সাপ বিষধর! তবে প্রকৃতির পরম বন্ধু

খন রঞ্জন রায় | সোমবার , ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:১৫ পূর্বাহ্ণ

সারা বিশ্বে প্রতি চার মিনিটে একজনের মৃত্যু হয় সাপের কামড়ে। বড় অদ্ভুত এই তথ্য। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৫০ লাখ মানুষ সাপের বিষে আক্রান্ত হয়। সর্পদংশনে মারা যায় ১ লাখ থেকে দেড় লাখ মানুষ। সর্পদংশনের অন্তহীন মনোযন্ত্রণায় দ্বগ্ধ হয় আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার দরিদ্র দেশগুলোর দরিদ্র এলাকাগুলোর অধিবাসীরা। বিচিত্র সব পেশার সাথে জড়িত আর অরণ্যবাসী জীবনধারার মানুষেরা তাঁদের আকাঙ্ক্ষাগুলি সর্পদংশনের যন্ত্রাণায় বিদ্ধ হয়। বিশেষ করে কৃষকরা যখন প্রতিদিন ফসল ফলাতে মাঠে অবাধে যাতায়ত করতে হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৮ লক্ষাধিক মানুষ সর্পদংশনের শিকার হয়। বেদনার বড় রূপক হিসাবে ৬ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বিষধর ৭ প্রজাতির সাপ দেখা যায়। আরো ৮০ প্রজাতির সাপ বাংলাদেশের আনাচে কানাছে ঘুরে বেড়ায়। সাপের প্রতি আবেগের তোড়ে দিশাহারা হয়ে আরো ১৩-১৪ প্রজাতির সরিসৃপকে মানুষ সাপ বলে বিশ্বাস করে। এছাড়া আরো ২৩ প্রজাতির সাপ বাংলাদেশে রয়েছে।
সাপ দেখলেই অযথা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নির্দয় আচরণ করা যাবে না। বিস্ময়-বিমূঢ় চোখে দুর্ব্যবহার থেকে বিরত থাকা। ভয়ার্ত চিৎকার না করা, একটু সুযোগ পেলে সাপ নির্বিকার চিত্তে- নিরাপদে চলে যায়। মানুষের মননে-মগজে-আত্মবোধন থাকতে হবে যে সাপ স্বেচ্ছায় মানুষকে দংশন করে না। কেবল আত্মরক্ষার তাগিদে কিংবা উত্ত্যক্ত করলে কামড়ে দেয়। সাপের কাছে না ঘেঁষাই বাঞ্ছনীয়। একান্তই যদি হৃদয়ের উত্তাপ নিয়ে কামড় বসিয়ে দেয় তাতেও ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। বেশিরভাগ সাপ অবিষধর; তাৎক্ষণিকভাবে দুঃখ মোচনে কিছু প্রয়োজনীয় কাজ করতে হবে। দংশিত অঙ্গ বিশ্রামে রাখতে হয়। পায়ে হলে হাঁটাহাঁটি নিষেধ। হাতে হলে নাড়াচাড়া বন্ধ। রক্তপাত বন্ধে স্বাভাবিক ভাঙার মতো, কাঠ ব্যান্ডেজ দিয়ে হালকা বাঁধা। সুঁই ফোটানো কিংবা মলম, ছাই, লতাপাতার প্রলেপ না দেওয়া। ওঝা- বৈদ্য, ঝাড়-ফুঁক পরিহার করে দ্রুততম সময়ে নিকটস্থ হাসপাতালে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। সাধারণভাবে কিছু নির্দেশনা ও লক্ষণ জানা থাকলে মানুষের অজ্ঞতা দূর করতে সাহায্য করে। বিষাক্ত সর্পদংশনের বিশেষ কিছু লক্ষণ থাকে। দংশিত স্থানের চামড়ার রং পরিবর্তন, কালচে হওয়া, ব্যথা, দ্রুত ফুলে যাওয়া, ফোস্কা পড়া, ক্রমাগত রক্তপাত হতে পারে। চোখের উপরের পাতা ভারী হয়ে ঘুম ঘুম ভাব হলে, অস্বাভাবিক দুর্বলতা বোধ করলে, চোখে ঝাপসা ও একজিনিস একাধিক দেখা গেলে, চোখ নাড়াচাড়া করতে না পারা, জিহবা জড়িয়ে আসা, ঢোক গিলতে অসুবিধা, হাত পা অবশ হয়ে হাঁটতে অসুবিধা লাগা। শ্বাস প্রশ্বাস আটকে যাওয়া, কখনো শরীর নীল হয়ে যাওয়া, প্রস্রাবের রং কালো হলে বুঝতে হবে বিষাক্ত সাপের ছোবলে পড়েছে। সৎকিঞ্চিত কালবিলম্ব না করে নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে প্রেরণ করতে হবে। কবিরাজী, বনাজী, হোমিওপ্যাথি কিংবা অ্যান্টিহিস্টামিন, স্টেরয়েড, সিডেটিভ, অ্যাসপিরিন, কিংবা ব্যথা নিরাময়কারী নানা ওষুধের রঙিন চক্রজালে আটকা রাখা যাবে না।
গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে সাপের কামড়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ চিকিৎসকের দ্বারস্থ হয়। বাকীরা ছোটে ওঝার কাছে। বিষ-নির্বিষ নির্বিশেষে একই পরিণতি। বেশির ভাগ সাপই নির্বিষ থাকায় ক্ষেত্র বিশেষে ওঝার কেরামতি বলে ভাবা হয়। বিষধর সাপের কামড় হলে গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করলে রোগীর স্নায়ুতন্ত্রের বিষক্রিয়া শুরু হয়। কখনো বা দুঃখজনকভাবে অনন্তলোকের এক অনিঃশেষ যাত্রার সাথী হয়। অথচ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিতে পারলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগী সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ব্যাপারে বেশ সতর্ক। তাঁদের নির্দেশনা অনুসারে স্থানীয় বিষাক্ত সাপ থেকেই বিষ সংগ্রহ করে এই ইনজেকশন তৈরি করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিবছর বাংলাদেশকে ৬ হাজার অ্যান্টিভেনম দিয়ে থাকে। বাকী চাহিদা সরকারি-বেসরকারিভাবে আমদানী করে পূরণ করা হয়। সবই আনা হয় ভারতের তামিলনাডু থেকে। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ১৯৮৫ সালে অ্যান্টিভেনম তৈরির উদ্যোগ নেয়। সেই প্রকল্পের স্বপ্ন-আকাক্ষা অনন্ত নীলিমায় পৌঁছেছে। ভারত থেকে যে ধরনের অ্যান্টিভেনম আনা হয় তারা তা বিষাক্ত চারটি সাপের বিষ থেকে তৈরি করে। এই ইনজেকশন নির্ধারিত এই চার সাপের বাইরে অন্য বিষাক্ত সাপের কামড়ের বেলায় কতটুকু কার্যকর তা এখনো ধোঁয়াশা। এই কারণেই কিনা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে বিষাক্ত সাপের কামড়ে আক্রান্তদের ২০ শতাংশই মারা যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মোতাবেক অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে অ্যান্টিভেনম তৈরির কাজ এগিয়ে চলেছে। ২০১৮ সালে গৃহীত এই প্রকল্প ৫ বছর মেয়াদি হলেও পরবর্তীতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণি বিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োমেডিক্যাল টেকনোলজি বিভাগ এই কাজে সম্পৃক্ত হয়। আশা করা হচ্ছে বিশাল এই গবেষণাকাণ্ডের ফলে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রায় গৃহীত ২০৩০ সালের মধ্যে সাপে কাটা রোগী অর্ধেকে কমিয়ে আনার অঙ্গীকার যথাযথভাবে পূরণ করা যাবে। এরপরও সাপের কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিজেরা সচেতন হতে হবে। সাবধানী হতে হবে। বিশেষ করে গ্রামীণ সাপ উপদ্রত এলাকার জনসাধারণকে সাপের কামড়ের ব্যাপারে চিন্তার ঐক্য দেখাতে হবে। বসতবাড়ি, শোবার ঘরে সাপের আকর্ষণ বেশি হয়। বিশেষ করে ইঁদুর, তেলাপোকা, ঘাসফড়িং এর উৎপাত বন্ধ করতে হবে। ঝোপ ঝাড়ের ভিতর হাঁটতে সাবধানে-সচেতনে হাঁটতে হবে। কোনো গর্তে হাত ঢুকানো যাবে না। বাড়ি-ঘর, উঠান, জঙ্গলে জমানো লাকড়ি, খড় ইত্যাদি সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হবে। মাছ ধরার চাঁই বা জালের মধ্যে নিশ্চিত হয়ে হাত ঢুকানো। ময়লা-আবর্জনা সাপের বসবাসে উপযুক্ত স্থান। তা-পরিহার করে পরিচ্ছন্ন করতে হবে।
সাপের কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা কৌশল জানার জন্যই আন্তর্জাতিকভাবে পালন করা হয় সর্পদংশন সচেতনতা দিবস। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে মার্তৃমৃত্যু অপেক্ষা সাপে কামড়ে মৃত্যুর হার বেশি। এই উদ্বেগজনক তথ্য নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে পালন শুরু করা হয় এই দিবস। সর্পদংশনের সচেতনতা বোধোদয়ের মধ্য দিয়ে অবহেলিত এই ট্যাপিক্যাল রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠবে। এই দিবসের রঙিন আলোকছটায় নতুন করে জীবনোপলব্ধি ঘটবে-এমন প্রত্যাশার অনন্ত হিসাব করছি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধশ্রদ্ধাঞ্জলি: তবলাগুণী বিজন চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধচা-শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার