সামাজিক মাধ্যমে শিশুদের ব্যবহার

রিমঝিম আহমেদ | শনিবার , ২৭ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৯:০১ পূর্বাহ্ণ

১৯৮৯ সালে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ স্থির করেন যে, কেবল শিশুদের জন্য আলাদাভাবে একটি বিশেষ সনদের প্রয়োজন কেন না ১৮ বছরের কম বয়সী মানুষদের প্রায়শই বিশেষ পরিচর্যা ও সুরক্ষার প্রয়োজন পড়ে যে প্রয়োজন প্রাপ্তবয়স্কদের পড়ে না। শিশুদের যে মানবাধিকার আছে আর সারা বিশ্ব যে এর স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ তা নিশ্চিত করতে চাইলেন। ফলে ১৯৯০ সালে এই আইন আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়।

প্রথম যে ২২টি দেশ এই সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ তার একটি।

শিশু অধিকার সনদ এমন একটি আন্তর্জাতিক আইন যা ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত পৃথিবীর সকল শিশুর মৌলিক অধিকার নির্ধারণ করে। মেয়ে ও ছেলে, সকল বর্ণ, সকল ধর্ম, সকল সামাজিক শ্রেণি আর অঞ্চলের শিশু থেকে শুরু করে প্রতিবন্ধী শিশুরাও এর অন্তর্গত।

বাংলাদেশ যেহেতু জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র, সেহেতু বাংলাদেশের শিশু আইন ২০১৩ও অনেকাংশে শিশু অধিকার সনদের আদলে প্রণীত হয়। তাই জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ ও জাতীয় শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচের সকল মানব সন্তানকে বোঝায়।

পরিবারে, গোত্রে, সমাজে একজন সুখী, সুস্থ, দায়িত্বশীল ও উৎপাদনশীল প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার জন্য সব শিশুরই কিছু চাহিদা থাকে। এই চাহিদাগুলোই অধিকারের ভিত্তি।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী প্রত্যেক শিশুর আছে বেঁচে থাকার অধিকার, পরিপূর্ণভাবে বিকাশ লাভের অধিকার, ক্ষতিকর প্রভাব, নির্যাতন এবং শোষণ থেকে সুরক্ষার অধিকার, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনে পূর্ণ মতামত প্রকাশের অধিকার।

ভেবে দেখলে দেখব, জন্মের পর একটি শিশুকে আমরা নানাভাবে আদর করি। কারণ শিশু প্রতিবাদ করতে পারে না। তার ভালো লাগা, খারাপ লাগা বড়দের মতো করে প্রকাশ করতে পারে না। ফলে তাকে গাল টেনে, চুমু খেয়ে, আকাশের দিকে ছুড়ে দিয়ে, চিমটি দিয়ে এমনকি মজার ছলে ন্যাংটো করে দিয়ে তাকে বিব্রত করে মজা পাই। আনন্দ পাই। কারণ তার বিব্রত হওয়াকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। আবার অনেক সময় শিশুদের খালি গায়ের ছবি তুলে কিংবা ভিডিও করে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়, যা শিশুর সুরক্ষার অধিকারকে হরণ করে। যা একপ্রকার নির্যাতন। বড় হয়ে এইসব ছবি ও ভিডিও যখন শিশুটি দেখবে তখন সে লজ্জা পেতে পারে, বিব্রত হতে পারে। মানসিক চাপ অনুভব করতে পারে কিংবা সে ছবি বা ভিডিও দ্বারা নিজের সম্মানহানি হয়েছে মনে করতে পারে।

আর এখন তো রিল, ভিডিও, ইনস্টা, ফেসবুক ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। লাইক, কমেন্ট, শেয়ার কামিয়ে ভাইরাল হওয়ার যুগ। ভাইরাল হলেই রাতারাতি বিখ্যাত হওয়া যায়। বিনা পরিশ্রমে উপার্জনেরও একটা পথ। আর এই ভাইরাল মিডিয়ার বলি হচ্ছে শিশুরা। বড়দের স্বার্থ চরিতার্থ করতে লাগামহীনভাবে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। কারণ বড়রা ভাবে না, শিশুদেরও সম্মানজনক আচরণ পাওয়ার অধিকার আছে। মত প্রকাশের অধিকার আছে। বড়রা যখন শিশুদের সাথে কথা বলে বা তাদের সাথে কোনো আচরণ করে তখন মনে রাখা উচিত যে, একটি শিশু পূর্ণ মানুষ। আধা, সিকি বা পৌনে একজন মানুষ নয়। তাদেরও একইরকম প্রতিক্রিয়া বা অনুভূতি থাকতে পারে, আত্মমর্যাদাবোধ থাকতে পারে, এমনি তারা যদিও ছোট, এখনো কথা যদি নাও বলতে পারে তাতেও সে অসম্পূর্ণ মানুষ হয়ে যায় না। শিশুর বোঝানোর সরল ভাষা আছে। হয়তো তারা কথা বলতে ভয় পায়। কিংবা প্রকাশ আলাদা।

তাই শিশুদের ব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়ায় রিল, ভিডিও বা অন্যান্য ভিজুয়াল দৃশ্য ধারণ করে প্রকাশ করার আগে ভেবে দেখা দরকার তা শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কি না। নাকি আপনার/আপনাদের অসুস্থ প্রবৃত্তির শিকার হচ্ছে। আপনি বিখ্যাত হবার জন্য শিশুর নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও সম্মান পাওয়ার অধিকারকে লঙ্ঘন করছেন কি না।

বড়দের এই দ্রুত সময়ের ভাইরাল হতে চাওয়া, খ্যাতির লোভ শিশুদের মনে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার জন্ম দিতে পারে। বিপথগামী করতে পারে। তাই দরকার সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে সর্বোচ্চ সচেতনতা।

অন্যথায় আন্তর্জাতিক আইন হিসেবে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ তো আছেই, জাতীয় শিশু আইন ২০১৩এর নবম অধ্যায়ের ১৮ ধারায়শিশুর গোপনীয়তা ভঙ্গ করার দায়ে অনধিক এক বছরের কারাদণ্ড ও সাথে অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে।

আমরা সবাই হয়তো মাবাবা। কিন্তু আমাদের সমাজে অন্য ভূমিকাও আছে। একজন মা বাড়িতে একজন স্ত্রী, বোন বা মেয়ে। একজন বাবা বাড়িতে হতে পারেন স্বামী, ভাই বা পুত্র। কিন্তু সমাজে হয়তো একজন স্কুল শিক্ষক, কারো প্রতিবেশী অথবা কোনো সংগঠনের সদস্য। তাই আমাদের আচরণও হওয়া উচিত স্ব স্ব ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল।

একজন শিশু যেন সমাজে একজন দায়িত্বশীল মা হয়, বাবা হয়, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল নাগরিক হয় সে কারণে তার বেড়ে ওঠার পরিবেশটাও হতে হবে সুস্থ ও সুরক্ষিত। আর সেটা হতে হলে বড়দেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

***

শিশু সুরক্ষা সমাজকর্মী, জেলা সমাজসেবা কার্যালয়, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধবেগম ফাহমিদা আমিন
পরবর্তী নিবন্ধকাট্টলী নুরুল হক চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ে বার্ষিক পুরস্কার বিতরণ