সুন্দর দাঁতের জন্য অর্থোডন্টিক ট্রিটমেন্ট

ডা. মোঃ কামরুল হাসান | শনিবার , ২২ মে, ২০২১ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

সুন্দর দাঁত আর মধুর হাসি কে না চায়! কিন্তু সব সময় এই ইচ্ছে পূর্ণ হয় না। তাহলে? অপছন্দের দাঁত নিয়েই সারা জীবন কাটিয়ে দেবেন আর আক্ষেপ করবেন? মোটেই না। আর তার জন্যেই রয়েছে নানা রকম অর্থোডন্টিক ট্রিটমেন্ট। আসমান, উঁচু-নীচু, আঁকা-বাঁকা ও ফাঁকা দাঁতের সমস্যায় কী করণীয় তারই বিশদ আলোচনা।
অর্থোডন্টিক্স হলো দন্তচিকিৎসার একটি বিশেষায়িত বিভাগ যা দাঁত ও চোয়ালের ত্রুটিযুক্ত রোগ নির্ণয়, (যেমন- উঁচু-নীচু, আঁকা-বাঁকা ও ফাঁকা) প্রতিরোধ এবং সংশোধন করে। এটি মুখের বৃদ্ধি সংশোধন করার দিকেও মনোনিবেশ করে, যা ডেন্টোফেসিয়াল অর্থোপেডিক্স নামেও পরিচিত।
দাঁতের অর্থোডন্টিক চিকিৎসা কি সেটি নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেন বিভিন্ন সময়। দাঁতের অর্থোডন্টিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে মূলত আঁকা-বাঁকা দাঁত, ফাঁক হয়ে যাওয়া দাঁত, উঁচু-নীচু দাঁতকে রিমুভেবল প্লেট বা ফিক্সড ব্রেস পরিয়ে আস্তে আস্তে সহনীয় মাত্রায় চাপ প্রয়োগ করে দাঁতগুলোকে একত্রিত করা হয় যাতে আপনার সেরা সুন্দর হাসিটি সবাইকে উপহার দিতে পারেন। আঁকা-বাঁকা বা এলোমেলো দাঁতের চিকিৎসায় অর্থোডন্টিক চিকিৎসা এখন জনপ্রিয় ও নিরাপদ।
দাঁত আঁকা-বাঁকা হওয়ার পেছনের কারণ : প্রথম কারণ বংশগত- বাবা-মা, দাদা-দাদী ও নানা-নানি এদের যদি এই সমস্যা থাকে তখন বাচ্চার দাঁত আঁকা-বাঁকা হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, কিছু কিছু সিস্টেমিক অসুস্থতার জন্যও এই সমস্যা হতে পারে।
তৃতীয়ত বাচ্চাদের মুখে সাধারণত জন্মের ৬ মাস পর হতে ২ বছর পর্যন্ত ২০টি দুধের দাঁত আসে। এই দুধ দাঁতগুলো পড়ে গিয়ে স্থায়ী দাঁতগুলো মুখের ভেতর আসে। কোনো কারণে যদি এই দুধের দাঁত সময় মতো না পড়ে বা আগেই পড়ে যায় তাহলে নিচে যে স্থায়ী দাঁতটা থাকে সে শেকড় দ্বারা পরিবেষ্টিত পথ হারিয়ে ফেলে। আর ঠিক জায়গামতো উঠতে পারে না। মাঝামাঝি উঠে, কখন বাইরে চলে যাচ্ছে, কখনো ভেতরে চলে যায়, যেখানে জায়গা পায় সেখানে চলে আসছে। ফলে দাঁত আঁকা-বাঁকা হচ্ছে।
আর আরেকটি বিষয় হলো বংশগত বাবা-মা, দাদা-দাদী ও নানা-নানি এদের যদি এই সমস্যা থাকে তখন বাচ্চার দাঁত আঁকা-বাঁকা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে করতে হবে কি, যখন দুধের দাঁতটা পড়ে স্থায়ী দাঁত আসবে তখন খেয়াল রাখতে হবে যেন সমস্যা না হয়। অনেক সময় একটি দাঁত ফেলে দিলাম, এরপর হয়তো আরেকটি দাঁত ফেললাম পরে স্থায়ী দাঁতগুলো ঠিকমতো এলো। একে আমাদের ভাষায় বলে সিরিয়াল এক্সট্রাকশন। এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা যদি নেওয়া হয় তাহলে আমাদের আঁকা-বাঁকা দাঁত হওয়া প্রতিরোধ করা যায়।
তাহলে দুধের দাঁতগুলো রক্ষা করা ও খেয়াল রাখা বড় বিষয়।
কখন থেকে একজন অর্থডনটিস্টের কাছে যাওয়া উচিত : এই বিষয়টিকে আমরা চার ভাগে ভাগ করে থাকি। প্রথমটি হলো প্রতিরোধ, যেন দাঁতগুলো আঁকা-বাঁকা হতে না পারে। এ ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে ছয় বছরে প্রথম একটি শিশুকে অর্থডেনটিস্টের কাছে নিয়ে যাব।
এরপর আট থেকে নয় বছর বয়সে দেখাব তাকে বলে ইন্টার সেপটিভ অর্থোডোনটিঙ। যেন যেই দাঁতটা আঁকা-বাঁকা তৈরি হয়ে যাচ্ছে সেটা বেশি খারাপ না হতে পারে।
তৃতীয় হচ্ছে ১২ বছর থেকে কারেক্টিভ চিকিৎসা শুরু হয়।
অনেকেরই ভুল ধারণা রয়েছে চিকিৎসা ১৬ বছরের নিচে করা যাবে না। এটা একদমই ভুল। এই চিকিৎসার জন্য ভালো সময় হলো ১১ থেকে ১৩ বছর।
মোদ্দাকথা, দুধের দাঁত পড়ে গিয়ে যখনই স্থায়ী দাঁত উঠবে তখনই চিকিৎসা শুরু করা উচিত, দেরি না করে। তাহলে দাঁত সুন্দরভাবে সাজানো যায়। এর মানে অবশ্যই ১১ থেকে ১৩ বছরের মধ্যেই আঁকা-বাঁকা দাঁতের চিকিৎসা শুরু করতে হবে। অর্থডেনটিস্টের কাছে যেতে হবে। উনিই বলে দেবেন কখন চিকিৎসা শুরু করবে।
দাঁত ও চোয়ালের ত্রুটি খুব গুরুতর হলে চোয়ালের অস্ত্রোপচার করাও লাগতে পারে এটি হলো সার্জিক্যাল অর্থোডন্টিক্স।
তাই এই চিকিৎসা সাধারণত প্রাপ্ত বয়সে পৌঁছানোর আগেই শুরু করা উচিত যেহেতু শিশুদের হাঁড়গুলি খুব সহজেই সরানো যায়।
আঁকা-বাঁকা দাঁত হলে কী কী ধরনের সমস্যা হতে পারে : দাঁতগত অসুবিধা অবশ্যই আছে। যাদেরই আঁকা-বাঁকা দাঁত তারা যতই ব্রাশ করুক যে দাঁতটা ভেতরে থাকে সেটা পরিষ্কার করা যায় না। ব্রাশ না লাগলে দাঁত কালো কালো হয়ে যায়, দাগ হয়ে যায়। সেখানে স্টেইন পড়ে, পরবর্তীকালে পাথর হয়। তখন জিনজিভাইটিস হয়। মুখে থেকে দুর্গন্ধ আসা, রক্ত পড়া, পুঁজ আসে। এটা আঁকা-বাঁকা দাঁতের একটা বড় সমস্যা। যখনই একটা দাঁত উঁচু থাকে তখন দাঁতের গোড়া ধীরে ধীরে করাতের মতো ক্ষয় হয়ে যায়। এতে দাঁতে শিরশির করে। এতে আস্তে আস্তে দাঁতে রুট ক্যানেল করা লাগতে পারে, দাঁত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
দাঁতকে সুন্দর রাখলে হাসতেও ভালো লাগবে, দেখতেও ভালো লাগবে। আর সৌন্দর্যের জন্য আপনি যতই সাজেন, যত কিছুই করেন হাসিটা তো একটা মাধ্যম সৌন্দর্য প্রকাশের। কারো সাথে যখন দেখা হয় প্রথমেই আমরা মিষ্টি করে হাসি। সুন্দর হাসির জন্য সুন্দর দাঁত অতি প্রয়োজনীয়।
আঁকা-বাঁকা দাঁতের চিকিৎসা যদি করা না হয় তবে- এর জটিলতা : যখনই ক্যালকুলাস হয়ে, জিনজিভাইটিস বৃদ্ধি পায় তখনই দাঁত দ্রুত পড়ে যায়। তখন দেখা যায় দুই দাঁতের মাঝখানে ক্ষয় হয়ে যায়। দুই দাঁতের মাঝখানে যখন কালো কালো দাগ হয়ে যায় এটা ফিলিং করাও যায় না। একটু বয়স হয়ে গেলে দাঁত আঁকা-বাঁকা থাকলে দাঁত বাঁধানোও যায় না। দাঁতের কারণে যদি না খেতে পারেন তাহলে শারীরিকভাবেও দুর্বল হয়ে যাবেন।
বলা হয়, ‘স্বাস্থ্য সকল সুখের মূল’। স্বাস্থ্যের সাথে খাবারের একটা সম্পর্ক আছে। আর খাবার চাবানোর সাথে দাঁতের একটা সম্পর্ক আছে। যদি সারাজীবনই আপনি দুধ খান, না চাবিয়ে খাবার খান তাহলে কী ভালো লাগবে?
আর পৃৃথিবীতে যত মজার খাবার প্রতিটি জিনিসই আমরা চিবিয়ে খাই। তাই দাঁত ঠিক করা খুব প্রয়োজন।
এছাড়াও টেম্পোরোম্যান্ডিবুলার জয়েন্টে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা, আথ্রাইটিসসহ নানাবিধ জটিল সমস্যা হতে পারে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগীরা ভয় পান দাঁত ফেলা নিয়ে ও বিভিন্ন ব্রাসেস, ব্রেকেট- এগুলো পড়ে থাকতে। এই বিষয়ে ঝামেলা মনে করে আর কতদিন ধরে পড়ে থাকতে হবে : যদি আপনার দাঁত পর্যাপ্ত ফাঁকা থাকে তাহলে দাঁত ফেলে দেওয়ার প্রয়োজন নাই।এখন যদি বেশি আঁকা-বাঁকা থাকে তাহলে সুন্দর করে সাজানোর জন্য প্রয়োজনীয় দাঁতটা ফেলে দেই। এই ফাঁকাটা বন্ধ হয়ে যায়। এটা একটা বড় ব্যাপার।
আর দ্বিতীয় বিষয় হলো সময়। এই চিকিৎসার জন্য কম করে হলেও দেড় বছর সময় লাগে। এটা তাড়াহুড়া করে করার বিষয় না। তাই সময় দিতে হবে।
আঁকা-বাঁকা দাঁতের চিকিৎসার পর, দাঁত যাতে নষ্ট না হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে করণীয় : আঁকা-বাঁকা দাঁত যেমন সুন্দর করে সাজানো যায় সেটাকে ধরে রাখা কঠিন। যদি এই চিকিৎসা ১১ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে শুরু করা হয় এবং সেটা যদি ১৫ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যায় তাহলে কোনো রকম সম্ভাবনা নাই এটা সরে যাওয়ার। তবে এটা যখন আপনি প্রাপ্ত বয়সে শুরু করব তখন নতুন করে তো দাঁত ওঠার সুযোগ নেই। এই জায়গাটিকে ধরে রাখতে হবে অনেক দিন। ধরে রাখার জন্য একটা রিটেইনার ব্যবহার করি যার কারণে দাঁতটা বসে যায়। যদি বসে যায় তখন আর এটা নড়াচড়া করবে না। বসার জন্য সময় দিতে হবে। দেড় থেকে দুই বছর এবং কারো কারো ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সারা জীবন রিটেইনার ব্যবহার করা লাগতে পারে। সেটি ক্ষেত্র বিশেষে।
সুন্দর হওয়ার জন্য রিটেইনারকেও একটা সৌন্দর্যের অংশ মনে করতে হবে।
এই অর্থোডোনটিক্স চিকিৎসা কারা করতে পারে : একজন ডাক্তার ৫-৬ বছর কোন মেডিকেল কলেজ বা ডেন্টাল কলেজ এ পড়াশোনা শেষ করে বিডিএস ডিগ্রি অর্জন করে ডেন্টিস্ট হয়।
বিডিএস ডিগ্রি অর্জন এর পরে আরো ৫-৬ বছর অর্থোডন্টিক্স বিষয়ে পড়াশোনা করে এফসিপিএস অথবা এমএস ডিগ্রি অর্জন করার পরে কেবলমাত্র একজন ডেন্টিস্ট বিশেষজ্ঞ অর্থোডন্টিস্ট হতে পারে এবং এই বিশেষজ্ঞ অর্থোডন্টিস্টরাই অর্থোডনটিক্স চিকিৎসার জন্য একমাত্র ও নির্ভরযোগ্য চিকিৎসক।

লেখক : সহ-অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (এক্স)
অর্থোডন্টিক্স বিভাগ, চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল ডেন্টাল কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমাজে-রাজনীতিতে অবক্ষয় যেন জেঁকে বসেছে আজ
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে