সমপ্রতি চিত্রনায়িকা পরীমনির অভিযোগ দায়েরের বিষয়টি আমরা মিডিয়ায় দেখলাম, পড়লাম। বিষয়টি সম্পর্কে কমবেশি সবাই আমরা জানি, তাই সঙ্গত কারণে আবারও উল্লেখ করছি না। আমার আজকের লেখার বিষয়ও পরীমনি’র অভিযোগ বিষয়ে নয়। তবে এই ঘটনাটির হাত ধ’রে এমনকিছু বিষয় আবারও আমরা দেখতে পেলাম, যা নিয়েই আমি কিছু লিখতে চাইছি। এই ঘটনাটি যখন মূলধারার মিডিয়ার পাশপাশি ফেসবুকেও চর্চিত হচ্ছিল তখনই আমরা দেখলাম (যা আগেও অসংখ্যবার আমরা দেখেছি) যে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের একটি বড়ো অংশ (এবং সর্বাংশে পুরুষ) তাদের পোস্টে-মন্তব্যে অকথ্য, অশ্রাব্য এবং অশালীন ভাষা ব্যবহার করছে।
নারী এবং নায়িকা, দুটি বিষয়ই আমাদের অবদমিত-প্রাণ পুরুষকূলের কাছে প্রায়শই ‘মুখ খারাপ’-এর বিষয়। এবং এটি আবহমানকাল ধরেই চলে এসেছে। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই। বাংলাদেশে কাজ করছে এমন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা একশন এইড জানাচ্ছে, বাংলা ভাষায় অধিকাংশ হয়রানিমূলক কথা, গালি, তিরস্কারমূলক শব্দই সাধারণত নারীকে অবমাননা অথবা হয়রানি করার জন্য ব্যবহার হয়। সেই সঙ্গে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি নারীকে যে নানা ধরনের মানসিক নিগ্রহের শিকার হতে হয়, তার একটি বড় অংশ হয় নেতিবাচক নানা শব্দের মাধ্যমে। কোনও ঝগড়া বিবাদে নারী বিভিন্ন ধরনের মৌখিক সহিংসতার শিকার হয়। খেয়াল করে দেখবেন, আমাদের আশপাশে প্রচলিত বেশিরভাগ গালির সাথে স্ত্রী লিঙ্গের সম্পর্ক রয়েছে এবং তিরস্কারমূলক শব্দের তেমন পুরুষবাচক পদ নেই। আর এই অবস্থাটিই একটি ভয়াবহ দিকে ইঙ্গিত করে সেটি হলো ভাষা যে-কোন সমাজের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটায়। যেহেতু ভাষা যেকোন সমাজের মানুষের ভাবনাকে ধারণ করে, ফলে কোন সমাজে নারীর অবস্থান সেই সমাজে নারীর প্রতি ব্যবহার হওয়া ভাষার মাধ্যমে বোঝা যায়।
একশনএইড বাংলাদেশের ‘সেফ সিটিজ ফর উইমেন’ ক্যাম্পেইনের একটি গবেষণার ফলাফল বলছে, দেশের শতকরা ৮৮ জন নারী রাস্তায় চলার পথে অপমানজনক মন্তব্যের মুখোমুখি হন। আরেকটি বেসরকারি সংগঠন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের এক জরিপে উঠে এসেছে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৭৯ শতাংশের বেশি নারী কখনো না কখনো অনলাইনে হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন এবং সেটি একমাত্র অশালীন ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়েছে। আর অনলাইন প্লাটফর্মতো বারোয়ারি জায়গা ফলে সেখানে অশালীন ভাষা ব্যবহারের হার এরচেয়েও বেশি তা বলাবাহুল্য। মাল, বেশ্যা, খানকি, মাগী, নটী…এরকম অসংখ্য শব্দ নারীদের প্রতি আকছার ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা ভেবেও দেখি না যে এসব শব্দের মাধ্যমে নারী আহত বা অসম্মানিত হতে পারে। নারীর প্রতি সহিংসতা যে শুধু শারীরিকভাবেই ঘটে না, সেটা যে ভাষার মাধ্যমেও ঘটতে পারে এবং ঘটে, সেই বোধ এখনো আমাদের মধ্যে কাজ করছে না। এমনকী কোনও একজন নারী ভিকটিমের প্রতি আমরা যে সহানুভূতিশীল কথা লিখি তাতেও আমরা অজান্তে অবমাননাকর কথা লিখে ফেলি। অনেকটা ঝি-কে মেরে বউকে শেখানোর মতো। সমাজে এই ধরনের শব্দের মাধ্যমে নারীকে হেয় করার চেষ্টা দিন দিন বেড়েই চলেছে। শহর-গ্রাম নির্বিশেষে নারীদের উত্ত্যক্ত করার সময় নানা ধরনের নেতিবাচক বা আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার হয়। চলার পথে শুধু রাস্তাতেই নয়, ঘরেও নারীর পথচলাকে রুদ্ধ করে এমন অবমাননাকর শব্দ। প্রায়শই দেখা যায়, সংবাদমাধ্যমেও নারীর প্রতি অসংবেদনশীল শব্দ ব্যবহার করা হয়।
এই যে আমরা এমডিজি বা এসডিজির সূচকে গালভরা নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের কথা বলি, নারীর প্রতি ভাষা ব্যবহারে সংযত না হলে নারীর মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি প্রশ্নের মুখেই পড়বে। নারীর প্রতি ভাষার ব্যবহারে সংবেদনশীলতা না এলে নারীর ক্ষমতায়নও সম্যকভাবে আসবে না। যদি সরকারি আইনে বা নীতিমালায় নারীর প্রতি ভাষা ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা এবং এ-বিষয়ক শাস্তির বিধান থাকত তাহলে হয়তো এই বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখা হতো না। প্রাসঙ্গিকভাবেই বলতে হয়, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীর প্রতি ভাষা ব্যবহারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি ও প্রয়োগ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। আমরা আশা করছি দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাব্যক্তিরা এদিকে দ্রুত নজর দেবেন এবং এ-বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করবেন।