সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি

সাখাওয়াত হোসেন মজনু | সোমবার , ৭ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

একজন শিশুকে নিয়ে কিছু কথা
করোনার এই সময়ে স্কুল বন্ধ, বাইরে যাওয়া নিয়ন্ত্রিত, খেলাধুলার সুযোগ নেই। মনের মতো কিছু করার স্বাধীনতা ঘরের চার দেওয়ালে আটকে আছে। কাজ শুধু ঘরে থাকা। কঠিন কঠিন সাবধান থাকার কথা শোনা। খেতে মন চায় না তারপরও খেতে হয়। ঘুমুতে ইচ্ছা করে না। কাজ শুধু মোবাইল ও কম্পিউটারে গেম খেলা। ফ্ল্যাটবাড়ির দরজা জানালা খুলে আকাশ দেখা ছাড়া আর কোন স্বাধীনতা নেই। এখানেও আবার বাধা। উপর থেকে ময়লা, নোংরা পানির ছিটা অথবা পলিথিন বন্দী করে ময়লা ফেলা। ফলে জানালা, দরজা বা বারান্দায় গিয়ে যে কিছু সময় কাটাবে তাও পারা যায় না। বিকেলে বা সন্ধ্যার পর ছাদে যাবে সুযোগ আছে তবে নিরাপদ নয়। কিশোর একদল পুরো এলাকা জুড়ে দখলে রাখে। এরা এগুচ্ছে অপরাধ প্রবণ কাজের ধারায়। তাই ঘরের জীবনটাই ভালো। এমন পরিবেশে কাটছে আমাদের কর্মজীবী বাবা-মার শিশু সন্তানটি। এই পরিবেশকে মেনেই নিজের আপনে রাজ্য খুঁজে নিয়েছে একজন শিশু শিক্ষার্থী, নাম আদনান শাহারিয়ার নূর। বয়স ৯ এবং পড়ছে ৩য় শ্রেণিতে।
এই শিশুর দিন কাটে কি ভাবে?
পরিবার আদর্শের ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ। বাবা-মা চলনে, বলনে কথনে সমৃদ্ধ মানসিকতার মানুষ। করোনার এই সময়ে তাদের সন্তান একান্ত অসহায়। ছেলে বাইরে বেড়াতে চায়, স্কুলে যেতে চায়, স্কুলের বন্ধুদের দেখতে চায়, স্বজনদের সাহচর্য চায় কিন্তু করোনা পরিস্থিতি এগুলো বিপরীত অবস্থানে। ফলে নিজের শিশুর মতো পিতা-মাতাও একান্ত অসহায়। শিশু চলনে, বলনে কেমন একটা নির্জীব ভাব। মনের চঞ্চলতা নেই তার মাঝে, কেমন যেন জীবনের ছন্দপতন। কি নেই তার ঘরে বা পরিবারে? সবই আছে তারপরও তার জীবন ছন্দের গতিময় অবস্থান নির্বাসনে। করোনার প্রথম দিকে এগুলো ভাবনার বিষয় ছিলো না। সময় যতোই গড়িয়ে যাচ্ছিলো প্রকৃতি, পরিবেশ এবং শিশুর মনের অবস্থা দুর্বল থেকে দুর্বলতম পর্যায়ে চলে যেতে শুরু করে। শিশুর উৎফুল্লতা বেড়ে যায় বাবা-মা অফিস থেকে ঘরে ফেরার পর। এতোদিনে বাবা-মা কিছুটা সমাধানের পথ খুঁজে পেলেন। স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নিলেন তাদের ছেলেকে প্রয়োজনীয় সময় দেবেন। যেটুকু সময় পান তা দেবেন ছেলেকে। চিন্তার সাথে কাজের ঐক্য ঘটালেন, প্রয়োগ করলেন আনন্দের কৌশলগুলো। তারাতো জানেন তাদের সন্তানকে। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ। একটু আলাপ করি।
১. কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরেই বাবা-মা সন্তানের জন্য সময় দিতে শুরু করেন। চা পান থেকে নৈশভোজ একসাথে পাশে বসিয়ে, আদর আপ্যায়ন।
২. করোনার এই সময়ে শিশুকে শেখাচ্ছেন কেন স্কুল বন্ধ, কেন বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না, পছন্দের খাওয়ার দোকান থেকে আনা যাচ্ছে না।
৩. পুরোদিন ঘরে শিশু সন্তান কি করেছে কি খেয়েছে, সময় কেমন করে কাটিয়েছে, কি কার্টুন সে দেখেছে?
এসব হালকা তথ্য নিয়ে তারা শিশুর সামনে সত্য বলার উদাহরণ তুলে ধরতে চাইছেন। শিশুটির সামনে তাদের বাবা-মা মিথ্যা বলেন না। পরচর্চা করেন না, টেলিফোনের জটিল ও কুটিল কথাগুলো নিরাপদ দূরত্বে থেকে বলেন। সত্যকে মিথ্যার আড়ালে ঢেকে দেন না। ফলে শিশুটিও বাবা-মার কাছে সত্য বলার অভ্যাস গড়ে তুলছে। বাবা-মা সন্তানের সামনে নিজের চারপাশের কথাগুলো বলেন, ছেলেকে দিয়ে বলান, প্রকৃত তথ্য বের করার চেষ্টা করেন। মজা করতে করতে তারা ছেলেকে বইয়ের পাঠের বাইরে এমনসব কথা বলেন যা হচ্ছে প্রকৃতি, সমাজ, সভ্যতা ও নিজেকে জানার জন্য চেনার জন্য। শিশুকে খাওয়ালাম, পড়ালাম, স্কুলে পাঠালাম এটাই কিন্তু শেষ নয়। তাই এগুলোর বাইরে শিক্ষার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিতে হবে। মানুষ হিসেবে তাকে গড়তে হলে প্রকৃত শিক্ষা, পরিবারের শিক্ষা, সমাজ প্রগতির শিক্ষা দিতে হবে। ধরুন ছেলেকে বলা হলো একটি শব্দের বাংলা বা ইংরেজির অর্থ কী? ছেলেটি পারলে ভালো আর না পারলে সুকৌশলে তাকে বলা হলো, কোথায় গেলে বা কম্প্‌িউটারের কোন অপশনে গেলে এগুলো অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে সে নির্দেশনা বাবা-মা তাকে দিলেন। আর ছেলের যুদ্ধ শুরু হলো গবেষণা করার। একসময় সে নির্দেশনা মতে এগুলো আর পেয়ে গেলো কাঙ্ক্ষিত শব্দের বাংলা, ইংরেজি অর্থ এবং বানানটাও জেনে নিলো। এমন করেই কিন্তু আদনান শাহারিয়ার নূর কৌতূহলী হয়ে পৌছে গেলো শব্দ ও বানান জানার অন্বেষণ ও গবেষণায়। এই তথ্য জানার কৌতূহল থেকেই সে বানানে দক্ষতা অর্জন শুরু করে। গেলো মাসে তাদের একটি বানান প্রতিযোগিতা হলো। প্রায় ১২০০ জন শিক্ষার্থী ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে প্রতিযোগিতায় অংশ নিলো। প্রতিযোগিতায় মৌলিক বিষয় ছিলো বানানের ওপর। বানান তাকে খুঁজে বের করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জবাব দিতে হবে। এতে করে আদনান শব্দের বানান খুঁজে বের করতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। কারণ তার বাবা-মা প্রায়ই তাকে এমন খেলায় অংশীদার করেছে। প্রতিযোগিতায় ছেলে পেল ৩য় স্থান এবং মর্যাদা। ছেলে সঙ্গী পেয়েছেন বাবা-মাকে এবং সে খেলার মধ্যে পেয়েছে আনন্দ। উপকার হয়েছে, ছেলের অসহায় মাসিকতা নির্বাসনে চলে গেছে। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন যে,
১. ছেলে পিতা-মাতা সঙ্গ পেয়েছে, প্রাণখুলে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে।
২. করোনার এই খারাপ সময়ে ঘরেই বন্ধু পেয়ে গেছে, দূর হয়েছে বন্ধুর অভাব।
৩. বাবা-মার অনুপস্থিতিতে ঘরে কম্পিউটার, গেম বা অন্যান্য খেলায় নিজেকে মাতিয়ে রেখেছে।
৪. বাবা-মা ঘরে ফিরলেই নিজ থেকে দিনের সময় কিভাবে কাটিয়েছে সে কথা বলে মনে তৃপ্তি ফিরিয়ে এনেছে।
জেনেছি শিশুটি সবচাইতে বেশি আনন্দ পায় বাবা-মা ঘরে ফিরলে। তারাও এটা বুঝতে পেরে অনাহুত বাইরে সময় কাটান না বা সময় নষ্ট করেন না। তারাও মনের তৃপ্তি খুঁজে পান শিশুকে আনন্দ দিয়ে, তার সাথে সময় কাটিয়ে। ছেলে জানতে শুরু করেছে,
১. তার পিতা ধূমপান করেন না, দোকানে বসে কিছু খান না, বাজে বন্ধু নেই।
২. মা তার একমাত্র আশ্রয় ঘরে এবং বাইরে। তারা দু’জনই তার বন্ধু।
৩. সে বাবা-মাকে এখন বিশ্রামে সাহায্য করে।
৪. প্রকৃতিকে জানার জন্য তার মনে সৃষ্টি হয়েছে নানা কৌতূহল।
আমাদের সবার অর্থনৈতিক অবস্থাতো আর তেমন সবল নয়। তবে ঘরে সন্তানের প্রতি দায়িত্ববোধ হচ্ছে তাকে বা তাদের সময় দেওয়া, তাদের বন্ধু হওয়া, কথায় কথায় তাদের মাঝে আদর্শ স্থাপন করা, সমাজ বাস্তবতার জন্য তাদের তৈরি করা। যেমন করে আদনান শাহারিয়ার নূর এর পিতা শাহাদাৎ হোসেন, মা নুসরাত জাহান চেষ্টা চালাচ্ছেন। এক্ষেত্রে অর্থের চাইতে প্রয়োজন মানস শক্তি। সন্তানের জন্য বেশি প্রয়োজন আদর্শ বাবা-মা এবং সন্তানকে সাধ্য অনুযায়ী সময় দেওয়া। তাহলে সন্তান বাড়বে নৈতিকতা ও আদর্শের চর্চায়- যা খুবই প্রয়োজন।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসৃষ্টিতেই সকল আনন্দ খুঁজে নেন লেখকরা
পরবর্তী নিবন্ধইসহাক চৌধুরী : চট্টগ্রামের প্রাচীন ও লোকসাহিত্যের শেষ গবেষক