শ্রদ্ধাঞ্জলি: তবলাগুণী বিজন চৌধুরী

দীপেন চৌধুরী | সোমবার , ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:১৩ পূর্বাহ্ণ

‘তবলা নেওয়াজ’ বিজন চৌধুরী। চট্টগ্রামের শাস্ত্রীয় সংগীত জগতে ‘তবলা বিদ্যা’র মহাগুণী, পণ্ডিত বিজন কুমার চৌধুরী। তবলা গুরু বিজনদা একজন সঙ্গতিয়া বা শুধু তবলা বাদক ছিলেন না তিনি ছিলেন সার্থক ‘তবলা শিল্পী’। সবাই শিল্পী হতে পারেন না, কেউ কেউ হন। বাদক, সঙ্গতিয়া অনেকেই হন। কিন্তু একজন সার্থক তবলা শিল্পীর বড় গুণ তাঁর বাদনে ‘সৃজনশীলতা’। অনেকেই তাঁকে ‘লয় সৃজনের কারিগর’ বলেন। তবলাবাদনে তাঁর পরিমিতিরোধ, মনোজ্ঞ ছন্দ, বোলের বৈচিত্র্যের সুন্দর সমাহারে তিনি প্রতিটি পরিবেশনে বিশিষ্ট হয়ে উঠেন। তাঁর বাদনে শৈল্পিক দক্ষতার জন্য তিনি চট্টলবাসীর মনে চিরজাগরুক থাকবেন। বর্তমানে কিছু কিছু তবলা শিল্পী নামি শিল্পীর সঙ্গ ধরে চলতে চান। কারণ এতে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি অবস্থার সাথে অবস্থানেরও উন্নতিযোগ বিদ্যমান। আমাদের বিজনদা কখনো সে পথে হাঁটেন নি। তিনি অর্জিত বিদ্যা, অভিজ্ঞান দিয়ে ‘শিল্পের মান’ প্রাণ দিয়ে আগলে রেখে রক্ষা করেছেন, তাল বাদ্য শিক্ষার পথকে মসৃণ করেছেন। ‘তিনি আসলে শুধু শিল্পী নন, তিনি সাধক শিল্পী, সারাজীবন তিনি এক অদ্ভুত ঋজু চরিত্র নিয়েই চলেছেন। তবলাগুণী বিজন চৌধুরী তবলার গায়ে আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে চলে গেলেন। আহা, কী মহিমান্বিত মৃত্যু, কী গৌরব দীপ্ত প্রস্থান। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তবলার কলাকার বিজন চৌধুরী জীবনের শেষ দিন শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সঙ্গীতে নিবেদিত থেকেই সপ্রেম সাধনার অনন্য নিদর্শন রেখে গিয়েছেন তাঁর অসংখ্য গুণগ্রাহী শ্রোতা, শিল্পী, শিক্ষার্থীদের সামনে।
দেশের সঙ্গীত অঙ্গনের সবার প্রিয় দেশনন্দিত বিজন চৌধুরী ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ সেপ্টেম্বর মৃত্যুকে অমৃত করে চলে গেছেন রাজকীয় প্রস্থানে। অমর্ত্যলোকে, মানবসমাজের অগম্য সুদূরে। যে সব মানুষ যুগপৎ কর্মী এবং ধ্যানী, তাঁদের কাছে ‘কর্মই ধ্যান, ধ্যানই কর্ম’। আমাদের বিজনদা এক্ষেত্রে সার্থক বিজ্ঞাপন। কারণ তিনি একজন কর্মযোগী মানুষ। যিনি শূন্য থেকে অনন্য কীর্তি সুনির্মাণে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন আমাদের জন্যে। তবলা ধ্যান, তবলা জ্ঞান করে লয়ের চর্চায় নিজেকে চূড়ান্তরূপে সমর্পিত করে তিনি তাঁর সময়ে হয়ে উঠেছিলেন তবলা শিল্পের সার্থক প্রাণপুরুষ। বিজনদা অনুভব করতেন ‘শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নিজেকে পুরোপুরি সমর্পিত না করলে, এর সাধনায় নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদিত না করলে, সঙ্গীতে বিশাল মহাসাগর পাড়ি দেয়া অসম্ভব। বিজনদা নি:সন্দেহে ভাগ্যবান। তবলার সাধনপথে তিনি পেয়েছিলেন সদগুরু। শিল্প পথযাত্রায় যেটা প্রবলভাবে উপযোগী। সঙ্গীত তো সর্বতোভাবেই গুরুমুখী বিদ্যা। বিজনদার জন্ম ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত বাংলার সঙ্গীত তীর্থ ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার আড়াইসিতা গ্রামে, এক বনেদি সঙ্গীত পরিবারে। তাঁর মাতামহ স্বর্গীয় বীরেন ব্যানার্জী ছিলেন এলাকার স্বনামধন্য তবলাবাদক। তাঁর পিতা স্বর্গীয় সমরেন্দ্র চৌধুরী একজন সঙ্গীত শিল্পী, অভিনয়েও ছিলেন পটু। আর মা পারুল বালা দেবী ছিলেন এস্রাজবাদক। তাঁর স্ত্রী ইলা চৌধুরী নন্দিত নৃত্যশিল্পী ছিলেন। বিজনদার বোন মায়া চক্রবর্ত্তী কীর্তন গানে স্বনামধন্যা। যার রক্তে সঙ্গীত, তিনিই তো হবেন সঙ্গীতের সার্থক উত্তরাধিকার। শৈশবে তাঁর বাবা তাঁকে পণ্ডিত শিবশংকর মিত্রের কাছে তবলায় ভর্তি করেছিলেন। বিজন চৌধুরীর লয়ের সাধনার সেই শুরু। এরপর শিবপুরের প্রখ্যাত উস্তাদ এরশাদ আলী খান হয়ে পরিণত বয়সে সঙ্গীতাচার্য জগদানন্দ বড়ুয়ার কাছে তিনি লয়কারীর শিক্ষা নেন। তবলা সাধনে তাঁর নিষ্ঠা, শ্রম, অধ্যবসায় সর্বোপরি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি প্রবল আনুগত্যের কারণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘তবলা নেওয়াজ’। ভাবতে অবাক লাগে ষাটোর্ধ্ব বয়সে তিনি অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে পরীক্ষার হলে বসে ধ্রুব পরিষদের সপ্তম বর্ষে তবলার পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে ‘ছন্দ রত্নাকর’ উপাধি লাভ করেন। বিজনদা আজ আমাদের মধ্যে নেই। তাঁর মৃত্যুর শোক ও বেদনা আমাদের মন- মানসে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। তাঁর মৃত্যু আমাদের মাঝে শূন্যতার হাহাকার ছড়িয়ে দেয়। তাঁর অনুপস্থিতি আমরা আজো সুতীব্র অনুভব করছি। তাঁর মৃত্যুতে তবলা শিক্ষণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের শূন্যতার সৃষ্টি হলো যা অপূরণীয়। তথাপি তিনি রেখে গেছেন তার মেধা ও মননের গৌরবময় উত্তরাধিকার-অগণিত শিক্ষার্থী। পণ্ডিত বিজন চৌধুরী তারুণ্যের প্রকাশ ঘটিয়েছেন জীবন ও কর্মের সর্বত্রই। ছোট-বড় যেকোনো সঙ্গীতাসরেই তাঁর অংশগ্রহণ ছিল অপরিহার্য। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্মেলন (ঢাকা মিউজিক কলেজে আয়োজিত) এ উস্তাদ আলি আকবর খাঁ, উস্তাদ বাহাদুর হোসেন খাঁ, উস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ, বিদূষী স্মরণ মাথুর, পণ্ডিত কানাই দত্ত, পণ্ডিত মহাপুরুষ মিত্র, উস্তাদ আমির খাঁ, পণ্ডিত ভি. জি. যোগ প্রমুখের সাথে বাংলাদেশ থেকে সেতারে উস্তাদ মতিউল হক আর তবলায় ছিলেন এই চট্টলার স্বনামধন্য ছন্দভাস্কর বিজন কুমার চৌধুরী । ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ সেপ্টেম্বর জীবনের শেষ সঙ্গীতাসরেও তেমনি স্বনামধন্য বাঁশিবাদক উস্তাদ আজিজুল ইসলাম’র সাথে যুগলবন্দিতে ছন্দের অনবদ্য ঝড় তুলে পরিপূর্ণ আত্মমগ্নতায় লীন থাকা অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তবলা পণ্ডিত বিজনদা। ক্লান্তি কখনো তাঁকে গ্রাস করেনি। লয়’র সৃজনানন্দে মত্ত থেকে সম্রাটের মতোই স্বর্গারোহণ করেছেন। তাঁর পরিশীলিত শিক্ষা, মর্জি ও জীবনযাপনে একটা ছন্দ ছিল। মরণেও সে ছন্দের পতন ঘটতে দেননি। বিজনদা ব্যক্তিগত জীবনে মৃদুভাষী, বিনয়ী, কিন্তু আচরণে স্পষ্টভাষী , কঠোর এবং ক্ষমাহীন। বেতারে শিল্পীরা রাশভারী বিজনদাকে দেখলেই ভয়ে তটস্থ থাকতেন, কিন্তু রেকর্ডিং স্টুডিওতে অন্য তিনি। একেবারে সু-সহযোগী । তাল-ছন্দ হারালে তিনি বলে বসবেন ‘লয় আদর বোঝে না’। প্রায় প্রতিবছর ধ্রুব পরিষদের সঙ্গীতে বিভিন্ন বিষয়ে পরীক্ষা গ্রহণ উপলক্ষে বিজনদার সাথে বিভিন্ন জেলায় যাবার সুবাদে বয়সের বড় ব্যবধান সত্বেও তাঁর সাথে আমার সহজ অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। বিভিন্ন জেলা ভ্রমণকালে দর্শনীয় স্থানগুলো তাঁর দেখা চাই-ই-চাই। সেই সাথে ভোজনবিলাসী বিজনদার প্রিয় মাছ আর নলের গুড়ের সন্দেশ। ট্রেনে যেতে যেতে তিনি আমাদের লয়জ্ঞান আত্মস্ত করাতেন। প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করতেন। না পারলে তাকে সিট বদল করতে হতো। বিজনদাকে ধ্রুব পরিষদ সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্মাননা প্রদান করে বিভিন্ন সময়ে। পরিণত বয়সে সুবর্ণ ব্যক্তিত্ব বিজনদার এই বিদায় যেন ‘সূর্যাস্তের ছটায় মিশেছে রামধনু, সাত রঙে রঙিন হয়ে’ আমাদের হৃদয়ে। তাঁর কীর্তির গৌরব অমিলন থাকবে দীর্ঘদিন। কিন্তু সময়টা ক্রান্তির । ঐতিহ্য, ইতিহাস আর সংস্কৃতির প্রতি সামান্যতম দায়বদ্ধতা বা সবিশেষ প্রতিশ্রুতি নেই আমাদের। যা আছে তা শুধুই আমোদ গৌরব জীবনের যথেচ্ছ যাপন আর শুকনো তোষামোদ। তথাপি, এই অগ্রগণ্য শিল্পীর প্রতি তাঁর যোগ্য সম্মান প্রদর্শনে কোনো শৈথিল্য যেন আমাদের বিন্দুমাত্র গ্রাস না করে, অন্যথায় ভাবীকাল আমাদের ক্ষমা করবে না।
পুনশ্চ: পণ্ডিত বিজন চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আগামি ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর আনন্দী সংগীত একাডেমি, চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে এক স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এতে বিভিন্ন ধারার সংস্কৃতিজন তাঁকে স্মরণ করবেন। চট্টলার গুণী শিল্পী ও তাঁর গুণমুগ্ধ শিষ্যরা সংগীত পরিবেশন ও তবলায় লহড়া বাজিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। অনুষ্ঠানটি সবার যোগে পূর্ণতা পাক-এ প্রত্যাশা করি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রতারণা
পরবর্তী নিবন্ধসাপ বিষধর! তবে প্রকৃতির পরম বন্ধু