সামাজিক আন্দোলনই রুখবে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি

সংস্কৃতিকর্মী ও নাগরিক সমাজের গণসমাবেশ

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ৭ নভেম্বর, ২০২১ at ৬:৪৬ পূর্বাহ্ণ

দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে আয়োজিত চট্টগ্রামের সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মী ও সচেতন নাগরিক সমাজের গণসমাবেশে বক্তারা বলেন, অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার চেতনায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা আজ কোথায়? ৭৫-এর পর দেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা সরে গেছে। রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না। সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাদ দিয়ে সর্বস্তরে ধর্মনিরপেক্ষতা কার্যকর করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ে তুলতে হবে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বক্তারা বলেন, প্রশাসনের অভ্যন্তরে এবং সরকারি দলের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে চিহ্নিত করে অপসারণ করতে হবে। সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্র বিস্তৃত এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রগতিশীলতার ধারা, অসাম্প্রদায়িকতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
গতকাল শনিবার বিকালে নগরীর ডিসি হিল মুক্তাঙ্গনে এই গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেনের সভাপতিত্বে গণসমাবেশে বক্তব্য রাখেন শহীদজায়া মুক্তিযোদ্ধা বেগম মুশতারী শফী, মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা অধ্যাপক রনজিৎ দে, অধ্যক্ষ আনোয়ারা আলম, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মো. জাহাঙ্গীর ও প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার। সমাবেশ সঞ্চালনা করেন আবৃত্তিকার রাশেদ হাসান। শুরুতে উদীচী ও রক্তকরবীর শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এছাড়া সমাবেশে আবৃত্তি পরিবেশিত হয়। শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফী বলেন, আজ বাংলাদেশের চেহারা দেখে নিজের বড় খারাপ লাগে। আমরা শিশুকাল থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বড় হয়েছি। আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে শিখেছিলাম। আমরা মুসলমান, আমরা নামাজ পড়ি, আমরা রোজা রাখি। আমরা যে যার ধর্ম পালন করলেও অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করি। আমার বাসার সামনে একটি মন্দির। ডান পাশে আরেকটি মন্দির। তারা পূজা করছে, আমরা নামাজ পড়ছি। আমাদের কিংবা তাদের তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ছেলেবেলা থেকেই এই শিক্ষাটা পেয়েছি। এই শিক্ষা নিয়েই ধর্ম পালন করছি। আমরা মানুষকে ভালোবেসেছি।
তিনি বলেন, আমরা অনেক কষ্ট করে এই বাংলাদেশ অর্জন করেছি। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কাউকে যেন আলাদা করে দেখা না হয়। আমরা সবাই মানুষ। এই বাংলাদেশকে শান্তির বাংলাদেশ হিসেবে দেখতে চাই।
কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, আমরা ১৯৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত একটি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যই সংগ্রাম করেছি। ছয় দফা থেকে যে উত্তরণ ঘটেছে এ জাতির, সেটাও ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান মিলিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছি আমরা। আদিবাসীরাও মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। ফলে এই ভূখণ্ডের সকল মানুষের দেশ এটি। এই দেশে রাষ্ট্রধর্ম কেন থাকবে? রাষ্ট্র গঠিত হয় তিনটা অঙ্গ নিয়ে প্রশাসন, আইন সভা এবং বিচার বিভাগ। প্রশাসনের পরিচালনায় থাকে সরকার। সেটি গণতন্ত্রে জনগণের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার কথা। কাজেই এই অঙ্গগুলোর তো ধর্ম পালনের কোনো সুযোগ নেই। এগুলোকে প্রত্যেক ধর্মের মানুষকে সেবা দিতে হবে। প্রত্যেক ধর্মের মানুষই তাদের কাছ থেকে কোনো না কোনো সেবা লাভ করে থাকে। এখানে বিভেদ সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না।
সংবিধানের সংশোধনের দাবি জোরালোভাবে তোলার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ দেওয়ার জন্য সামাজিক জায়গা থেকে চাপ তৈরি করতে হবে। সব ধর্মের মানুষ মিলে বাঙালি জাতীয়তার জাগরণ, বাঙালি ঐতিহ্যের লালন, আমাদের চেতনার পুনর্জাগরণে সকলকে আরও অনেক কাজ করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এটাকে বারবার বিপথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। প্রশাসন যদি সক্রিয় থাকত, একটি সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটতে পারত না।
বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, সমাজে ধর্মীয় উগ্রবাদ বেড়েছে। এটা যে শুধু মুসলমানদের মধ্যে তা নয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে জাতির মধ্যে যে সাংস্কৃতিক জাগরণ গড়ে তোলা হয়েছিল, আবারও সেই জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে।
ইঞ্জিনিয়ার দেলোয়ার মজুমদার বলেন, এই দল আজ ১২-১৩ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে, অথচ সাম্প্রদায়িকতা রুখতে পারে না। আওয়ামী লীগ নেতাদের বলছি, ভোটের জন্য যাদের সঙ্গে আপস করেন তারা কোনোদিন আপনাদের ভোট দেবে না। আপনাদের দল এমন মানুষে ভরে গেছে, যারা মনে করেন হিন্দুরা থাকলে ভোট পাব, চলে গেলে জমি পাব। দলটাকে শুদ্ধ করুন। বাহাত্তরের সংবিধান ফিরিয়ে আনুন। জামায়াত আওয়ামী লীগের ৩০ শতাংশ এমপি পদ দখল করার ঘোষণা দিয়েছে। আমার মনে হয়, ৩০ শতাংশ না পারলেও এরই মধ্যে তারা অনেকদূর এগিয়েছে।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক রণজিৎ কুমার দে বলেন, সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম না আনলে আমাদের ঐক্য পরিষদ করতে হতো না।
শিক্ষাবিদ আনোয়ারা আলম বলেন, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু এসব শব্দ আমরা আর শুনতে চাই না। আমরা সবাই বাঙালি। আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাই, মহামিলনের বাংলাদেশ চাই। যারা সাম্প্রদায়িক হামলা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচাহিদা বেড়েছে টিসিবির পণ্যে
পরবর্তী নিবন্ধএলপিজিএলে নিয়মে আসছে ভোক্তার গ্যাস