পর্ব–২
রুপসা ব্রিজের আগে গত বছর খুলনার স্থানীয় বন্ধুদের আয়োজনে বেশকিছু গাছ লাগানোর সুযোগ হয়েছিল। প্যাডেলে পা রেখে সেসব গাছই খুঁজছিলাম। নিম, মেহগনি আর বহেড়ার বেশ অনেকগুলো গাছ চোখে পড়ল। গোড়া শক্ত হয়ে বেশ ডালপালা মেলতে শুরু করেছে বছর দেড়েক আগে লাগানো গাছগুলো। দেখতে কী যে ভালো লাগছিল! একসময় হয়তো অতিকায় মহিরুহের আকার ধারণ করবে গাছগুলো। এসব বৃক্ষের নুইয়ে পড়া ডাল হয়তো ছুঁয়ে দেবে আমার মতো কোন সাইকেল আরোহীকে। সেতু পেরিয়ে আবার রাবাত ভাইয়ের সাথে চায়ের কাপে চুমুক। আমি হাইওয়ে ধরে ফকিরহাট হয়ে গোপালগঞ্জের রাস্তা ধরার তালে থাকলেও ভদ্রলোকের অন্য প্ল্যান। রূপসা উপজেলার পিঠাভোগ গ্রামে নাকি রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষদের ভিটা আছে। সেটা দেখতে যাব কি না জিজ্ঞেস করলেন ভাই। এসব প্রস্তাবে না করতে নেই। জাবুসা থেকে ভেতরের রাস্তা ধরব। রওনা দিলাম পিঠাভোগ অভিমুখে। আমার গতির সাথে পাল্লা দিতে রাবাত ভাই মোটরসাইকেলের গতি সীমিত রাখছেন। মানসা বাজার পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষদের ভিটা। মূল ভবনে তালা দেওয়া থাকায় রবি বাবুর বংশের ঠিকুজি দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো।
আঠারো বাঁক বিশিষ্ট আঠারোবাঁকি নদীর সেতুতে গিয়েও হাওয়া খেয়ে এলাম খানিকক্ষণ। আরো কিছুক্ষণ চালিয়ে প্রবেশ করলাম ফকিরহাট উপজেলায়। ঢুকতেই একটা সাইনবোর্ডে ঘোষণা করা হয়েছে এটি ভিক্ষুকমুক্ত উপজেলা। খোদ ফকিরহাটেই ফকির নেই! অবশ্য ফকিরহাটের নামকরণ নিঃস্ব জনগোষ্ঠীর নামে হয়নি; এর নামকরণ করা হয়েছে এক মরমি সাধকের আস্তানাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা জনপদের কারণে।এখান থেকে হাইওয়েতে উঠে প্রথম বাজারের নাম ফলতিতা। অনেকগুলো মাছের আড়ত এখানে। এরপরে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে পড়ল তিনটি নদী। কালিগঙ্গা, কেন্দুয়া আর চিত্রা– সরু রেখার ন্যায় এগিয়ে চলা তিনটি নদী। এত অল্প দূরত্বে তিনটি নদীর দেখা মোহনা ছাড়া আর কোথাও দেখিনি। অবশ্য নদীর এমন ঝাঁকিদর্শনে মন ভরে না। এ অঞ্চলে পাটকে ঘিরে প্রভূত ব্যস্ততা। জলাভূমিতে পাট কেটে জাগ দেওয়া হয়েছে। আঁশটে গন্ধ পথচলতি নাকে ধাক্কা মারছে। মোল্লাহাটের কাছে মধুমতী নদীর উপর সেতু পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম গোপালগঞ্জ জেলায়। বৃষ্টির ফোঁটার অত্যাচার আরো বাড়তে থাকায় টানা চালিয়ে সোজা বশেমুরবিপ্রবি–র রিফাতের কাছে। শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজের গেটের কাছেই অপেক্ষা করছিল ও। বছর তিনেক বাদে দেখা ওর সাথে। খানিক বাদেই দেখা মিলল বিশিষ্ট কচুরিপানাপ্রেমী হাসিব ও তামিমের। বেশ খানিকক্ষণ আড্ডা পিটিয়ে রিফাতের ডেরায়। রিফাতের বইয়ের তাকে বিদ্যায়তনিক তথা একাডেমিক বই কখনো দেখিনি। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। হরেক বিষয়ের উপর হরেক কিসিমের বই। সুস্থিরভাবে বসে এ নিয়ে গল্প করতে কয়েকটা দিন পার হয়ে যাবে। কিন্তু আমার সময়ের পুঁজি যে যৎসামান্য!
ভোরে বেরোবার জন্য অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম সাড়ে পাঁচটায়। পাশের রুমের ছেলেটা দেখি এত ভোরে উঠে পড়েছে। পরীক্ষা চলছে। আমাকে দেখেই বয়াম থেকে এক মুঠো খেজুর হাতে ধরিয়ে দিল। রিফাতের দুই তলার বাসা থেকে সাইকেল নামাতেই দেখলাম আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। আরেক দফা গামলা ঢালা বৃষ্টির পূর্ব প্রস্তুতিই সম্ভবত। শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজের পেছন দিক থেকে উঠলাম হাইওয়েতে। অল্পক্ষণ চালাতেই বেদপাড়া পার হয়ে পুলিশ লাইন্স পড়ল। এবার শহর ছাড়ার পালা ধীরে ধীরে। দূরে গাছপালার ফাঁকে উঁকি দিতে শুরু করেছে গ্রামের অবয়ব। কথায় বলে, ঈশ্বর গড়েছেন গ্রাম আর মানুষ বানিয়েছে শহর। এই সকালে শহর ছাড়াতে ছাড়াতে এই কথা আরেকবার উপলব্ধি করলাম। ইতোমধ্যে ভেজা বাতাসকে আরো ভেজাতে থাকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। সামাজিক বনায়নের একাশিয়া গাছে রাস্তার দুধার ভর্তি। একাশিয়া বললে এই গাছকে কিছুটা শত্রু শত্রু মনে হয়। আরেকটা নাম আছে এই গাছের– সোনাঝুরি। এই নামটা এত শ্রুতিমধুর। শান্তিনিকেতনে সোনাঝুরি গাছের নামে হাটই আছে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে অবশ্য হাট–বাজারের জন্য বটতলাই বিখ্যাত। অন্য বৃক্ষের নামে হাট–বাজার খুব বেশি চোখে পড়ে না।
তুদবাটি ছাড়িয়ে বিজয়পাশা বাজার। রাস্তার ডানে মাঝে মাঝেই উঁকি দিচ্ছে রেল লাইন। খানিকটা তফাতে অবশ্য। একাশিয়া তথা সোনাঝুরির ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে দু–চারটা এলবিজিয়া, কৃষ্ণচূড়া আর একাশিয়ার দোসর বাবলা দেখা যাচ্ছে। বাবলা গাছের কাঁটার ফাঁকে ফাঁকে হলদে ফুল। বেশ লাগে দেখতে এই হলুদ ফুল। ফুকরা থেকে সদর উপজেলা ছাড়িয়ে প্রবেশ করলাম গোপালগঞ্জের আরেক উপজেলা কাশিয়ানীতে। গোপালপুর নামক বাজারে অনেকগুলো অশ্বত্থ গাছ। কে জানে কারও তুবোধ্থি লাভে অবদান রেখেছে কি না এসব বোধিবৃক্ষ! তিলছাড়া বাজার থেকে খানিক এগিয়ে ঘোনাপাড়া। এই বাজারে রাস্তার পাশেই নানান সময়ে দুর্ঘটনায় পড়া অনেক বাসের দুমড়ানো–মুচড়ানো কঙ্কাল রাখা। এক আখ বিক্রেতা বাসের কোঁচকান সামনের অংশে ঠেস দিয়ে রেখে আখ বিক্রি করছে। কিছু বাতিল ট্রাকও আছে। ব্যস্ত রাজপথে চাকা ঘুরানোর পালা ফুরিয়েছে তাদের। এসব চোখেই দেখছি। টানা বৃষ্টির তোড়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করার জো নেই। বৃষ্টির তীব্রতা বাড়লে মাথাটাকে কচ্ছপের মতো খানিকটা খোলসে তথা হেলমেটে ঢুকিয়ে ফেলতে চেষ্টা করি। তুগতির চেয়ে নিরাপত্তা জরুর্থি– লেখা বাসের তীব্র গতির ঝাপটায় মূল রাস্তা ছেড়ে মাঝে মাঝেই সাথের সরু অংশে সাইকেল নামাতে হচ্ছে। ভাটিয়াপাড়ার উড়াল পুল থেকে নেমে বামের একটা রাস্তা নড়াইলের লোহাগড়া হয়ে এগিয়েছে যশোরের দিকে। এদিকে কালনার ফেরিটা এখনো এ অঞ্চলের লোকের দুঃখ হয়ে আছে। অবশ্য দুঃখ ঘুচার অপেক্ষা চলছে। মধুমতি নদীর এপার–ওপারকে বেঁধে ফেলা হয়েছে প্রকৌশলীদের সাহায্যে। শিগগির যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হবে কালনা সেতু।
মাঝিগাতি ছাড়িয়ে গেড়াখোলায়। এখান থেকেই শুরু মুকসুদপুর উপজেলা। এখানে থামলাম সকালের নাশতা সারার জন্য। এর আগেই চালিয়ে ফেলেছি প্রায় ৫১ কি.মি.। নাশতা খেতে খেতেই অন্য টেবিলে বসা লোকদের কথোপকথন শুনছিলাম। পাটের পাকানো দড়ির মতো পেশল বাহুর একজন বেশ মারদাঙ্গা ভঙ্গিতেই বলে উঠল, তুওর জমিতে ফলন ভালো হয়। কিন্তু জমিতে রস থাকলেও ব্যাটার মুখের কথায় রস নেই।থ নাশতা সেরে বিল দেওয়ার সময় অন্য একজন ক্রেতা ছাপড়া এই দোকানের মালিককে নাশতা বাবদ কম রাখতে বলায় বিক্রেতা রাজি হলো না। ক্রেতা খেদের সুরে বলতে শুরু করল, তুখালি আমরা যা ফলাই তার দাম নাই। সবকিছুর দাম আছে। পাট বেচে এবার পাট ধোওয়ার পয়সাই উঠবিনা নে!্থ কঠিন প্রকৃতি থেকে বেঁচে থাকার উপকরণ ফলানোর চেয়ে সেটার ন্যায্য মূল্য পাওয়ার সংগ্রাম কোন অংশে কম নয়। এ অঞ্চলে এখন অবশ্য যেদিকেই চোখ ফেরাই, সেদিকেই পাটের রাজ্য। রাস্তার পাশের বিলে পাট। পথের ধারে ভেজানোর পর শুকানো হচ্ছে পাট। চারিদিকে শুধু পাট আর পাট। মহাসড়কের উপরের ছোট সেতুগুলোও পাটের দখলে। সমানে শুকানো হচ্ছে পাট। অবশ্য ভুল বললাম! এই বৃষ্টিতে শুকানো হচ্ছে নাকি পুনরায় ভেজানো হচ্ছে সেটা বু মুশকিল! সেতুগুলোতে ছড়িয়ে দেওয়া পাটগুলোকে দূর থেকে দেখলে জটাধারী সাধু বলে মনে হয়। এই কলিযুগে অবশ্য যার নখ আর জটা বড়ো, সে–ই বড়ো সাধু।