বেগম ফাহমিদা আমিন

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ২৭ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৯:০০ পূর্বাহ্ণ

গত ১৭ জানুয়ারি রম্য সাহিত্যিক ফাহমিদা আমিনের স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয় তাঁরই গড়া সংগঠন লেখিকা সংঘের উদ্যোগে। এই জানুয়ারি মাসে তাঁর জন্ম এবং প্রয়াণ। এই অনুষ্ঠানে প্রায় সব বক্তাই ছিলেন ফাহমিদা আমিনের স্নেহধন্য। তাই ব্যক্তি ফাহমিদা আমিনের সংবেদনশীল মন ও তাঁর বিশাল হৃদয়ের স্পর্শ পাওয়ার গল্প উঠে এসেছে। উঠে এসেছে বিভিন্ন সময়ে তার রসবোধের কথা এবং অসাধারণভাবে তা পরিবেশনের কথা। কেউ কেউ হতাশা জানিয়েছেন এমন একজন মেধাবী সাহিত্যিকের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ায়।

আমরা ভাগ্যগুণে চট্টগ্রামের সাহিত্যাঙ্গনে তাঁকে পেয়েছিলাম। ঢাকায় থাকলে হয়তো ব্যাপারটা অন্যরকম হতো। একসময় ছিল সব কোলকাতাকেন্দ্রিক। সেটা পরিবর্তিত হয়ে আমরা এখন ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি। সে যাই হোক চট্টগ্রামের মানুষ ফাহমিদা আমিনকে ভালোবাসতেন। যেকোনো সভা সমিতিতে উনার উপস্থিতি ছিল সরব। তিনি বহু সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। শুধু লেখালিখি নয়, নিবিড়ভাবে জড়িয়েছিলেন সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে।

যে সময়টাতে উনার জন্ম সেই সময়ে নারীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ, সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়া বিশেষ করে মুসলিম পরিবারে এবং সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা খুব কঠিন ব্যাপার ছিল। সেই প্রতিবন্ধক পরিবেশ থেকে মেধা, সাহস ও সংগ্রামকে পাথেয় করে খুব অল্প সংখ্যক নারী উঠে আসতে পেরেছিলেন। তাঁর সমসাময়িক লেখক রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া রহমানের জীবনী পড়লে আমরা দেখি কি প্রবলভাবে তাঁরা বাধাগ্রস্থ হয়েছেন। রাবেয়া খাতুনকে জবাবদিহি করতে হয়েছিল পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনদের কাছে পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর গল্পের জন্য। সেই জায়গা থেকে দেখা যায় ফাহমিদা আমিন বরাবরই একটা অনুকূল পরিবেশ পেয়েছেন। তিনি নিজেও তা বহুবার বলেছেন। তিনি শিক্ষিত উদার মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাছাড়া বাবার সরকারি চাকরির বদলির সুবাদে বহু জায়গায় তাঁর ঘুরার সুযোগ হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের মানুষ দেখার সুযোগ হয়েছে। শৈশবের এই অভিজ্ঞতাকে তিনি তার রম্যরচনায় কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর ছিল গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। তিনি নবম শ্রেণিতে উঠতে উঠতে নয়টি স্কুল বদলিয়েছেন। অবশেষে এই চট্টগ্রামের বউ হয়ে এসে অপর্ণাচরণ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাশ করেন। ক্লাস নাইনে থাকতে চট্টগ্রামের অভিজাত পরিবারের সন্তান বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এম আর আমিনের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল তিনি পেয়েছিলেন সুযোগ্য জীবন সাথী। তাঁরই আন্তরিক সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণায় তিনি পড়াশোনা, লেখালিখি, সমাজকর্ম সব সমানতালে চালিয়ে নিতে পেরেছিলেন। তিনি সবকিছু সামলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিও নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যে। প্রতিটা সংগ্রামী নারীর জন্য এটা একটা অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে । ফাহমিদা আমিন ছয় সুযোগ্য সন্তানের মা। রত্নগর্ভা মা হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছেন। ভাবতে আমরা বিস্মিত না হয়ে পারি না যেখানে সংসার রক্ষার দায়, পরিবার রক্ষার দায়, ধর্ম রক্ষার দায়, সমাজ রক্ষার দায় নারীদের উপরেই বর্তায় সেই সময়ে তিনি এতকিছু সামাল দিলেন কীভাবে! তিনি আসলে দশভুজা হয়েই জন্মেছিলেন! তিনি প্রচুর মানুষের সাথে মিশেছেন। সেটা তাঁর সাহিত্যকর্মকে প্রভাবিত করেছে। তিনি সাহিত্যের প্রতিটি ধাপে সদর্পে বিচরণ করলেও প্রধান বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন রম্য সাহিত্যকে। এখানেও তিনি ব্যতিক্রম। আমাদের রম্য সাহিত্য জুড়ে আছেন পুরুষ লেখকরা। সৈয়দ মুজতবা আলী, নুরুল মোমেন, আবুল মুনসুরের মতো লেখকরা। ফাহমিদা আমিন বৃত্তাবদ্ধ থাকেননি। তিনি সব জায়গায় বিচরণ করেছেন। ফাহমিদা আমিনের উল্লেখযোগ্য বইগুলো হচ্ছে নিমমধু, অনিবার্য কারণবশত, মনের আঙ্গিনায়, মৌ ঝুরঝুর, বার্মিংহাম থেকে লিখছি, করাচি প্রবাসে, রঙে রঙে বোনা, প্রজাপতি রঙ ছড়ায়। তঁাঁর জীবনের অনেকটা শেষের দিকে আমার সাথে পরিচয়। দৈনিক আজাদীতে আমার লেখা পড়ে উনি আমাকে ফোন দেন, আজাদী অফিস থেকে আমার ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে। তারপর থেকে আপার সাথে আমার প্রায় কথা হতো । তাঁর মোমিন রোডের বাসায় মাঝে মাঝে যেতাম। আমার মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণকার্ড আমি প্রথম ফাহমিদা আপাকে দিয়ে শুরু করেছি। উনি হুইল চেয়ার নিয়ে বিয়েতে এসেছিলেন। আপার অপত্য স্নেহের কথা কখনও ভোলার নয়।

আমরা যারা ফাহমিদা আপার স্নেহধন্য এবং তাঁকে ভালোবাসি তাদের কাজ যেন হয় তাঁর সাহিত্যকর্মকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তারা যেন জানতে পারে এই অসাধারণ প্রতিভাময়ী মহীয়সী নারীর কথা। তারা যেন জানতে পারে চট্টগ্রামে একজন বটবৃক্ষ ছিল যার ছায়াতলে সবার আশ্রয় ছিল, ভালোবাসা ছিল।

ফাহমিদা আপার সুপ্রতিষ্ঠিত ছয় সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান লে. কর্ণেল এনশাদ ইবনে আমিন বিডি আর বিদ্রোহে মারা যান। ভেঙে পড়েছিলেন, কাতর হয়েছিলেন আবার নিজেকে শক্ত রেখে সামলেও নিয়েছিলেন পুত্রশোক। বিভিন্ন সাক্ষৎকারে এই নারকীয় হত্যাকান্ডের বিচার চেয়েছেন। লিখেছেন, ‘হৃদয়ে রক্তক্ষরণ’। ফাহমিদা আমিনের মূল্যায়নের প্রশ্নে আমি বলবো, বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কত বছর পর মানুষের কাছে পৌঁছেছে! জীবনানন্দ যার কবিতা আমাদের অপার্থিব আনন্দ দেয় সেই কবিতার সন্ধান আমরা কতদিন পরে পেয়েছি! তবে ফাহমিদা আমিন আপা বলতেন, এ সমাজে নারীদের লেখার জন্য প্রয়োজন সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষ করে সংসার থেকে। সংসার এখনো আটকায় নারীদের নানাভাবে। তবে অদম্যরা সেটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে এগিয়ে যায়।

আমাদের ফাহমিদা আমিন আপা শিক্ষায়, সামাজিক কর্মকাণ্ডে, ব্যক্তিগত জীবনসংগ্রামে, সাহিত্যচর্চায় এক উজ্জ্বল প্রতিকৃতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। জন্ম ও মৃত্যুমাসে একজন ফাহমিদা আমিনকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমাজের প্রত্যেক শ্রেণির মানুষকে মানবিক হওয়ার আহ্বান
পরবর্তী নিবন্ধসামাজিক মাধ্যমে শিশুদের ব্যবহার