সুধাকণ্ঠ প্রেম

মহুয়া ভট্টাচার্য | শনিবার , ৫ নভেম্বর, ২০২২ at ৬:৫৩ পূর্বাহ্ণ

পর্ব ৩
সম্পর্কের প্রতি নির্মোহ আত্মদাম্ভিক ভূপেন হাজারিকা। তিনিই আবার গড়িয়া হাটের মাছের বাজারে মাছ কিনতে গিয়ে মাতিয়ে তুলেছিলেন- ‘সাগর সঙ্গমে’, ‘জীবন খুঁজে পাবি’-গানের সুরে। গান শুনিয়ে জেলেদের উপহার পেয়ে বুকে বেঁধে বাড়ি ফিরেছেন। চেঁচিয়ে পাড়া মাত করে সে মাছ দেখিয়েছেন। নিজের হাতে রেঁধেও খাইয়েছেন কল্পনাকে। শিশুদের মতো কল্পনার সাথে বাজি ধরেছেন। সোনাগাছি গিয়ে পতিতাদের গান শুনিয়েছেন।
৮০র দশকে মদ্যপান ছিলো ভূপেন হাজারিকার আর্থিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। একের পর এক অসাধারণ গানের কথা ও সুর ভক্তদের মোহিত করে রাখছিলো কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত আর্থিক টানাপোড়েন কাটছিলো না কিছুতেই। অনুষ্ঠান আয়োজকরাও ভূপেন হাজারিকার নাড়ি টের পেয়ে গিয়েছিলো- ফলে তারা স্টেজে ওঠার আগেই তাঁকে উদরপূর্তি করে মদ খাওয়াতো। এতে সুবিধা হতো দুটি- এক. মদ্যপান করে ভূপেন হাজারিকা একের পর এক গান গেয়ে যেতে পারতেন কোনো বিরতি ছাড়া এতে আয়োজকদের দর্শক ধরে রাখতে সুবিধা হতো। আর দুই. অনুষ্ঠান শেষে ক্লান্ত শ্রান্ত গায়ক ভূপেন হাজারিকাকে তাঁর নির্দিষ্ট পাওনার চেয়ে কম কর্থ বুঝিয়ে দিয়ে বিদেয় করা যেতো। এসব কিছুর অনুঘটক ছিলো ‘ব্রোকার’ নিতাই বাবু। অবশেষে এখানেও কল্পনাকে দৃঢ় হতে হয়েছিলো। আসামের গুয়াহাটিতে কল্পনা অনুষ্ঠানে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন- তা হয়ত আজকে আমরা যে গুরু ভূপেন হাজারিকাকে চিনতে পেরেছি তাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলো। গুয়াহাটির অনুষ্ঠানস্থলে কল্পনা যখন প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্য প্রাণ ভরে নিচ্ছিলেন বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছিলেন ভূপেনের নাক তখন অ্যালকোহলের ঘ্রাণ খুঁজে বেড়াচ্ছে পথঘাট। নদী পাহাড় হোটেল। হোটেলের রুমে। আয়োজকেরাও তাঁর পেছনে চিনে জোঁক হয়ে লেগে রইলো কখন তাকে বাইরে বের করে আকণ্ঠ মদ্যপান করানো যাবে। কল্পনা তা বুঝতে পেরেই হোটেলে নিজেদের রুমের দরজায় তালা লাগিয়ে চাবিটা রেখে দিলেন নিজের কাছে। এরই মধ্যে ভূপেন হাজারিকা নানা তাল বাহানা জুড়ে দিয়েছেন ঘর থেকে বের হওয়ার। কখনো বলেছেন স্টেজ নিরীক্ষণ করতে যেতে চান, কখনো বলছেন যন্ত্রশিল্পীদের সাথে কথা বলবেন- কল্পনা খুব ভালোই জানতেন তিনি মূলত: এসব তাঁর সুরাসক্তির অস্থিরতারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
কল্পনাকে যখন কোনভাবেই দরজা খুলতে রাজি করানো গেলো না- রাগে ক্ষোভে তিনি হোটেলের বিছানা থেকে একটি বালিশ ছিঁড়ে-তা ছুঁড়ে মারলেন কল্পনার দিকে এবং তা যথেষ্ট জোরেই! কল্পনাও দমবার পাত্রী নন। ভূপেন হাজারিকাকে অনুষ্ঠান আয়োজকদের হাত থেকে বাঁচাতে কল্পনা সবচেয়ে আশ্চর্যজনক কাজটি করে বসলেন। তিনি ছুটে এসে ভূপেনের গালে চড় বসিয়ে দিলেন! এই অকস্মাৎ আচরণে তিনি এতটাই অপ্রস্তুত ছিলেন যে এই কল্পনা তার কাছে নতুন। কল্পনা তাকে উপর্যুপরি বালিশ ছিঁড়ে আঘাত করে দমিয়ে রাখলেন- ততক্ষণে বাইরে আয়োজকদের হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। তারা ধরেই নিয়েছেন ভূপেনদার কোনো বিপদ হয়েছে। বারবার চেষ্টা করেও দরজা খুলতে না পেরে লম্বা মই লাগানো হলো ভূপেনদার হোটেলের জানলার সাথে। অবশেষে তারা ভূপেন-দাকে জানলা দিয়ে বের করে উদ্ধার করে নিলো। এত চেষ্টা করেও আয়োজকদের হাত থেকে বাঁচানো গেলো না ভেবে রাগে দুঃখে কল্পনা ঠিক করলেন তিনি কলকাতা ফিরে যাবেন। গুয়াহাটির অনুষ্ঠানে থাকার আর রুচি হলো না কল্পনার। বাক্সা- পেটরা নিয়ে হোটেল পেরিয়ে চা বাগানের রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছেন- এমন সময় পেছনের গাড়ির হর্ন শুনেই চমকে তাকিয়ে দেখেন ভূপেন হাজারিকা। বরাবরের আত্মসমর্পণের হাসি হেসে কল্পনার কাছ থেকে সুকোসটি ছিনিয়ে নিয়ে গাড়িতে রাখলেন। দীর্ঘদিনের অভ্যাস পরিণত হওয়া সম্পর্কে পরস্পর আষ্টেপৃষ্টে বাধা পড়ছেন এটা যেমন সত্যি, তেমনি বয়স কিংবা আদর্শিক সংঘর্ষ যাই থাকুক তাদের দু’জনের কারোই পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা অগ্রাহ্য করার মতো শক্তি ছিলো না। সম্পূণরূপে দম্পতি ছিলেন বলেই তারা দু’জনেই একই সাথে একই ছাদের নিচে বসবাস করেও ভিন্ন ভিন্ন সম্পর্কে জড়িয়েছেন। তা নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। আশাহত হয়েছেন কল্পনা কিন্তু কেউ কাউকে ছেড়ে যাননি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্কুল থেকে শিক্ষা চলে গেছে কোচিং সেন্টারে
পরবর্তী নিবন্ধবিএনপির শীর্ষ সন্ত্রাসী ভূমিদস্যু লাল বাদশা গ্রেপ্তার