সুস্থতা : আল্লাহর পক্ষ থেকে বড় নেয়ামত

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শনিবার , ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৮:২৫ পূর্বাহ্ণ

‘আমি কোরআনে যা কিছু নাযিল করি তা হচ্ছে ঈমানদারদের জন্যে (রোগের) উপশমকারী ও রহমত, কিন্তু (এ স্বত্ত্বেও) তা যালেমদের জন্যে ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করে না’-সূরা বনী ইসরাঈল-৮২। সুস্থ দেহ ও মন মহান রাব্বুল ইজ্জতের পক্ষ থেকে বিশাল নেয়ামত ও রহমতস্বরূপ। আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে রোগব্যাধি-বালাই প্রদান করেছেন তাঁর ঈমানের দৃঢ়তা পরখ করার জন্যে-কেননা রোগাক্রান্ত ব্যক্তি অসুস্থতার কবলে পড়ার কারণে যেন বা মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি অসন্তুষ্ট না হন। (নাওযুবিল্লাহ)। আল্লাহতায়ালা নিজেই তাঁর নেক বান্দাদের রোগবালাই দিয়ে থাকেন আবার তা তাঁর ইচ্ছানুযায়ী সারিয়ে নেন। এগুলো মুমিন বান্দাদের জন্য এক পরীক্ষাস্বরূপ। অন্য এক আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর আমি যখন রোগাক্রান্ত হই তখন তিনিই আমাকে রোগমুক্ত করেন’- সূরা আশ শোয়ারা-৮০। অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ, তোমাদের কাছে আমাদের মালিকের পক্ষ থেকে নসীহত (বিশিষ্ট একটি কিতাব) এসেছে, (এটা হচ্ছে) মানুষের অন্তরে যেসব ব্যাধি রয়েছে তার নিরাময় এবং মোমেনদের জন্যে হেদায়াত ও রহমত’-সূরা ইউনুস- ৫৭। গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তি মনে করে থাকেন যে তাঁর জিন্দেগীর হায়াত শেষ হয়ে যাচ্ছে। সে হয়ত আর বেশি দিন বাঁচবেন না- জীবনের গল্পটা খুব ছোট হয়ে যাচ্ছে। তাঁর পৃথিবীর চারপাশ যেন ঘোর অমানিশার মতন আঁধার- কিছুই দেখা যায় না। নিজের পরিজনদের কথা শুধু বারবার তাঁর হৃদয়ে দংশন করতে থাকে এই বলে যে, আমি কি নেক সন্তান রেখে যাচ্ছি? হায়াতে জিন্দেগীভর যে নেক আমলগুলো করেছি তা কি আল্লাহতায়ালা সাদকায়ে জারিয়ার আওতায় আনবেন? যেটি সবচেয়ে বেশি দরকার কবরের জীবনে আর খালেছ নিয়তে যে উপকারী জ্ঞান জীবদ্দশায় আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিতরণ করেছিলাম (মাদ্রাসা/ এতিমখানা/ হেফজখানা/ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান)- তা কি সঠিক পথে ব্যয় হয়েছে? এ তিনটি জিনিস কবরবাসীর সাথে থেকে যায়। এই প্রশ্নগুলো শুধুমাত্র ঘুরপাক খায় অসুস্থ ব্যক্তির মননে। সে যেন দেখতে পায় আঁধারের পরিবেশ- হিসাব মেলায় প্রতিটি মূহূর্তের-কত অন্যায়-কত পাপ-পিতা-মাতার হক- আত্নীয়-স্বজনের হক- ভাই-বোনদের হক- প্রতিবেশির হক কি সঠিক পথে পালন করতে পেরেছি? আত্নীয়-স্বজনের সাথে সু-সম্পর্ক স্থাপনে কোন দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে কি? সুদি ব্যাংকের সাথে কোন লেনদেন ছিল কি? অথবা আমার কষ্টার্জিত সারা জিন্দেগীর উপার্জনে সূদের কিঞ্চিৎ ছোঁয়া লেগে আছে কি? কারণ, সূদের ভয়াবহতা অত্যন্ত গুরুতর। সূদে রয়েছে ৭৩টি গুণাহ। সর্বনিম্ন গুণাহ নিজ মায়ের সাথে যেনা করা। সর্ববৃহৎ গুণাহ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) এর সাথে যুদ্ধ করা, ‘আর যদি তোমরা এমনটি না করো, তাহলে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে (তোমাদের বিরুদ্ধে) যুদ্ধের (ঘোষণা থাকবে)’-সূরা আল বাকারা- ২৭৯। ‘মহান আল্লাহতায়ালা সূদ নিশ্চিহ্ন করেন, আর দান সদকাকে তিনি (উত্তরোত্তর) বৃদ্ধি করেন’ সূরা আল বাকারা- ২৭৬। অন্য এক আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা সূদ খায় তারা (মাথা উঁচু করে) দাঁড়াতে পারবে না, (দাঁড়ালেও) তার দাঁড়ানো হবে সে ব্যক্তির মতো, যাকে শয়তান নিজস্ব পরশ দিয়ে (দুনিয়ার লোভ লালসায়) মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে;….. আল্লাহতায়ালা ব্যবসা হালাল করেছেন এবং সূদকে হারাম করেছেন’- সূরা আল বাকারা- ২৭৫। নিজের সরকারি চাকরি জীবনের কর্মক্ষেত্রে কোন ফাঁকি দেওয়া হয়েছে কি? এবং অনুপস্থিতির বদলে প্রদত্ত বেতনগুলো কোন পর্যায়ে পড়ে- হারাম কিংবা হালাল। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যদি সংশ্লিষ্ট চাকরিজীবীর উপর সন্তুষ্ট থাকে তাহলে হয়ত এই যাত্রায় বাঁচা যেতে পারে- অনেক বিজ্ঞ মুফতিদের অভিমত। অন্য এক ধর্ম বিশারদের অভিমত: সরকারি মেইল ট্রেনের টিকেট খরিদ করে গন্তব্যস্থলে না গিয়ে নির্ধারিত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া। এটি নিয়ে অনেক মতবিরোধ রয়েছে। সর্বোচ্চ ফয়সালাকারী মহান আল্লাহতায়ালা। বেসরকারি চাকুরিজীবীদের ক্ষেত্রেও একই। কর্মস্থলে না গিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে পারিবারিক কাজে ব্যস্ত থাকা-এটিও অসুস্থ বেসরকারি চাকুরিজীবির মাথায় ঘুরপাক খায় তখন। অসুস্থ ব্যক্তি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসে জিন্দেগীর হিসাব মেলাতে চেষ্টা করে- নিজ ভাই-কিংবা প্রতিবেশির জমি-দখল করেছে কি-না। মানুষের সাথে অসদাচরণ করেছে কিনা? সারাক্ষণ অন্যের গীবত করেছে কিনা? মিথ্যা কথা নিয়ে জিন্দেগীভর ব্যতিবস্ত ছিল কিনা? অসুস্থ ব্যক্তি যদি আইনজীবি হয় তাহলে খুনের আসামীকে জামিন দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর অনবদ্য সহযোগিতা ছিল কিনা? ইসলামিক স্কলার কিংবা সৎ ও নিরীহ ভালো মানুষদের ধর্ষণ মামলার আসামী সাজিয়ে/ খুনের মামলার আসামী সাজিয়ে/ মাদক ব্যবসার মামলা সাজিয়ে জেলে নিক্ষেপ করে আসামী করার ক্ষেত্রে তাঁদের ব্যাপক ভূমিকা আছে কিনা? মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে আসামীকে জামিন দেওয়া কতটুকু ন্যায়সঙ্গত- সেই ভাবনাটুকুন অসুস্থ আইনজীবীকে কি কুঁড়ে কুঁড়ে খায় তখন? যে বিচারক আল্লাহর বিধানের বিপরীত আইন অনুযায়ী ও মানুষের রচিত বিধান মোতাবেক বিচার ফয়সালা করে সেই অসুস্থ বিচারককে সেই কঠিন কেয়ামতের দিন মহাবিচারকের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে- সেই চিন্তাটুকুন পেয়ে বসে কি না? খুনের আসামীকে বেকসুর খালাস দিয়ে তিনি কি অপরাধ করলেন না? তাঁর কলমের খোঁচায় অনেক নিরাপরাধ আলেম-ওলামার কি জেল ফাঁসি হয়নি? এই নির্মম সত্য কথাগুলো কি মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মনে আসে? ‘যারা আল্লাহর নাযিল করা আইনুযায়ী বিচার ফয়সালা করে না, তারাই হচ্ছে কাফের’ সূরা মায়েদা-৪৪। একই সূরায় ৪৫ ও ৪৭ নয় আয়াতে তাদেরকে আল্লাহতায়ালা যথাক্রমে যালেম ও ফাসেক হিসাবে অভিহিত করেছেন। সে অসুস্থ ব্যক্তি যদি ডাক্তার হয় তাহলে তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে, জিন্দেগীতে কতই না কমিশন-বাণিজ্য করেছি? অপারেশনের ওহফরপধঃরড়হ না থাকলেও অপারেশন করে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করা, সাধারণ রোগীদের সাথে বিনা কারণে দুর্ব্যবহার করা। ভুলবশত অপারেশনস্থলে গজ, কেঁচি ইত্যাদি রেখে আসা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত অপারেশনের চার্জ আদায় করা, রোগীর চেম্বার থেকে অসুন্তুষ্ট হয়ে রোগী বের হয়ে আসা (রোগী নিজে পছন্দমত কথা বলতে না পারা ইত্যাদি)। ভুক্তভোগী রোগী যদি আল্লাহর আদালতে সেই ডাক্তারের বিরুদ্ধে মামলা করে? সেই কঠিন চিন্তাটুকুন অসুস্থ ডাক্তারকে কি কুঁড়ে কুঁড়ে খায় না তখন? যদি প্রকৌশলী/স্থপতি হন তাহলে ভেজাল সামগ্রী দিয়ে ভবন নির্মাণে নিজের পূর্ণ অবদান, নির্মাণ ত্রুটি রেখে আসা- পরবর্তীতে বৃষ্টির পানিতে ভবনে ফাটল কিংবা পানি চুবিয়ে চুবিয়ে কক্ষে প্রবেশ করা ইত্যাদির জন্যে কাল কঠিন ময়দানে আল্লাহর আদালতে যদি সেই ভবন নির্মাণকারী মালিক মামলা করে- এই চিন্তাটুকুন কি তখন মাথায় ঘুরপাক খায়? যে সব ব্যাংকার সুদি ব্যাংকে চাকরি করেন তারা কি চিন্তা করেছেন তাদের উপার্জন বৈধ? যদিও বা ইসলামী ব্যাংকিং এর নিয়মে চলা ব্যাংকগুলোও কি কতটুকু পরিশুদ্ধ? সেখানেও তো শরীয়াহ্‌ বোর্ড রয়েছে। আর এই দায়ভার তাদেরই নিতে হবে। অসুস্থ ব্যাংকারদের মাথায় হয়ত এসব অসঙ্গতি ঘুরপাক খায় প্রতি মুহূর্তে। আমার জীবনে ঘটেছিল এই মর্মান্তিক পরিবেশ কয়েকবার। সর্বশেষ করোনার ভয়ঙ্কর ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টাতে কুপোকাত হয়েছি। তখন এই বিষয়গুলো বারবার আমাকে নাড়া দিত। স্বজনরা আসতো- সান্ত্বনা দিত। কিছু কিছু মানুষের কথা জিন্দেগীভর মনের ভেতর গেঁথে থাকবে। আর কিছু কিছু মানুষ যাদেরকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছি- যারা খোঁজটুকুন রাখলো না- তাদের জন্যে হৃদয়উৎসারিত দোয়া রইল। চাই না পার্থিব বিনিময়। এই অসুস্থতা আমাকে বানিয়েছে খোদাভীরু- অর্জন করেছি খোদাভীতি-মহান আল্লাহতায়ালাকে জেনেছি আরো গভীর থেকে। হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, ‘রাসূল (সাঃ) বলেন, আল্লাহ এমন কোন রোগ সৃষ্টি করেননি, যার নিরাময় উপকরণ তিনি সৃষ্টি করেননি’। (সহীহ বুখারি- ৫৬৭৮)। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি ১৯৯৩ সালের ১৮ অক্টোবর। আল্লাহর জমিনে, আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে যারা মেহনত করে তাদের ঝাঁঝরা গুলিতে আহত হয়েছিলাম। মহান রাব্বুল ইজ্জত আমার হায়াতকে দারাজ করেছেন। ৩০ বছরের অধিককাল ধরে বীর প্রসবীনি রাউজানের দুস্থ অসহায় মানবতার কল্যাণে কাজ করে আসছিলাম জননন্দিত সমাজহিতৈষী সংগঠন রাউজান ক্লাবের ছত্রছায়ায়। এক ঝাঁক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ যুবক নিয়ে ১৯৮৭ সালের ২ আগস্ট গঠন করেছিলাম রাউজান ক্লাব- যেটি উত্তর চট্টগ্রামের একটি প্রসিদ্ধ সংগঠন হিসাবে জনমানুষের কাছে বারবার সমাদৃত হয়েছে এবং স্বীকৃতি পেয়েছে। শুধুমাত্র আরশে-আজিমের মালিকের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এই কন্টাকাকীর্ণ পথ চলা- কোন ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে নয়। অথচ আজ সেই ঐতিহ্যমণ্ডিত রাউজান ক্লাব কালের সাক্ষী হয়ে আদালত ভবন এলাকায় অর্ধমৃত অবস্থায় ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সহায়তাপ্রাপ্ত পথচারীপানে। তবে ব্যক্তিগত জীবনে এক মহাপ্রলয় সঞ্চারিত হয়েছে এই অবেলায়। মনের ভেতর যে পাপের যে মশাল জ্বালিয়েছিলাম, হারাম/হালালের পরখ বুঝতে অক্ষম ছিলাম জিন্দেগীভর, মহাশক্তিমান আল্লাহর কোরান ও প্রিয় রাসূল (সাঃ) এর নসিহা বিষয়ক বিশুদ্ধ বর্ণমালাসমূহের অবর্তমান ছিল এ যাবৎ। সেগুলো পরিচর্যার বিশাল সুযোগ এসেছে এসময়- বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী, মহাবিশ্বের সিপাহশালার, আরশে আজিমের একচ্ছত্র অধিপতি আমার আল্লাহতায়ালার খুব কাছাকাছি যাওয়ার বর্ণাঢ্য সুযোগটা হয়েছে এবেলায়- এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে দুষ্প্রাপ্য সনদ। শেষ রাতে ডুকরে উঠি, কাঁদি আর বলি, হে আল্লাহ অন্তহীন সুস্থতার পরশে সাজিয়ে দাও আমায়। আমিন।

লেখক : সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি)
জেনারেল হাসপাতাল, রাঙামাটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধবর্ণমালা
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে