‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’

আনন্দমোহন রক্ষিত | শুক্রবার , ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:০৭ পূর্বাহ্ণ

‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান’ কবি গুরুর এ চিরন্তন সত্যের উচ্চারণকে অন্তরে আত্মস্থ করে চির প্রস্থান আমাদের শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালবাসার সদাহাস্যময় কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক অরুণদাশগুপ্ত তথা প্রিয় দাদামণি। তাঁর প্রয়াণ দিবসটি ১০ জুলাই শনিবার দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং সাংবাদিকতার ইতিহাসে এ দিবসটি স্মরণীয় শোকাবহ দিন হিসেবে সকলের হৃদয়ে অমোচনীয় হয়ে থাকবে। বিশেষ করে আমার জন্যে। অরুদার সাথে পরিচয় ঘটে সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে। তিনি তখন দৈনিক আজাদীর সাহিত্য সম্পাদক। আমরা কবিতা নিয়ে তাঁর কাছে যেতাম কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের দোতালায়। তখন আজাদী অফিস ছিলো সেখানে। আমার লেখালেখির শুরু দাদা আজাদীতে যোগদান করার বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই। অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগে ১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে। তখন আজাদীর সাহিত্য সাময়িকী ও আগামীদের আসর দেখতেন আমাদের সিনিয়র বন্ধু আতাউল হাকিম। তিনি অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। প্রাণবন্ত মানুষ। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ১৯৭৩ সনে অরুণদা আজাদীর বরেণ্য সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের বদান্যতায় আজাদীতে যোগদান করেন। তাঁর কাছে কবিতা নিয়ে যেতাম অত্যন্ত সমীহ করে। কিন্তু তাঁর উদার হৃদয় আমাদেরকে স্নেহ-ভালোবাসায় এতোটা উদ্দীপ্ত করতো যে অচীরে আমরা তাঁর খুব আপন হয়ে গেলাম। পরে পরে এমোন হলো যে আজাদীতে গেলেই তিনি মনে করতেন কবিতা নিয়ে গেছি। দেখামাত্রই সহাস্যে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলতেন আগে লেখাটা দিন। তাঁর অফিস থেকে কোনদিন চা না খেয়ে আসা যেতো না। যেটা এখন রাশেদ ভাই। (কবি রাশেদ রউফ) করেন। এই হচ্ছে অরুণদা।
আজাদী থেকে বৌদ্ধ মন্দির পার্শ্বস্থিত কল্যাণী, পুরনো দোতলা বাড়ি অরুণদার নিবাস। অসংখ্য কাব্য, লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, গবেষক, সাহিত্য-সংস্কৃতি সংগঠক, সমাজ হিতৈষী তরুণ যুবক থেকে বয়স্ক ভেদাভেদ ভুলে সবাই তাঁর সান্নিধ্যে যেতেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিয়মিত অনিয়মিত ভাবে যেতাম। এ আড্ডায় কতো ধরনের যে আলোচনা হতো তার সীমা পরিসীমা থাকতো না। আড্ডা চলতো মধ্যরাত অবধি। সঙ্গে চা নাস্তা আছেই। সে এক অফুরন্ত, প্রাণবন্ত সময় আমরা পার করেছি। দাদার বাসাটায় যেন একটা বিশাল গ্রন্থাগার। দেয়ালে সাটানো বইয়ের আলমিরা, বিছানা, ঘরের মেঝেতে অসংখ্য বই, সাময়িকী, পত্র-পত্রিকা। আমরা যে সময়েই যাইনা কেন তাঁর সেবায়েত রাই মোহন ডাক দেয়ার সাথে সাথে এসে হাজির চায়ের ফ্ল্যাঙ নিয়ে, পাশেই লাকী হোটেল, চা, সমুচা, সিঙ্গারা, মিহিদানা, নিমকি এসবই নিয়মিত। তিনি মেহমানদের খাইয়ে এতো আনন্দ পেতেন সেটা ভাষায় বোঝানো যাবে না?
এ অরুণদা কবে যে আমার দাদামণি হয়ে গেলেন সেটা এখন আর মনে পড়ে না। অন্য সবার সাথে আমিও এমধুময় সম্বোধনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তিনি মাঝে মাঝে কবি সাথী কে নিয়ে খুব মজা করে বলতেন- আমি তার মাকে বৌদি ডাকি। আর সে আমাকে ডাকে দাদামনি- এ কথা বলেই সবাই হো হো করে হেসে উঠতাম। তিনি এতো রসজ্ঞ আলোচনা করতেন এটা সেটা বলে শেষ করা যাবে না।
সেই কল্যাণী থেকে এক সময় চলে আসলেন টুলুদাসহ হেমসেন লেনের পার্শ্বস্থিত এক পুরোনো বাড়ির নিচ তলায়। সেখান থেকে রহমতগঞ্জের প্রাত:স্মরণীয় অধ্যক্ষ যোগেশ সিংহ মশাইয়ের বাড়িতে। সেখান থেকে ঘাটফরহাদবেগস্থ শিল্পী মিহির কানুনগোর বাড়িতে। এসব জায়গায়ও জমজমাট আড্ডা হতো। ধীরে ধীরে তাঁর বয়স বাড়ছে। একা চলাফেরা করার সাহস পেতেন না। এ সময় তাঁর নিত্য সহচর হলেন কবি আশীষ সেন। শেষে এমন অবস্থা হলো আশীষ সেন ছাড়া তিনি চলতেই পারতেন না। ভীষণ অসুস্থ হয়ে গেলেন। আজাদীতে যাওয়া বন্ধ হলো শারীরিক অক্ষমতার কারণে। জেনেছি তাঁর কর্মক্ষমতা না থাকলেও আজাদী কর্তৃপক্ষ নিয়মিত তাঁর খোঁজ খবর নিতেন। এটা আজাদী কর্তৃপক্ষের বিশাল বদান্যতা বলতেই হবে। তিনি নিয়ম মাফিক চাকরিতে অবসর গ্রহণের পরও নিয়মিত আজাদীতে যেতেন সাহিত্য পাতা দেখতেন, সম্পাদকীয় লিখতেন। অর্থাৎ যতোদিন তিনি চলৎ শক্তি হারাননি ততদিন তিনি আজাদী ছাড়েন নি বা আজাদী পরিবার তাঁকে ছাড়েননি। এটা খুব বিরল দৃষ্টান্ত।
সর্বশেষ দাদামনির সাথে দেখা করতে গেলাম শিল্পী মিহির কানুনগোর বাসায়। সাথে কবি বন্ধু নিতা সেন। কিছু সময় পর গেলেন কবি আশীষ সেন, কবি আহমদ খালেদ কায়সার। তিনি বিছানায় শুয়ে শুয়েই আমাদের সাথে কথা বললেন। বোঝা গেলো তিনি আর বেশি দিন নাই। পরে জেনেছি তিনি মিহির কানুনগোর বাসা থেকে চলে গেছেন ফতেয়াবাদ এক আত্মীয় হিতৈষী বিশ্বজিত গুপ্তের বাড়িতে। এই বিশ্বজিত বাবুর একটা ডিস অ্যাবল সংগঠন আছে। যার নাম ঈড়হপবৎহ ঝবৎারপবং ভড়ৎ উরংধনষব সংক্ষেপে সিএসডি। আমরা জানতাম অরুণদা এই সংগঠনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং বিশ্বজিত বাবুকে খুবই ভালোবাসতেন। সে সুবাদে অত্যন্ত দুঃসময়ে দাদামণিকে তিনি সেখানে নিয়ে গিয়েছেন।
শেষ পর্যন্ত দাদামণি সেখানেও বেশীদিন থাকতে পারেননি। সেখান থেকে তাঁর শেষ যাত্রা হলো নিজ জন্ম ভিটে সেই ধলঘাটের নিজ বাড়িতে। তাঁর প্রয়াত পিতা মাতার শ্মশান ভূমি সেখানে। সৃষ্টি কর্তার অপার মহিমায় এই অকৃতদার মহানুভব মানুষটি সেখানে অন্তিম আশ্রয় নিলেন। এমন একজন জ্ঞানীগুণি মহাত্মা সারা জীবন অসংখ্য লেখক, কবি, সাহিত্যিক তৈরি করেছেন। অথচ তাঁর তেমন উল্লেখযোগ্য কোন বই প্রকাশিত হয়নি। তাঁর প্রকাশিত বই মাত্র দু’খানা-১। যুগ পথিক কবি নবীনচন্দ্র সেন, ২। রবীন্দ্র নাথের ঋতুর গান ও অন্যান্য। এছাড়া দেশে-বিদেশে পত্র-পত্রিকা, ছোট কাগজ ইত্যাদিতে তাঁর অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ, আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে। এসব তিনি কখনও যত্ন করে সংগৃহিত করে রাখেননি। কোন নিষ্ঠাবান গবেষক যদি তাঁর এসব লেখা সংগ্রহ করেন, তাহলে তাঁর একটা বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার গড়ে উঠবে। তিনি আগামী প্রজন্মের লেখক-সাহিত্যিকদের কাছে বেঁচে থাকবেন। তাঁকে যুগ যুগ ধরে মানুষ স্মরণ করবে। দৈনিক আজাদী তাঁকে যথাযথই মূল্যায়ন করেছেন। ‘অরুণদাশগুপ্ত কেবল সাংবাদিক নন, তিনি একজন নিষ্ঠাবান প্রাবন্ধিক, মেধাবী গবেষক, বিরল প্রজ কবি ও গুণী সাহিত্য সম্পাদক। জ্ঞানে পাণ্ডিত্যে অভিজ্ঞতায় একজন অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব। সৃজনশীল ও মননশীল জগতের একজন অনুকরণীয় পুরুষ। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংগীত, রাজনীতি দর্শন, ইতিহাস, ঐতিহ্য এমন কোন দিক নেই যে তিনি জানেন না। সব বিষয়ে সমান অবগত ও আগ্রহ। আজ আমরা বুঝতে পাচ্ছি অরুণদার থেকে কেবল আমরা দু’হাত ভরে গ্রহণ করেছি, তাঁকে কিছু দিতে পারিনি। তিনি উদার হস্তে দান করেছেন ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে কিছুই নিয়ে যাননি। এ হচ্ছে প্রকৃত দাতার চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য। আমরা নিতে জানি, দিতে শিখেনি। বাঙালি রাষ্ট্র, সমাজ ব্যক্তি মানসের এটা একটা অত্যুজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য বটে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাবাজারে অগ্নিকাণ্ডে পুড়েছে অফিস, গুদাম
পরবর্তী নিবন্ধনতুন ব্রিজ ও জিইসি মোড় থেকে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার ৩