‘সেই ওকাম্পো এখন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত’

| বৃহস্পতিবার , ২৩ জুন, ২০২২ at ৬:৪৩ পূর্বাহ্ণ

পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে পর্যবেক্ষণে আসা বিশ্ব ব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান লুইস গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পো নিজেই এখন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজেদের অর্থায়নে নির্মিত বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু উদ্বোধনের তিন দিন আগে বুধবার নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করেন সরকার প্রধান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল চেয়ারম্যান লুই মোরেনো ওকাম্পোকে ঢাকায় পাঠায়। ওকাম্পো ঢাকায় এসে আমাদের দুর্নীতির খোঁজ করে। এবং বিভিন্ন ব্যক্তি-গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, তৎকালীন সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এবং যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সঙ্গে আলাপ করে এবং তাদেরও দোষী সাব্যস্ত করে। এমনকি আমাদের দুর্নীতি হয়েছে বলে তারা তদন্ত করতে আসে। শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা বোধহয় একটা জিনিস জানেন, ওকাম্পো কিন্তু নিজেই এখন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। এটা কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা। সে কিন্তু এখন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত।

বিশ্ব ব্যাংকসহ চারটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের ওপর ভর করে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প চূড়ান্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার। সেতুর নির্মাণ কার্যক্রম এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়ে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলে বিশ্ব ব্যাংক। টানাপোড়েনের মধ্যে সংস্থাটি অর্থায়ন স্থগিত করলে তদন্ত শুরু করে দুদক। ওই তদন্ত পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাবেক প্রধান আইনজীবী ওকাম্পোর নেতৃত্বে ২০১২ সালে দু’দফায় বাংলাদেশে আসে তিন সদস্যের বিশ্ব ব্যাংকের পর্যবেক্ষক প্যানেল। পর্যবেক্ষক দলের পরামর্শে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে দুদকের করা মামলায় জেল খাটতে হয় সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে। পরে অবশ্য দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে অভিযোগপত্র দেয় দুদক।

২০১৭ সালে কানাডার একটি আদালতও বিশ্ব ব্যাংকের আনা দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগের প্রমাণ পায়নি বলে জানায়। যদিও দীর্ঘদিনের টানপোড়েনে এই প্রকল্পে দাতাদের অর্থায়ন আর হয়নি। বিশ্ব ব্যাংক পর্যবেক্ষক দলের প্রধান গাব্রিয়েল ওকাম্পোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি বিশ্ব ব্যাংকের অন্য অভিযোগের ফলাফল নিয়েও বুধবার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা দুদককে তদন্ত করার নির্দেশ দেই। দুদক তারা তদন্ত করে কোনো দুর্নীতি পায় না। এরপর বিশ্ব ব্যাংক কানাডার আদালতে একটা মামলা করে, এই দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে এসে। কিন্তু কানাডার আদালত সেই তদন্তে কিছুই পায়নি। এবং তারা যে রায় দেয়, সেখানে তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে, বিশ্ব ব্যাংক যে অভিযোগ করেছে সেটা সম্পূর্ণ ভুয়া, মিথ্যা এবং বানোয়াট। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এই সেতু নির্মাণে আমাদের কেউ দুর্নীতি করবে এটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। তাছাড়া, তখন পর্যন্ত বিশ্ব ব্যাংক কিন্তু কোনো টাকাও ছাড় দেয়নি। কিন্তু তারপরেও, আপনারা জানেন, এটা নিয়ে আমাদের কয়েকটা বছর সময় নষ্ট করে।

বিশ্ব ব্যাংক পর্যবেক্ষক দলের প্রধান গাব্রিয়েল ওকাম্পো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রথম প্রধান প্রসিকিউটর ছিলেন। আশির দশকে নিজ দেশ আর্জেটিনার সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের বিচারের সময় ডেপুটি প্রসিকিউটরও ছিলেন তিনি।

সমালোচনাকারীদের সমালোচনা : দুর্নীতির কথিত অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংক সরে যাওয়ার পর সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলে দেশে যারা সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, নাম ধরে ধরে তাদের বক্তব্যের জবাব দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুদ্ধ করে বিজয়ী জাতির মনোবল কেন তাদের নেই, সেই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ যে পারে পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ২০১২ সালে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেওয়ার পর কে কোন ভাষায় তার সমালোচনা করেছিলেন, তার বিস্তারিত তালিকা তুলে ধরেন গতকাল বুধবার সকালে নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে।

প্রথমেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্য তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের এক আলোচনা সভায় বিএনপি নেত্রী বললেন, ‘পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না।’ পদ্মা সেতু হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খানের বক্তব্য মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে যখন সরকারে ছিলাম, তিনি আমাদের অর্থ সচিব ছিলেন। তিনি ২০১২ সালে বললেন, বিশ্ব ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের পক্ষে পরবর্তী ঋণ সহায়তা পাওয়া খুব দুষ্কর হয়ে পড়বে। যখনই কোনো দাতা সংস্থা কোনো নতুন প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহী হবে, তারা দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশকে ভিন্ন চোখে দেখবে। সরকার যদি বিকল্প অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে, তাহলে খরচ অনেক বেড়ে যাবে, কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাবে। শেখ হাসিনা বলেন, আশা করি পদ্মা সেতুর কাজের মান নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। কাজেই, যে কথা তারা বলেছে, এ কথার কোন ভিত্তি নাই। তিনি বলেন, এখানে খালেদা জিয়া আরেকটা কথা বলেছিল, যেটা ছিল ১৭ অক্টোবর, ২০১১। স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশের কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন বাতিল করল। খালেদা জিয়া নিজেই ভুলে গেছে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার প্ল্যান্টের টাকা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বন্ধ করে দিয়েছিল দুর্নীতির কারণে আর সেই দুর্নীতির সাথে তিনি, তার পুত্ররাও জড়িত ছিলেন… এটা আমাদের কথা না, এটা আমেরিকার এফবিআই কিন্তু এই তথ্যটা বের করেছিল। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের টাকা বন্ধ করে দিয়েছিল ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ওই দুর্নীতির কারণে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বদিউল আলম মজুমদার (সুজন সম্পাদক) বলেছিলেন, দুর্নীতি যে আমাদের পেছনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এবং দেশের উন্নয়নের ধারাকে নষ্ট করছে, এই ঘটনা তারই আরেকটি উদাহরণ। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক মামলা করেও কিন্তু দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারে নাই। কিন্তু তারা দুর্নীতি দেখেছে।

শেখ হাসিনা বলেন, ড. আহসান এইচ মনসুর, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেছেন, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করতে পারলেও শেষ করার গ্যারান্টি থাকবে না। আমরা কিন্তু শেষ করেছি, তাকেও দাওয়াত দিচ্ছি। সরকারপ্রধান বলেন, ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি। ‘বিকল্প উৎস হতে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করতে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা দৃষ্টি সরানোর উপায় বলে মনে হতে পারে। যদি এই সিদ্ধান্ত সফলও হয়, তাতেও সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে না।’ বর্তমানে বাংলাদেশের বা আওয়ামী লীগ সরকার আমি চালাচ্ছি। আমাদের গ্রহণযোগ্যতা আন্তর্জাতিকভাবে আছে কিনা আপনারাই বিচার করবেন, বাংলাদেশের জনগণ বিচার করবেন।

শেখ হাসিনা বলেন, প্রয়াত বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী এম কে আনোয়ার বলেছিলেন, ‘নিজস্ব অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতুর মত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করার মতো ক্ষমতা বাংলাদেশের নাই।’ বিএনপি কী বলেছে ওটা আমি ধর্তব্যে নিই না। ওটা বলে আর সময় নষ্ট করতে চাই না। তবে আমাদের অর্থনীতিবিদ বা বড় বড় জ্ঞানী, গুণীরা কি বলছেন, সেটাই আমি বলি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ড. সালেহ উদ্দীন, প্রাক্তন গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক। তিনি বলেছিলেন, ‘নিজ অর্থায়নে সরকার পদ্মা সেতু করার যে পরিকল্পনা করেছে তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তবে সরকার ইচ্ছা করলে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারবে, কিন্তু শেষ করতে পারবে না।’ আমি চাই তাকেও দাওয়াত দিতে। এটা যে শেষ হয়েছে তিনি যেন পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে একটু যান। আমি দাওয়াত দিচ্ছি। সবাইকে দাওয়াত দেব। যারা যারা এই কথা বলেছেন, সবাইকে দাওয়াত দেব বলেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, আইনজীবী শাহদীন মালিক। উনি সব সময়ই স্বাধীন। সব সময় স্বাধীনই থাকেন এবং স্বাধীন মালিক তিনি। শাহদীন মালিক স্বাধীন কথা বলেন। তিনি বলেছেন, ‘পদ্মা সেতু দেশী অর্থায়নে হবে না। সম্ভব নয়।’ সম্ভব হয়েছে। তাকে দাওয়াত দিচ্ছি। তিনি যেন পদ্মা সেতুতে আসেন।

সরকার প্রধান বলেন, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সিপিডি, সম্মানীয় ফেলো। তিনি বলেছেন, ‘এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন, যা জোগান দিতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়বে। এর দায় সরকার এড়াতে পারবে না।’ আমাদের রিজার্ভ কিন্তু এখনো ৪২ বিলিয়ন। আর বৈদেশিক মুদ্রার উপর চাপ পড়েনি। সাথে অন্য প্রকল্পগুলো কিন্তু আমরা করে যাচ্ছি। শেখ হাসিনা বলেন, প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান, সিপিডি, সম্মানীয় ফেলো। তিনি বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু শুরু করা হলে দেশের অন্যসব অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য যে কাজগুলো করা যেত সেগুলো আর হবে না।’ সব কাজগুলো কিন্তু চলছে। কোনটা কিন্তু থেমে যায়নি।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রথম মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান ও দেশের সবচেয়ে বড় পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্যানেলেও নেতৃত্ব দেওয়া প্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন শেখ হাসিনা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজলাবদ্ধতার কারণ খুঁজতে চার সদস্যের কমিটি
পরবর্তী নিবন্ধআজ আওয়ামী লীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী