সেবায় শীর্ষে, বরাদ্দে পিছিয়ে

চমেক হাসপাতাল

রতন বড়ুয়া | মঙ্গলবার , ৪ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:০২ পূর্বাহ্ণ

সরকারি পর্যায়ে দেশের সর্ববৃহৎ হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের অনুমোদিত শয্যা সংখ্যা ২৬শ। ২০২২২৩ অর্থবছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক হাসপাতালটিতে বরাদ্দের পরিমাণ (বেতনভাতা বাদ দিয়ে) ১৬৭ কোটি ৮১ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। অন্যদিকে, ২২শ শয্যার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে বরাদ্দের পরিমাণ ৭৪ কোটি ৭৯ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। হিসেবে অতিরিক্ত চারশ শয্যার ঢামেক হাসপাতালে বাজেটবরাদ্দের পরিমাণ চমেক হাসপাতালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। তবে কম শয্যা সংখ্যার বেশ কয়টি হাসপাতালও চমেক হাসপাতালের তুলনায় বেশি বরাদ্দ পেয়ে আসছে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অনুমোদিত শয্যা সংখ্যা এক হাজার। যা চমেক হাসপাতালের তুলনায় ১২শ শয্যা কম। কিন্তু বেতনভাতা ব্যতীত হাসপাতালটি (ময়মনসিংহ) এবার বরাদ্দ পেয়েছে ১০৮ কোটি ৭৮ লাখ ১৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ শয্যা সংখ্যা বারশ কম হওয়ার পরও চমেক হাসপাতালের তুলনায় প্রায় ৩৩ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ পেয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। একই ভাবে ১২শ শয্যার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও প্রায় ১৫ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ পেয়েছে। হাসপাতালটিতে (রাজশাহী) এবার বরাদ্দের পরিমাণ (বেতনভাতা ব্যতীত) ৮৯ কোটি ৪১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। মাত্র নয়শ শয্যার অনুমোদন প্রাপ্ত সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও বরাদ্দের দিক দিয়ে চমেক হাসপাতালের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। নয়শ শয্যার এ হাসপাতালে এবার বরাদ্দের পরিমাণ ৭৬ কোটি ৫৯ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। যা ২২শ শয্যার চমেক হাসপাতালের তুলনায় প্রায় ২ কোটি টাকা বেশি।

হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, বেতনভাতা ব্যতীত এ বরাদ্দ অন্যান্য খাতে ব্যয় নির্বাহের জন্য। যদিও বেতনভাতাসহ বরাদ্দের পরিমান আরো বেশি। অন্যান্য খাতের মধ্যে এমএসআর, পথ্য (খাবার), অক্সিজেন, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি অন্যতম। এমএসআরের আওতায় পথ্য (রোগীর খাবার) ছাড়াও হাসপাতালের যন্ত্রপাতি, ওষুধ, ক্যামিকেলরিএজেন্ট, গজব্যান্ডেজ, কটনসহ অতি প্রয়োজনীয় ও জরুরি সরঞ্জামাদি কেনা হয়ে থাকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেনরোগীর সংখ্যার উপর এই খাতের (এমএসআর) খরচ নির্ভর করে। যে প্রতিষ্ঠানে রোগীর সংখ্যা যত বেশি, সেখানে এমএসআর খাতে খরচও তত বেশি। এর বাইরে অন্যান্য খাতগুলোতে খরচ অনেকটা নির্দিষ্ট থাকে বলা যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে হাসপাতালের অনুমোদিত শয্যা সংখ্যা ও রোগীর সংখ্যার অনুপাতে বাজেটবরাদ্দ প্রদানের কথা। কিন্তু এ নিয়ম অনুসৃত হচ্ছে না। নিয়ম অনুযায়ী বরাদ্দ প্রদান করা হলে চমেক হাসপাতাল আরো অনেক বেশি বরাদ্দ প্রাপ্তির দাবি রাখে। তবে সীমিত জনবল ও অপর্যাপ্ত বাজেটবরাদ্দের মাঝেও স্বাস্থ্য সেবায় ১৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মধ্যে দেশ সেরা অবস্থান করে নিয়েছে চমেক হাসপাতাল। গত রোববার মূল্যায়নের এ সূচক প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

শয্যা সংখ্যা ও রোগীর অনুপাতে চমেক হাসপাতালের বিপরীতে বরাদ্দের পরিমাণ কেবল অপর্যাপ্তই নয়, এটি চরম বৈষম্যমূলক বলেও মনে করছেন চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ।

পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, চট্টগ্রামের সভাপতি ডা. একিউএম সিরাজুল ইসলাম ও জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া বলছেন, ৯শ/এক হাজার শয্যার হাসপাতালের বরাদ্দ কি করে ২২শ শয্যার হাসপাতালের তুলনায় বেশি হয়। আর চারশ শয্যার ব্যবধানে চমেক হাসপাতালের বরাদ্দ কি করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্ধেকের কম হয়? কোন যুক্তিতেই এসব আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। এটি স্পষ্টতই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিমাতাসুলভ আচরণ। নয়তো এতটা বৈষম্য কি করে হয় বলেও প্রশ্ন রাখেন এ দুই চিকিৎসক।

চমেক হাসাপাতালের তথ্য মতে২২শ শয্যার এ হাসপাতালে প্রতিনিয়ত তিন হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসাধীন থাকছে। এছাড়া আরো তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার রোগী প্রতিদিন বর্হি বিভাগে সেবা গ্রহন করে। একমাত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়া অন্যান্য সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই শয্যা ও রোগীর সংখ্যা চমেক হাসপাতালের তুলনায় কম। সে হিসেবে এমএসআর খাতে ঢামেক হাসপাতালের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়ার দাবিদার চমেক হাসপাতাল। কিন্তু তা হয়নি। হাসপাতালের অতি জরুরি হিসেবে পরিচিত এই এমএসআর খাতে চমেক হাসপাতালকেই সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। দেশের পুরনো ৮টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বাজেটবরাদ্দের তথ্য পর্যালোচনায় এ তথ্য উঠে এসেছে। বাজেটবরাদ্দের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়এমএসআর খাতে ৮২ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে ঢামেক হাসপাতাল। এক হাজার শয্যার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পেয়েছে ৬১ কোটি ৪৬ লাখ। ১২শ শয্যার রাজশাহী মেডিকেলে এ বরাদ্দের পরিমান ৪৫ কোটি ৬৫ লাখ। অন্যান্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে এ বরাদ্দ ৪০ কোটি ও এর উর্ধ্বে। অথচ ২২শ শয্যার চমেক হাসপাতাল এ খাতে বরাদ্দ পেয়েছে ৩৬ কোটি ৫০ লাখ। অর্থাৎ জরুরি খাত হিসেবে এমএসআর খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়া হয়েছে চমেক হাসপাতালে। একই ভাবে চিকিৎসা যন্ত্রপাতি খাতেও সবচেয়ে কম বরাদ্দ পেয়েছে এ হাসপাতাল।

এদিকে, গত শনিবার (১ এপ্রিল) চমেক হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাজেটবরাদ্দের তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন করা হলে অনেকেই চমেক হাসপাতাল, সর্বোপরি চট্টগ্রামবাসীকে অভাগা বলে মন্তব্য করেন।

চমেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, শয্যা ও রোগী অনুপাতে অপর্যাপ্ত বরাদ্দের কারণে সেবাদানে হিমশিম অবস্থায় পড়তে হচ্ছে হাসপাতাল প্রশাসনকে। বেশ কয়টি খাতে প্রাপ্ত বরাদ্দ এরইমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। এমএসআর, পথ্য, চিকিৎসা যন্ত্রপাতিসহ জরুরি আরো কয়েকটি খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়ে বছরের শুরুর দিকে মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর কয়েক দফা চিঠিও দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সবমিলিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ চাওয়া হয়। কিন্তু এমএসআর ও পথ্যে সবমিলিয়ে চার কোটি টাকা বরাদ্দের অনুমোদন পাওয়ার কথা জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এমএসআর খাত একটি হাসপাতালের ‘লাইফলাইন’ উল্লেখ করে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান আজাদীকে বলেন, চিকিৎসকনার্সের পাশাপাশি বাজেটবরাদ্দের উপরও চিকিৎসা সেবার মান অনেকাংশে নির্ভর করে। পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ থাকলে চিকিৎসা সেবাটাও মানসম্মত ভাবে দানের সুযোগ থাকে। কিন্তু এমএসআরসহ প্রায় সব খাতে আমরা যে বরাদ্দ পাচ্ছি, তা খুবই অপর্যাপ্ত। চাইলেও আমরা জরুরি কোনো সরঞ্জাম কিনতে পারছি না। রোগীরাও অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বেড ও রোগীর সংখ্যা অনুযায়ী বরাদ্দ বন্টন হলে আমাদের আরো বেশি বরাদ্দ পাওয়ার কথা।

তবে তুলনামূলক কম বাজেট ও জনবলসহ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মাঝেও রোগীদের চিকিৎসা সেবার মান বাড়াতে আমরা আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করছি। এমন পরিস্থিতিতেও দেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর মধ্যে আমরা প্রথম অবস্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। পর্যাপ্ত বাজেটবরাদ্দ পেলে রোগী সেবার মান আরো বাড়ানো সম্ভব বলে মন্তব্য করেন হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুই শিশু যেভাবে নিখোঁজ ও উদ্ধার
পরবর্তী নিবন্ধভেঙে ফেলা হবে মতিঝর্নার অবৈধ বহুতল ভবনগুলো