সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে স্বদেশ : অর্জন ও আগামীর প্রত্যাশা

লালন কান্তি দাশ | শনিবার , ৯ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতা যে কোনো পরাধীন জাতির নিকট আজন্ম লালিত স্বপ্ন। বাঙালির পরাধীনতার ইতিহাস ছিল সুদীর্ঘকালের। অবশেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে ১৯৭১ সালে অর্জিত হয় বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় সত্যিকার অর্থেই ছিল এক অপার বিস্ময়ের নাম। ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগে আমরা পেয়েছি নিজস্ব পতাকা, নিজস্ব ভূখণ্ড আর স্বাধীন জাতিসত্তার পরিচয়। আমরা আজ মুক্ত ভূমিতে দাঁড়িয়ে যে নিঃশ্বাস নিতে পারছি, মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারছি এসব কিছুর জন্য আমাদের পূর্বসূরীদের কাছে আমরা ঋণী। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন ছিল দারিদ্র মুক্ত, শোষণ মুক্ত স্বদেশের। স্বপ্ন ছিল একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার। পেরিয়ে গেছে স্বাধীনতা অর্জনের ৫০টি বছর। বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতি উদযাপন করেছে স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী।
একটি রাষ্ট্রকে মূল্যায়নের জন্য পঞ্চাশ বছর খুব বেশি সময় হয়ত নয়, তবে একেবারে কম এ কথাও বলা যায় না। এই অর্ধশতকে অর্জিত হয়েছে অনেক কিছুই। ধারাবাহিক অগ্রগতি ও উন্নয়ন এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশনসহ নানান সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক। গত ৫০ বছরে দেশে বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। কৃষিক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, নদীর তলদেশে টানেল কোনোটি এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। মানুষের মাথাপিছু আয় ও গড় আয়ু বেড়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিঃসন্দেহে অনেক বড় প্রাপ্তি। দেশ ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে। স্বল্পোনত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে । ফলে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি দিন দিন উজ্জ্বল হচ্ছে।
৫২ বছরের এই যাত্রাপথে প্রাপ্তির পাশাপাশি অপ্রাপ্তি কিংবা হতাশার চিত্রও রয়েছে। তাই আমাদের পাড়ি দিতে হবে এখনো অনেক পথ। এদেশের বিপুল জনগোষ্ঠী এখনো দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। বেকারত্বের অভিশাপে এখনো ধুঁকছে লাখো তরুণ। দুর্নীতি এখনো সমাজের শিরা- উপশিরায় বহমান। ক্ষমতা এদেশে অনেক সময় মানুষকে শোষণ-নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় দেশে সাম্প্রদায়িক উগ্রপন্থার বিস্তার ঘটেছে শুধু তা নয়, মাঝেমধ্যে এই অপশক্তি ফণা তুলে ছোবল দিয়ে অশান্তির বিষবাষ্প ছড়ায়। মনে রাখতে হবে সুউচ্চ ইমারত, ব্রীজ কিংবা ফ্লাইওভার নির্মাণ একটি দেশের উন্নতির একমাত্র মানদণ্ড নয়। একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সুশাসন প্রতিষ্ঠা। বাক স্বাধীনতা ও ভোটের অধিকার সুরক্ষিত করা না গেলে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ উপলব্ধি হবে না কখনো। এ লক্ষ্যে রাজনীতিতে পেশীশক্তি, কালো টাকা আর মন্দ লোকের অনুপ্রবেশ রোধ করতে হবে সর্বাগ্রে। ইতিবাচক ও সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। তাই মেধাবী, যোগ্য ও সত্যিকারের দেশপ্রেমিক লোকদের নেতৃত্বে আসা জরুরি। রাজনীতির লক্ষ্য হতে হবে দেশ ও মানুষের কল্যাণে। বহু ধারায় বিভক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম একমুখী ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তন সময়ের দাবী। বেকারত্ব দূরীকরণে প্রয়োজন কারিগরি শিক্ষার প্রসার। শিক্ষার বাণিজ্যকরণ রোধকল্পে নাগরিকদের শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। সকল নাগরিকের জন্য মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করা না গেলে স্বাধীনতা অর্জন কখনো অর্থবহ হবে না। মাথাপিছু আয় কিংবা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে তৃপ্তির ঢেঁকুর না তুলে, মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে সকলকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যেতে হবে। সকল প্রকার দুর্নীতিকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে সমাজ থেকে। নারীর প্রতি সহিংসতা রুখতে হবে সম্মিলিতভাবে। আমাদের জনশক্তির অর্ধেক হল নারী। তাই নারীদের পেছনে বা অন্ধকারে রেখে জাতির সামগ্রিক অগ্রগতি কখনো সম্ভব নয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও কলকারখানা স্থাপন করে সবার কাজের সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি। মানুষকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করতে হবে। মত পার্থক্য থাকলেও ভিন্ন মতের প্রতি সবার শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও বৈষম্যের অবসান দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নেবে।সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা ও দেশীয় ঐতিহ্যকে লালন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ ও সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা জাতির মহান দায়িত্ব। বিশ্ব রাজনীতির জটিল সমীকরণ মাথায় রেখে দেশের স্বার্থকে অক্ষুণ্ন রেখে প্রতিবেশীসহ সকল রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে কৌশলী হতে হবে। মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমবোধ জাগ্রত করা গেলে অন্যায়-অনিয়ম অনেকাংশে হ্রাস পাবে। সর্বোপরি সঠিক ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা, দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হলে প্রত্যাশিত উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব কিছু নয়। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের পর্যায়ে নিয়ে যাবার যে স্বপ্ন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বাঙালি জাতিকে দেখাচ্ছেন, সে লক্ষ্যে সবার সম্মিলিত চেষ্টা ও অবদানে সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির শীর্ষে পৌঁছে যাবে প্রিয় স্বদেশ-এটাই সকলের প্রত্যাশা।
লেখক: প্রভাষক, নোয়াপাড়া কলেজ, রাউজান, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদ্রব্যমূল্য সমতায় রাখার অনুরোধ
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে