প্রতিনিয়ত বাড়ছে শিশু নির্যাতন, শিশুর প্রতি সহিংসতা ও শিশু হত্যার ঘটনা। প্রতিদিন দেশের কোথাও–না কোথাও ঘটছে শিশুর প্রতি অমানবিক নিষ্ঠুর নৃশংসতা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সম্পত্তির দ্বন্দ্বে খুন হচ্ছে এসব অবুঝ শিশু।
৩০ মার্চ দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত ‘বস্তাবন্দি লাশ মিলল নিখোঁজ আয়নীর’ শীর্ষক সংবাদে বলা হয়েছে, নির্মম পরিণতির তালিকায় সর্বশেষ নাম সংযোজিত হলো আবিদা সুলতানা আয়নী ওরফে আঁখিমণির (১০)। গত বুধবার ভোর রাতে আয়নীর বস্তাবন্দি অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নগরের দক্ষিণ কাট্টলী মুরগী ফার্ম এলাকার আলম তারা পুকুর পাড় থেকে লাশটি উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেট্রো পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) টিম।
এক সপ্তাহ আগে পাহাড়তলী এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছিল আয়নী। তার খোঁজ না পেয়ে মঙ্গলবার আদালতে অপহরণের মামলা করেছিলেন তার মা বিবি ফাতেমা। মামলায় আসামি করা হয়েছিল স্থানীয় বাসিন্দা মো. রুবেলকে (৩৫)। রুবেল ওই এলাকার সবজি বিক্রেতা। তাকে আটক করার পর তার দেয়া স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আয়নীর লাশ উদ্ধার করা হয় বলে জানিয়েছে পিবিআই।
আজাদীর সম্মানিত পাঠক নিশ্চয় অবগত আছেন, গত ৫ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদীতে। এতে বলা হয়েছিল, ‘ধিক্কার, ধিক্কার’ রব ওঠে। শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। তবু শিশুদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ হচ্ছে না। উল্টো ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে শিশুকে শারীরিক শাস্তি, সহিংস আক্রমণ, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা, হত্যার পর শিশুর লাশ টুকরো করে ফেলে দেওয়া, অপহরণ, ধর্ষণের মতো একের পর এক ঘটনা। ২০২২ সালে চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় ২৭টি শিশুকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে নগরীতে ৯টি শিশু খুনের ঘটনা ঘটে। জেলায় এমন ঘটনা ঘটেছে ১৮টি।
কেন এমন সমাজবিরোধী ঘটনা ঘটছে? বিশেষজ্ঞরা তার মূল কারণ হিসেবে বলছেন, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব, অপ্রতিরোধ্য শিশুশ্রম, সম্পদের লোভ, বেকারত্ব, ভিনদেশী কালচার–সংস্কৃতির প্রভাব, অনলাইন প্রযুক্তিতে পর্নোগ্রাফির প্রসার ও সহজলভ্যতা, বেপরোয়া জীবনযাপন, পাচার,
কর্তৃত্বের বিরোধ–শত্রুতা, ব্যক্তি স্বার্থপরতা ইত্যাদি নেতিবাচক প্রভাবে সমাজের বিবেক বর্জিত কতিপয় নোংরা মস্তিষ্কের লোক শিশুদের প্রতি নৃশংস আচরণে সম্পৃক্ত হচ্ছে। তাই এসব নৃশংসতা বন্ধ করতে হলে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ অতি গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম
সেনের মতামত প্রকাশিত হয় আজাদীর একটি প্রতিবেদনে। বিষয়টি অমানবিক ও দুঃখজনক আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতার অভাব ও বিকৃত মানসিকতার কারণে শিশুর প্রতি এমন নির্মমতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। পাশাপাশি মানসিক
অস্থিরতা, স্বামী–স্ত্রীর পরকীয়ার কুপ্রভাব ও মাদকাসক্তির কারণেও সর্বস্তরে শিশুরা প্রতিহিংসার বলি হচ্ছে। শিশু আইন ২০১৩–এর ৭০ ধারা অনুযায়ী শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক নিষ্ঠুর আচরণ শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ। আইনে বলা আছে, কোনো শিশুকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার ঘটনা
বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত ২৭, ৩১, ৩২ ও ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে বর্ণিত সাংবিধানিক অধিকারসমূহের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কিন্তু আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই। অপরাধের প্রেক্ষাপটে ইতিবাচক পরিবর্তন দৃশ্যমান হচ্ছে না। ফলে নির্মমতার বলি হচ্ছে শিশুরা।
আসলে শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা আমাদের চরমভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। যদিও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে দেশে কঠিন আইন আছে। কিন্তু কঠোর আইনই শুধু অপরাধ দমনে যথেষ্ট নয়। সমাজ যদি অপরাধ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারে তবে যতো কঠোর আইনই থাকুক না কেন শিশুর প্রতি সহিংসতার মতো বড় ধরনের সঙ্কট দূর করা অসম্ভব।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশুদের প্রতি নৃসংশতা বন্ধ এবং তাদের সুরক্ষার জন্য পরিবারের ভূমিকার পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা খুবই জরুরি। শিশু নির্যাতন ও হত্যার মতো অমানবিক ঘৃণ্য অপরাধ প্রতিরোধ করতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ও
সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। কোমলমতি শিশুদের জীবনের নিরাপত্তায় শিশু নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ দেশের প্রতিটি মানুষের ঐকান্তিক দাবি। এই সহিংসতা ও নৃশংসতা বন্ধ করতে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। বিবেককে জাগ্রত করতে হবে।