সামাজিক সংহতি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে হবে

| বুধবার , ২৫ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:০০ পূর্বাহ্ণ

দেশে সার্বিক অপরাধপ্রবণতার সঠিক চিত্র পাওয়া যায় দুষ্কর। নেই কোনো নির্ভরযোগ্য নিখুঁত সমন্বিত জরিপও। এরপরও সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য ও বিভিন্ন সরকারিবেসরকারি সংস্থার তথ্যউপাত্তের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদ্বেগজনকহারে বেড়েই চলেছে পারিবারিক সহিংসতা। অপরাধবিজ্ঞানীরা বলেন, ‘সমসাময়িক অপরাধপ্রবণ সমাজে নিত্যনতুন অপরাধ ও তার মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। এর মধ্যে পারিবারিক কলহ ও সহিংসতা সমাজকে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কগ্রস্ত করে। কারণ একজন মানুষের কাছে তার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনই সবচেয়ে আপন। কিন্তু সেই আপনজনদের দ্বারাই যখন সহিংসতা ও হানাহানির শিকার হতে হয়, তখন সেটি সেই ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের জন্যই হুমকিস্বরূপ।’ আর পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধির পেছনে কাজ করছে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়া, যৌতুক, মাদক, বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক, প্রযুক্তির অপব্যবহার, ব্যক্তিগত স্বার্থ, সুস্থ বিনোদনের অভাব, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সামাজিক অবক্ষয়ের প্রভাব। পরিবারে শারীরিকমানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের মতো এসব ঘটনা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য থেকে জানা যায়, গত সাত বছরে তালাকের প্রবণতা ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। তালাক বা ডিভোর্স স্বাভাবিকভাবে নেতিবাচক বলেই এ নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা থাকবে। কিন্তু কোন সেই কারণ, যা আমাদের দুর্গতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে? বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এ নিয়ে বহু মতামত হাজির করা হয়। বিভিন্ন মিডিয়ায় তুলে ধরা হয়, নারীদের পক্ষ থেকে ডিভোর্সের প্রধান কারণ হলো স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, পরনারীর সঙ্গে সম্পর্ক, যৌতুক, দেশের বাইরে গিয়ে আর ফিরে না আসা, মাদকাসক্তি, ফেসবুকে আসক্তি, পুরুষত্বহীনতা, ব্যক্তিত্বের সংঘাত। আর পুরুষদের পক্ষ থেকে ডিভোর্সের প্রধান কারণ স্বামীর অবাধ্য হওয়া, ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী না চলা, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা ও সন্তান না হওয়া। এই সাধারণ কারণগুলোর দিকে লক্ষ করলেই বোঝা যায় নারীদের পক্ষ থেকে অভিযোগের পাল্লা পুরুষদের তুলনায় অনেক ভারী। সেদিক বিবেচনায় নারীদের পক্ষ থেকে ৭০ শতাংশ আর পুরুষদের পক্ষ থেকে ৩০ শতাংশ ডিভোর্সের যৌক্তিকতা উড়িয়ে দেয়া যায় না। প্রকৃতিগতভাবেই নারী পরিবারবান্ধব, সে কারণে এ চিত্র প্রাকৃতিক চরিত্রের অনেকটাই বিপরীতে অবস্থান করে। আবার এও দেখা যায়, শিক্ষিতদের মধ্যে এ হার অশিক্ষিতদের তুলনায় অনেক বেশি, আর্থিক অসচ্ছলদের তুলনায় সচ্ছলদের মধ্যে ডিভোর্সের হার আরো বেশি। এর মানে শিক্ষা আর অর্থসম্পদ দিয়ে সংসার টেকানো যাচ্ছে না।’

বিশেষজ্ঞরা বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা আগেও ছিল, এখনো আছে। তবে পারিবারিক সহিংসতার ধরন পাল্টেছে এবং সহিংসতাও বাড়ছে। তাঁরা বলেন, ‘আমাদের দেশে বেশির ভাগ পরিবারে ব্যক্তির মানসিক সমস্যাগুলো সেভাবে চিহ্নিত করা হয় না। এ কারণে তারা মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছেও যান না। ফলে মানসিক সমস্যা ও সমাজের বিভিন্ন বিশৃঙ্খল পরিবেশ পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান তাঁর এক লেখায় বলেছেন, আমরা যদি এ ধরনের অপরাধ ও সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধ করতে চাই, তাহলে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি আমাদের সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার জন্য অনেক বেশি কাজ করতে হবে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো; যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সমাজের মানুষের মধ্যকার ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও সৌহার্দ্যমূলক পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সেই সঙ্গে সিভিল সোসাইটি ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলোরও উচিত এসব সংঘষের্র উৎস ও কারণ বের করে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। সর্বোপরি সরকারিবেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি সমাজের সব স্তরের মানুষ মিলেমিশে কাজ করতে পারে। এ ধরনের একটি সামগ্রিক পন্থা ও উদ্যোগই পারে একটি সামাজিক সংহতি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পরিবার আসলেই দায়িত্বপালনের সেন্টার। ভালোবাসা আর মমতার উত্তম স্থান। সততা, দায়িত্বশীলতা আর ত্যাগের মধ্য দিয়েই বিয়ে ও পরিবারের শক্ত ভিত দাঁড় করাতে হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আয় উপার্জন আর যৌনতা হলো পরিবার ব্যবস্থা সক্রিয় রাখার উপায় মাত্র। আমাদের খুঁজতে হবে এই ভিত্তিমূলের উৎস কোথায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে