সাহিত্যপরিমণ্ডলে নিজগুণে পরিচিত একটি নাম। গবেষণা ও সম্পাদনার সুবাদে তাঁর পরিচয়ের পরিধি বিস্তৃত। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে তিনি পেশাগতভাবে সম্পর্কিত। কিন্তু অধ্যাপকসুলভ কর্মকাণ্ডের ফাঁকে ফাঁকে কবিতার প্রতি চোরাটানের যে পরিচয় তিনি দিয়েছেন, তা আমাদের চমকিত করে। এই মমত্ববোধ সকলের থাকে না, বিশেষ করে যাঁরা শিক্ষকতার সঙ্গে সম্পর্কিত। সাহিত্যের অনেক শিক্ষক মনে করেন, কবিতা আর এমনকি। চাকরি করি বলেই কবিতা পড়াতে হয়। এই মনোভাব দুঃখজনক। কবিতার সঙ্গে এঁদের অন্তরের কোনো যোগ নেই। কবি নুরুল আমিনকে ধন্যবাদ, তিনি সেই গোত্রের মধ্যে পড়েন না। নিভৃত কবিমনকে প্রকাশ্য করে তুলবার ক্ষেত্রে তাঁর চেষ্টার বিরাম নেই। ইতোমধ্যে তাঁর ছয়সাতটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়ে গেছে। (দৈনিক পূর্বকোণ, ১মার্চ ২০১৯, পৃ.)। কৃতিমান শিক্ষাবিদ, গবেষক ও কবি ড. ময়ুখ চৌধুরীর বক্তব্যের সূত্র ধরে বলা যায়, কবি ও গবেষক ড. নুরুল আমিনের ইতোমধ্যে কবিতা প্রবন্ধ গবেষণা সম্পাদনা মিলিয়ে ছাব্বিশটি গ্রন্থ রয়েছে, এছাড়া তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির ‘বাংলাপিডিয়া’র দশটি বিষয়ে সহযোগী লেখক, বর্তমানে বাংলা একাডেমির আরও তিনটি গ্রন্থ রচনায় তিনি সংযুক্ত।

কবির অপর একটি কাব্যগ্রন্থ্যের আলোচনায় ড. সুমন হায়াত বলেছিলেন, ‘জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে ধারণ করে সঞ্চিত অর্জনকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে উপমার নান্দনিকাতয় শিল্পরসে গড়ে উঠে কবির কবিতা। কবি নুরুল আমিনের কবিতার নির্মাণকৌশলই এই সত্যের জানান দেয়। আত্মমগ্ন সাধনা আর সুদীর্ঘ কাব্যচর্চার ফলে কবির চিত্তভূমি হয়ে উঠেছে কবিতার বীজতলা। কবি নুরুল আমিনের কবিতা পাঠককে শুধু মুগ্ধই করে না, মগ্নও করে। (দৈনিক আজাদী, ৩ ডিসেম্বর ২০১০)

বাংলা ভাষার একজন নিবেদিতপ্রাণ কবি প্রাবন্ধিক ও একনিষ্ঠ গবেষক হিসেবে তিনি লেখার ক্ষেত্রে সংখ্যার চেয়ে গুণগত মানের প্রতিই অধিক যত্নশীল । লেখায় যেমন ইতিহাসনিষ্ঠ ও শুদ্ধতাবাদী, তেমনি জীবনযাপনেও শেকড়সন্ধানী ও যৌক্তিক মানবতাবাদী। তাঁর জন্ম ৮ নভেম্বর, ১৯৫৬। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নে। সেই প্রত্যন্ত গ্রামে তরুণ বয়সে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ক্লাব, দাতব্য চিকিৎসালয়, পাঠাগার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানযার মধ্যে বর্তমানে সুফিনগরস্থ ‘চুনতি শাহ সুফি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৯ সালে কবিতায় ‘অমর একুশে স্মরণে বাংলাদেশ সাহিত্য পরিষদ সাহিত্য পুরস্কার, ২০০০ সালে ‘শহীদ নূতনচন্দ্র সিংহ স্মৃতি সম্মাননা’, ২০১০ সালে সাতকানিয়ালোহাগাড়া সাংবাদিক ফোরাম সম্মাননা’, ২০১৫ সালে ‘আবুল মনসুর আহমদ গবেষণা পুরস্কার’, ২০১৭ সালে ‘ফিদেল কেস্ত্রো আওয়ার্ড’, ২০১৮ মার্চে ‘প্রিন্সিপ্যাল শাফায়াত আহমাদ সিদ্দিকী গুণীজন সম্মাননা’, ২০২০ সালে প্রবন্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সাহিত্য পুরষ্কার ও একুশে পদক’ এবং আজীবন শিক্ষকতায় সাফল্যের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ২০২২ সালে তাঁকে ‘শিক্ষায় আজীবন সম্মাননা’য় ভূষিত করেন।

উত্তর আধুনিক যুগের কবি নুরুল আমিন তাঁর সদ্য প্রকাশিত ‘জীবনবোধের কাব্যে’ সমসাময়িক বিষয়, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, রাজনীতি ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এই কাব্যগ্রন্থে তিনি সহজ সরল শব্দে ছন্দে কাব্যিক ইঙ্গিতময়তায় সরস প্রাঞ্জল ভাষায় অনুপম বাক্যে প্রকাশ করেছেনযা সহজে পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়। ‘নিউক্লিয়াস বঙ্গবন্ধু’ কবিতায় কবি বলেন, ‘শুধু জম্মশত বর্ষে নয় হাজার বর্ষেও তুমি বাঙালির চেতনার নিউক্লিয়াস বীজতলা ভূমি’। ‘বোধোদয়’ কবিতায় করোনার অনুজীব নিয়ে লেখেন, ‘সকল মানুষ তোমরা একজাতযদিও সৃষ্টির সেরা, ভুলে গিয়ে তাই কাঁদিছ এখন মৃত্যুর মিছিল করোনায় ঘেরা’। ‘অলৌকিক লাল গোলাপ’ কবিতায় তিনি ফিলিস্তিনে বর্বর ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে নিহত শহীদ সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহকে স্মরণ করে নাট্যধর্মী রূপকল্পের অবতারণা করেছেন। ‘জীবনবোধের কাব্য’তে তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘মনীষী কথাই সার:তিনটি কর্তব্য তোমার/ স্রষ্টায়, মাতাপিতায়, মানব সেবায় পার!’ ‘করোনা রুবাইয়াৎ’ কবিতায় তিনি লেখেন, ‘মানুষ যারা অকৃতজ্ঞ স্বার্থঅন্ধ আত্মদম্ভে দিশেহারা/ স্রষ্টা ভাবেন এবার তবে করোনাতেই গড়তে হবে এদের কারা!’

বইটি প্রকাশ করেছেন রাজীব দত্ত, গ্রন্থ রাজ্য ঢাকা থেকে। প্রচ্ছদ করেছেন রুদ্র কায়সার। বইটির বহুল পাঠকপ্রিয়তা আশা করছি। এবং ৮ নভেম্বর ২০২৩ কবি নুরুল আমিনের আটষট্টিতম জন্মদিন উপলক্ষ্যে তাঁকে শুভেচ্ছা অভিবাদন এবং তাঁর দীর্ঘ সুস্থ নিরোগ জীবন প্রার্থনা করছি; তাঁর সৃষ্টিশীল মননশীল জগৎ আরও সমৃদ্ধ হোক। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নুরুল আমিন শতায়ু হোন এবং আমাদের কাব্য ভুবনকে তিনি আরো সমৃদ্ধ করে তুলুন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসার্বভৌম ফিলিস্তিনি মাতৃভূমির আহ্বান পোপের
পরবর্তী নিবন্ধযে কবিতা বুদ্ধি দিয়ে নয়, অশ্রু দিয়ে ভাবায়