যে কবিতা বুদ্ধি দিয়ে নয়, অশ্রু দিয়ে ভাবায়

আহমেদ মুনির | শুক্রবার , ৩ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

কবিতা কেন মানুষ লেখে আর কেনই বা পড়ে, এই প্রশ্নের কোনো সরল উত্তর নেই। তবে উত্তর খুঁজতে গেলে তুলনা আসতে পারে গান শোনার সঙ্গে আর গল্প বা উপন্যাস পাঠের সঙ্গে। গান শুনে সুরের প্রবাহে মানুষ ভেসে যাওয়ার অভিজ্ঞতা পায়, নিজের অনুভূতির গভীরে একটুখানি উপশমের মলমও লাগায় হয়তো। আর গল্প বা উপন্যাস পাঠে মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা অন্যের সঙ্গে মেলাতে চায়, মেলাতে না পারলে সেখানে কোনো না কোনোভাবে নিজেকেই প্রতিস্থাপন করে। শিল্পসাহিত্যের নানা মাধ্যম সম্পর্কে একটি আধা সত্য, প্রায় সত্য কিংবা সত্যের কাছাকাছি ধারণায় পৌঁছানো সম্ভব হলেও কবিতার রসায়ন সেভাবে ব্যাখ্যা করা চলে না। বরং আমরা দেখতে পাই ছেঁড়া ছেঁড়া গান, গল্প, দর্শন, ইতিহাসপাঠ কিংবা চলচ্চিত্রের অভিঘাত সবই কবিতায় পাওয়া সম্ভব।

কবি হিন্দোল ভট্টাচার্যের মৃৎফলকে লেখা বইয়ের প্রথম ফ্ল্যাপে লেখা একটি বাক্য এমন, ‘এই কবিতার বই কবির কাছে এক প্রকার বিড়বিড়ানি।’ আসলে কবি তো তাই করেন। নিজের সঙ্গেই বলা মুহূর্ত কথার সাক্ষ্যই বহন করে কবিতা। সেখানে হৃদয় ও বুদ্ধির কাজটুকু কবিতাকে করে তোলে সর্বজনের। তবে সর্বজনেরই বা কেন বলছি, পাঠক বিশেষের বলাই কি শ্রেয় নয়? একটা কবিতার অভিঘাত যদি পৃথিবীর একজন পাঠককেও ছুঁয়ে যায় তবে সে কবিতা পাঠকের কাছে পৌঁছাল, কথা বলাই যায়।

মৃৎফলকে লেখা’ কবিতার বইটি হাতে নেওয়ার পর ভাবছি হিন্দোল ভট্টাচার্য তো আমারই কবি। তিনি তো আমাদের জন্যই লিখছেন। তবে কেন তাঁকে আবিষ্কার করতে এত সময় লাগল? এই আক্ষেপ যারা হিন্দোলকে পড়েননি তাদের সবারই হওয়ার কথা। কথা না বাড়িয়ে আমরা তাঁর কবিতার বইয়ের দিকে একবার তাকাই।

৫৭টি কবিতা নিয়ে ‘মৃৎফলকে লেখা’ কবিতার বইটি প্রকাশ করেছে চট্টগ্রামের চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন। বইয়ের ‘বিভাব’ কবিতাটি চমকে দেওয়ার মতো।

অন্ধকার যত কাব্য, ছোট ছোট ঝোপ

এদিকে ওদিকে, ওই সরু পায়ে চলা

রাস্তাখানি শুধু আছে, এটুকুই আলো।

আমার উদ্দেশ্য শুধু তোমাকেই বলা

যা কিছু জেনেছি আর যা কিছু জানি না

ভাঙা পাহাড়ের নীচে ছুটে চলে স্রোত

হিন্দোলের কাব্যভাষা সোজাসাপ্টা মনে হলেও আসলে তা নয়। বরং সান্ধ্য ভাষার গূঢ় রহস্যে ঘেরা তার পঙ্‌ক্তিমালা। কখনো কখনো তাঁর কবিতায় কিছু আপ্তবাক্যের দেখা মেলে। আমরা যাকে ম্যক্সিম বলি অনেকটা যেন তেমন। নিজের অভিজ্ঞতার সারাৎসারকে তিনি আপ্তবাক্যের আয়নায় সাধারণের কাছে তুলে ধরেন। এক নতুন উপলব্ধির সঞ্চার করেন পাঠকের মনে।

এর কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ‘মৃৎফলকে লেখা’ কবিতার বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে পাঠকের চোখে পড়বে, ‘এত বুদ্ধি ভালো নয়, অশ্রু দিয়ে ভাবো।’, ‘সমস্ত মুহূর্ত শুধু অল্প কিছুক্ষণ বেঁচে থাকে।’, প্রতিটি নতুন প্রেম পুরনো প্রেমের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা’, ‘ভালো উদাসীন থাকা। এঁটো বাসনের স্তূপে যেভাবে আহার লেগে থাকে।’ হিরেমানিকের মতো দ্যুতি ছড়ানো এসব পঙ্‌ক্তি মুহূর্তেই মনে গেঁথে যায়। পরে বারবার উঁকি দিয়ে আর নিজেকে গানের মতো বাজিয়ে চলে। ওই যে বলেছিলাম সংগীত, কথাসাহিত্য, চিত্রকলার অনেকটুকুই কবিতার ভেতরেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কিংবা এসবই আসলে কবিতার সম্প্রসারিত একেকটা রূপ। হিন্দোল কেন, প্রতিটি সার্থক কবির কবিতা পড়লেই আমার এমন মনে হতে থাকে।

মৃৎফলকে লেখা কবিতার প্রধান অভিমুখ জীবন। যার অনেকটা জায়গাজুড়েই রয়েছে প্রেম। বাকিটা প্রেমের অবশেষ বলা যায়। কেননা নিঃসঙ্গতা, বিপন্নতা, বিহ্বলতা বা ভয় এসব অনুভূতি একদা প্রেমেরই সাক্ষ্য বহন করে।

২৩ নম্বর কবিতায় হিন্দোল লেখেন

ঝরে যেতে পারি আমি, ঝরে যেতে পারো তো তুমিও

এ পৃথিবী ঝরে যাচ্ছে প্রতিদিন, প্রতিরাতে

আমাদের সকলের আয়ু আর মায়া ঝরে যায়।

যাওয়াটাই বড় কথা, থাকা তো কেবল

সমাধির কাজ। তুমি সমাধি হবে কি?

শিলালিপি থেকে তবু শুনেছ কি চোরা আর্তনাদ ?

যুবতী যক্ষিনী জানে, তার স্তন বড় বেশি মৃত।

কামের আগুন নিভে গেছে তাই তাহাদের দেবী মনে হয়;

কোথাও সঙ্গীত যেন শুধু প্রতিধ্বনি হয়ে আছে।

সঙ্গীত ফুরিয়ে গেলে, তার পর শূন্যতাই জন্ম দেয় সুর ….

আহা। পড়ে চুপচাপ অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়, নিজের কাছে ফিরতে বুঝি বা সময় লাগে।

হিন্দোলের কবিতা আমাদের চেনা বিশ্বেরই কবিতা। তবু প্রতিটি অভিজ্ঞতা তাঁর নিজের শব্দ, দৃশ্য আর স্থানকালের কারণে বারবার নতুন হয়ে ওঠে। নতুন হতে হতেও আমাদের মনে পড়ে যায় যে, কোথাও আগে শুনেছি, কিংবা মনে হয় এআমারই কথা।

মৃৎফলকে লেখা’ কবিতার বইয়ের ৫ নম্বর কবিতাটি পড়ে বিহ্বল লাগে। পাঠকেরও তেমন অনুভূতি হবে আমি নিশ্চিত।

সে ভেসে গিয়েছে, তার দুঃখটুকু পড়ে আছে ঘাটে।

যেন পরিত্যক্ত এক যুদ্ধক্ষেত্র; এদিকে ওদিকে

কাটা হাত, ছেঁড়া স্বপ্ন, খোলা চোখ, বর্ম পড়ে আছে।

যুদ্ধক্ষেত্র এরকম। এঁটো, ব্যবহৃত।

শাণিত তলোয়ার, ছুরি, ম্যাগাজিন সহ বন্দুকের

ট্রিগারে এখনও খিদে। হাতলে এখনও বীররস।

মৃত কিছু দেহ নিয়ে একটি ভূতুড়ে ট্যাঙ্ক

কার দিকে যেন তার অসমাপ্ত নিশানায় স্থির।

যুদ্ধক্ষেত্র এরকম। সে ঠিক শ্মশান নয়, দেশ নয়, সভ্যতাও নয়।

তার দুঃখটুকু আসে, সাধারণ দেখতে, যেন

কয়েক হাজার দেনা, ভাড়া বাকি, চাকরি নেই, বাড়িতে অসুখ

পাঁচ টাকার চা কিনেও খেতে কষ্ট হয়।

আমি তাকে দেখি যত, সে আমাকে ততটাই দেখে

যেন বহুদিন চেনা। সেই কোন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে

সে ভেসে গিয়েছে, জানি, সে ভেসে গিয়েছে ঠিক কবে?

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বতন্ত্র ভাষা ও স্বরের কবি নুরুল আমিন
পরবর্তী নিবন্ধসিআইইউ ও ইম্পেরিয়াল হাসপাতালের চুক্তি স্বাক্ষর