সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে

| সোমবার , ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

অবশেষে সমস্ত ধোঁয়াশা কেটে গেলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বার্তা চলে এলো সবার কাছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আর বাড়ছে না। ১৮ মাস পর ১২ সেপ্টেম্বর থেকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান শুরু হবে। চলতি বছরের শুরুতেই ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছিল। তাদের ভাষ্য অনুসারে, আরো একবছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার প্রভাব মোকাবেলা করতে পারবে না শিশুরা। ইতিমধ্যে বিশ্বের ৯০ভাগ দেশই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে। ইউনিসেফ ও ইউনেস্কোর যৌথ বিবৃতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে আর অপেক্ষা না করতে বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়েছিল। তাদের বিবৃতি অনুসারে এখনো বিশ্বের ১৯ টি দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। করোনা লকডাউনের বন্ধের ক্ষেত্রে স্কুলগুলো সবার শেষে এবং খোলার ক্ষেত্রে সবার আগে, এমন নীতি গ্রহণের পক্ষে মত দিয়েছে ইউনিসেফ ও ইউনেস্কো। আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় পাবলিক পরীক্ষাগুলো নিয়ে হতাশা ও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। দেশের সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার যে সুদূরপ্রসারি ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে তা উত্তরণের কোনো উপায় আমাদের হাতে নেই। গার্মেন্ট কর্মী ও বিদেশগামীদের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক টিকা নিশ্চিত করার উদ্যোগ দেখা গেলেও বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকা নিশ্চিত করার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
বার্নার্ড শ বলেছিলেন, কেউ কাউকে কিছু শেখাতে পারে না; উপযুক্ত পরিবেশে মানুষ নিজের শিক্ষা নিজেই অর্জন করে। শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো কেবল লেখাপড়া করার স্থান নয়। সামাজিক সমপ্রীতি, পারস্পরিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসী হওয়ার উপযুক্ত পরিসরের নামই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
মহামারি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা না খোলা নিয়ে নানা মত ছিলো শিক্ষাসংশ্লিষ্ট মানুষের। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, জনসংখ্যার বড় অংশকে গণটিকার আওতায় না আনা পর্যন্ত করোনা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসবে না। সেটা দুই বছর পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। তাই শিক্ষার বহুমাত্রিক ক্ষতির সমাধানে আর সময়ক্ষেপণ করা যাবে না। ক্ষতি যা হওয়ার তা আর কোনোক্রমেই বাড়তে দেয়া যায় না। তাঁরা খোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
করোনার এই সময়ে শহরের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে পড়াশোনার সীমিত সুযোগ পেলেও গ্রামের শিক্ষার্থীরা একেবারেই বঞ্চিত। সামপ্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীই অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রমে অংশ নেয়নি। আর আমাদের দেশে এই ভার্চুয়াল পড়াশোনা দিয়েও কাজের কাজ কিছুই হয় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ঘরবন্দি শিক্ষার্থীদের শুধু যে পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে তা-ই নয়, পাশাপাশি শারীরিক এবং মানসিক বিকাশও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ছোট থেকে বড় প্রায় সবাই ভার্চুয়াল জগতে আসক্ত হয়ে পড়েছে, আসক্ত হচ্ছে অন্যকিছুতেও।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুরা মনোযোগ হারাচ্ছে পড়াশোনায়। বিষণ্নতা, একাকিত্ব, উদ্বেগ আর মানসিক চাপে শিক্ষার্থীরা হারিয়ে ফেলছে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা। এমনকি আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যা-প্রবণতার মতো মানসিক ব্যাধিও লক্ষ করা যাচ্ছে। অর্থনীতির চাকা চালু রাখার পাশাপাশি শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, আচরণগত পরিবর্তনের কারণে মহামারি পরবর্তী জীবনেও খাপ খাইয়ে নিতে মারাত্মক অসুবিধার সৃষ্টি হবে। শিক্ষার্থীদের সুস্থ স্বাভাবিক বিকাশে পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উভয়েরই সমান দায়িত্ব এবং গুরুত্ব রয়েছে। বর্তমানে পরিবারের কাঁধে পুরো দায়িত্ব এসে পড়ায় পরিবারগুলো এককভাবে এই গুরুদায়িত্ব পালনে হোঁচট খাচ্ছে। শিক্ষার বহুমুখী ইতিবাচক দিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সামাজিকীকরণ।
একটি শিশু সামাজিকভাবে গড়ে না উঠলে সে যত বড় বিদ্বানই হোক না কেন, সংকীর্ণতার ঘেরাটোপে বন্দি থাকবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সামাজিকীকরণের জায়গায় পরিবারগুলোও ব্যর্থ হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে অতিরিক্ত চাপে পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে তাকে সাথি করেই পথ চলতে হবে। সেটাই হবে নতুন স্বাভাবিক জীবন। ইতোমধ্যে অন্য খাতগুলো শুরু হয়েছে শুধু শিক্ষা খাত ছাড়া। হাটবাজার, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, গণপরিবহন সবই খুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। যা হোক, এখন যে সিদ্ধান্ত এলো খুলে দেওয়ার, তাকে স্বাগত জানাই আমরা। আমরা মনে করি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ না রেখে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কেননা, আধুনিক সভ্যতার প্রধানতম ভিত্তি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে