১২ ই নভেম্বর, ১৯২৭ সালে করটিয়া কলেজ, মুসলিম হোস্টেলের ঠিকানায় কৃষ্ণনগর থেকে মাহফুজুর রহমানকে এক চিঠিতে নজরুল লিখেছিলেন, ‘মানুষ কি আমায় কম যন্ত্রণা দিয়েছে? পিঞ্জরায় পুরে আমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে ওরা– তবুও এই মানুষ,এই পশুর জন্যে আমি গান গাই– তারই জন্যে আছি আজো বেঁচে।’ তাইতো প্রেমের কবি তাঁর রোদের তুলি দিয়ে জ্যোৎস্নার ছবি এঁকেছিলেন মানুষের জন্যে : ‘গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’
মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে তাঁর সৃষ্টির সম্ভার তুলনারহিত। যুদ্ধোত্তোর বিরূপ পরিবেশে দাঁড়িয়েও তিনি গেয়েছেন জীবনের জয়গান। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে শৃঙ্খল ভাঙার সাহস যুগিয়ে অমঙ্গল, অকল্যাণ আর অসত্যের রাহু গ্রাস থেকে মুক্তির জয়গান গেয়েছেন। মানুষ কবিতায় মহা দ্রোহে গেয়েছেন চির সত্যের গান : ‘হায় রে ভজনালয়/ তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়’। মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও, শৈশবে ইসলামী শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েও তিনি বেড়ে উঠেছিলেন এক ধর্মনিরপেক্ষ সত্তা নিয়ে। একইসাথে তাঁর মধ্যে বিকশিত হয়েছিল বিদ্রোহী সত্তাটিও। তাইতো তিনি লিখলেন : ‘আমি ভৃগু, বুকে এঁকে দিয়ে পদচিহ্ন / আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব বিদীর্ণ। ’বস্তুত মানুষকে, মানুষের ধর্মকে নজরুল বড় করে দেখেছেন আজীবন। তিনি চেয়েছেন মানুষের কল্যাণ, সমাজের মঙ্গল এবং স্বদেশের স্বাধীনতা।
তিনি লিখেছিলেন : অবতার পয়গম্বর কেউ বলেননি আমি হিন্দুর জন্যে এসেছি, আমি মুসলমানের জন্যে এসেছি, আমি খ্রিস্টানের জন্যে এসেছি। তাঁরা বলেছেন আমরা মানুষের জন্যে এসেছি– আলোর মত সকলের জন্যে। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে অসামপ্রদায়িক চেতনায় সকল মানুষকে ভালোবাসতেন। তাই যখন খণ্ডিতভাবে তাকে কোন ধর্মের সেবক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, তখন তাঁর কবি সত্ত্বাকে অপমান করা হয়।
চির সাম্যের গান গাওয়া কবি কখনো হয়ে উঠেন অভিমানী কিশোর, আবার কখনো সলাজ পল্লীবালা – ‘আমি চির শিশু, চির কিশোর,/ আমি যৌবন ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর!/ আমি উত্তর বায়ু, মলয়–অনিল, উদাসী পূরবী হাওয়া, আমি পথিক– কবির গভীর রাগিণী, বেনু– বীনে গান গাওয়া!’
নজরুলের বিখ্যাত একটি কবিতা ‘কামাল পাশা’। নজরুল ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় অনেকখানি প্রভাবিত হয়েছিলেন মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্ব দ্বারা। গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার থেকে স্বজাতির মুক্তির লক্ষ্যে আজীবন লড়াই করে গেছেন নজরুল। বাংলা সঙ্গীতের প্রায় সবকটি ধারার পরিপুষ্টি সাধন করে বাণী ও সুরের মালা গেঁথে বাংলা গানকে যথার্থ আধুনিক সঙ্গীতে রূপান্তর করেছিলেন নজরুল। মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসার প্রতিফলন হিসেবে চরম সামপ্রদায়িক দাঙ্গার সময়েও লিখেছেন শ্যামাসঙ্গীত, রামপ্রসাদী, লিখেছেন গজল, হামদ, নাত, ব্যাখ্যা দিয়েছেন তৌহিদের একেশ্বরবাদের।
‘গঙ্গা ঝরে যে শ্রীচরণ বেয়ে, কত দুখ পাই সে চরণ চেয়ে, এ ত্রিতাপ জ্বালা ধরো হে শ্রী হরি, চাহো করুণাসিক্ত নয়নে, হে গোবিন্দ রাখো চরণে’ যেমন তার অপরিমেয় সুর, তেমনি তার অমৃতসম বাণী।
তাঁর লেখা এই গানটি যেমন আমাদের অশ্রুসিক্ত করে, তেমনি ভাবে বিভোর করে তুলে ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই, যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই’ এর মত গানটিও। নজরুল তাঁর অভূতপূর্ব মেধা এবং ভালোবাসা দিয়ে প্রতি মুহূর্তে চেষ্টা করেছেন এ জাতিকে জাগাতে।
মানবতার মুক্তিই ছিল নজরুলের সাধনার বিষয়বস্তু। ধর্মীয় কুসংস্কারকে তিনি অতিক্রম করেছেন মানবিকতার শক্তি দিয়ে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী‘ কবি নামে খ্যাত এই কবির ব্যাতিক্রমধর্মী কবিতার জন্যই ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতার সৃষ্টি সহজ হয়েছিল। নজরুল সাহিত্য এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলায় পরাধীনতা, সামপ্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং দেশী – বিদেশী শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এ কারণে ইংরেজ সরকার তাঁর কয়েকটি বই এবং পত্রিকাও নিষিদ্ধ করে এবং তাঁকে কারাদণ্ডেও দণ্ডিত করে। নজরুলও আদালতে লিখিত রাজবন্দীর জবানবন্দী দিয়ে, টানা চল্লিশ দিন অনশন করে, ইংরেজ সরকারের জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ১৯২২ সালে তাঁর বিদ্রোহী কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর সমগ্র ভারতে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পরে। বিদ্রোহী কবিতাটিতে একদিকে যেমন কবি মানসের দ্রোহের রূপটি ফুটে উঠেছে, অন্যদিকে পরিস্ফুট হয়েছে কবির সরল–মানবিক রূপটিও।
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির–গৃহহারা যত পথিকের, অবমানিতের মরম–বেদনা, বিষ–জ্বালা, প্রিয়–লাঞ্চিত বুকে গতি ফের! ‘৫ই এপ্রিল, ১৯৪১ কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজতজয়ন্তী উৎসবের সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন–
‘আমি নেতা হতে আসিনি, আমি কবি হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম নিতে এসেছিলাম।সে প্রেম পেলাম না বলে এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের মত বিদায় নিলাম।’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বসন্ত গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছিলেন নজরুলকে। আর এতে উল্লসিত হয়ে নজরুল লিখলেন তাঁর অনবদ্য কবিতা ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’। রবীন্দ্রনাথকে দেবতার আসনে বসিয়েছিলেন নজরুল। ‘বড়র পিরীতি’ বালির বাঁধ‘ প্রবন্ধে নজরুল বলেছেন, ‘বিশ্বকবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধা নয়, পূজা করে এসেছি হৃদয় মন দিয়ে, যেমন করে ভক্ত তার ইষ্ট দেবতাকে পূজা করে, তেমনি করেই ছেলেবেলা থেকে তাঁর ছবি সামনে রেখে ফুল, চন্দন দিয়ে সকাল সন্ধ্যা বন্দনা করেছি।’ আজকের দিনে এসে আমরা তাদের সেই উদারতম, ভালোবাসাময় বন্ধনকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাই নির্বিবাদে। তাঁদের দাঁড় করিয়ে দেই একে অন্যের বিরুদ্ধে।
জাতীয় চেতনার দুর্যোগময় একটি মুহূর্ত আমরা পার করছি। অতি সাধারণ বিষয়েও এখন আমরা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর দলে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছি। কারণে অকারণে লালন–রবীন্দ্রনাথ–নজরুলকে দাঁড় করাচ্ছি বিচারের কাঠগড়ায়। এমনি কঠিনতর সময়ে আমাদের সাম্যের কবিকে স্মরণ করছি আরও একবার।
লেখক: প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক।