সাপে কাটা ৬৫ ভাগ মানুষ প্রথমে যায় ‘ওঝা’র কাছে

চমেক ও সিআইপিআরবির নেতৃত্বে গবেষণা ।। বছরে সর্পদংশনের শিকার ৪ লাখ ।। মারা যায় সাড়ে ৭ হাজার, ৯৫ শতাংশই গ্রামের

রতন বড়ুয়া | সোমবার , ১৯ জুন, ২০২৩ at ৫:২১ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে বছরে প্রতি লাখে ২৪৪ জন মানুষ সর্পদংশনের শিকার হন। এর মাঝে প্রতি লাখে ৪ থেকে ৫ জন মারা যান। মোট জনসংখ্যার হিসেবে দেশে প্রতি বছর সর্পদংশনের শিকার মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। এর মাঝে সাড়ে ৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় প্রতি বছর। মারা যাওয়াদের ৯৫ ভাগই গ্রামাঞ্চলের। সাপে কাটার পর ৬৫ ভাগ মানুষ এখনো প্রথমে ‘ওঝা’ বা প্রচলিত চিকিৎসকের নিকট চিকিৎসা নেন। অবস্থার অবনতি হলে পরে তাদের হাসপাতালে নেয়া হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (এনসিডিসি) উদ্যোগে ও অর্থায়নে সারা দেশে সর্পদংশন নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) মেডিসিন বিভাগ এবং সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) যৌথ নেতৃত্বে দেশের ৯ প্রতিষ্ঠান এ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে। সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ডেভ কেয়ার ফাউন্ডেশন, টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি)। এসব প্রতিষ্ঠানের ১৪ জন গবেষক এ কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন।

গবেষকরা হলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ, ডেভ কেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক এম এ ফয়েজ, সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের অধ্যাপক এ কে এম ফজলুর রহমান, টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের অধ্যাপক মো. রিদওয়ানুর রহমান, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ান হেলথ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শারমিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ড. আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রবিউল আলম মো. এরফান উদ্দিন, চমেক হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. পঞ্চানন আচার্য, সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের ডা. সেলিম মাহমুদ চৌধুরী, ডা. মো. জাহাঙ্গীর হোসাইন, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ডা. হেলাল উদ্দীন আহমেদ, টঙিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আবদুল্লাহ আবু সাঈদ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আবু শাহিন মো. মাহবুবুর রহমান এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের (বিআইটিআইডি) এপিডেমিওলোজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রুমানা রশীদ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এ গবেষণা কার্যক্রমে সহায়তা করে।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গবেষণা কার্যক্রমের আওতায় ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ৬২ হাজার বাড়িতে গিয়ে এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া সর্পদংশনের শিকার হয়ে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া ৪০০ জন রোগীর বর্তমান শারীরিক ও মানসিক অবস্থা যাচাই করা হয়। এর মাঝে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ২৪০ জন। ১৬০ জন ছিলেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের।

গবেষকরা বলছেন, সর্পদংশন বাংলাদেশের একটি জরুরি অবহেলিত স্বাস্থ্য সমস্যা। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সর্পদংশন কর্মকৌশল প্রণয়ন করেছে, যাতে ২০৩০ সাল নাগাদ সর্পদংশনজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যু ৫০ ভাগ কমিয়ে আনার লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও এ সংক্রান্ত জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়ন করেছে। এই কর্মকৌশল বাস্তবায়ন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রদত্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশে সর্পদংশনজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যুর হালনাগাদ তথ্য জানা খুবই জরুরি। মূলত এ কারণেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি দেশব্যাপী এই সর্পদংশন জরিপ বা গবেষণার উদ্যোগ গ্রহণ করে। চমেক ও সিআইপিআরবি যৌথভাবে এ গবেষণা কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেয়। সফলভাবে গবেষণা কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারায় সহযোগী সকল প্রতিষ্ঠান ও গবেষকদের ধন্যবাদ জানান চমেক মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ। গবেষণাটির তথ্যসমূহ উচ্চ পর্যায়ে ও বৃহৎ পরিসরে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশে সর্পদংশনের ঘটনা বেশি ঘটে খুলনা ও বরিশাল বিভাগে। ২৫৫৫ বছর বয়সী পুরুষরাই দংশনের শিকার হন বেশি। বাড়ির আশপাশে সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাতের মধ্যে সর্পদংশনের ঘটনা বেশি ঘটে।

শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ দংশনের পর দংশিত অঙ্গে গিঁট দেন। ৬৫ ভাগ মানুষ প্রথমেই ‘ওঝা’ বা প্রচলিত চিকিৎসকের নিকট চিকিৎসা নেন। অবস্থার অবনতি হলে পরে হাসপাতালে নেয়া হয়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এ বিষয়ে জোর সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন গবেষক দলের সদস্য চমেক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও টঙিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ। তিনি বলেন, এখন উপজেলা হাসপাতালগুলোতেও সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় অ্যান্টিভেনম দেওয়া হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে গেলে এবং যথাযথ চিকিৎসা পেলে সাপে কাটা রোগীকে বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ এখনো কুসংস্কারে বিশ্বাসী। যার কারণে অধিকাংশই সাপে কাটার পর সরাসরি হাসপাতালে না নিয়ে রোগীকে ওঝার কাছে নিয়ে যায়। সময়ক্ষেপণের পর রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটলে পরে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। ততক্ষণে দেরি হয়ে যাওয়ায় রোগীকে আর বাঁচানো সম্ভব হয় না। এজন্য গ্রামাঞ্চলে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা নিয়ে আরো বেশি সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নেয়া জরুরি।

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য বলছে, সর্পদংশনের পরে প্রতি হাজারে ২ জন মানুষের অঙ্গহানি ঘটে। আর ২ থেকে ২৩ ভাগ মানুষ বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক অসুস্থতায় ভোগেন। দীর্ঘমেয়াদী অবসাদগ্রস্ততায় আক্রান্ত হন প্রায় ১০ ভাগ মানুষ। এছাড়া আক্রান্তদের ১ দশমিক ৯ শতাংশ পরবর্তীতে মানসিক সমস্যায় ভোগেন। সর্পদংশনজনিত চিকিৎসায় প্রতি রোগীর প্রায় ২০০০ টাকা খরচ হয়।

মানুষের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবাদিপশু সর্পদংশনের শিকার হয়ে থাকে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১৯ হাজার গৃহপালিত পশু সর্পদংশনের শিকার হয়। এর মাঝে ২৫০০ গৃহপালিত পশুর মৃত্যু হয়। এতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে সর্পদংশনজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যু সম্বন্ধে এই হালনাগাদ তথ্যসমূহ ভবিষ্যতে সর্পদংশনের বিষয়ে বিভিন্ন কর্মকৌশল প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে গবেষকরা আশা প্রকাশ করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযারা বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙে, তাদের হাতে দেশ অনিরাপদ : তথ্যমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধচাঁদ উঠেছে সৌদি আরবে, পবিত্র হজ ২৭ জুন