সময়ের তুলনায় অগ্রসর মহীয়সী নারী রোকেয়া

আনোয়ারা আলম | শুক্রবার , ১১ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

গোলাম মুরশিদ বলেছেন, বাঙালি নারী জাগরণের ইতিহাসে ‘ব্যক্তির ভূমিকা ‘ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কথার সত্যতা যাচাই করা যায় রোকেয়ার জীবনের দিকে তাকালে। সবসময় প্রত্যক্ষ ভাবে না হলেও, পরোক্ষভাবেও এক একটা মানুষের হাতে এক একটা সময় গড়ে ওঠে। রোকেয়ার লেখার ভাষা ও বিষয়, দুইই ছিল সময়ের তুলনায় আশ্চর্য রকমের নতুন। প্রতিবাদী বক্তব্যে তিনি লিখেছেন অশিক্ষা, অবরোধ, বহু বিবাহ,বাল্যবিবাহ, অত্যধিক অলঙ্কার প্রীতি,উত্তরাধিকার প্রথার বিরুদ্ধে। যা পড়ে তৎকালীন অনেক সমালোচক আঁৎকে বলেছিলেন যে, ‘লেখিকা ক্রমাগত সমাজকে চাবকাইতেছেন’। আর এ সমালোচনা ছিল সমাজের প্রতিনিধি স্থানীয়।
একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের কন্যা রোকেয়া কিভাবে শিক্ষিত এবং প্রতিবাদী হলেন তা সে সময়ের প্রেক্ষিতে অবিশ্বাস্য ও অসম্ভব মনে হয়। কঠোর পর্দাপ্রথার মধ্যেও তিনি ছিলেন আজন্ম আগ্রহী, আগ্রহ ছিল বাংলা ইংরেজি শেখায়,আগ্রহ ছিল দেখায় এবং লেখায়।সাহায্য করেছেন বড়ো বোন ও বড়ো ভাই। পরবর্তীতে বিলাত ফেরত উচ্চ শিক্ষিত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বামীর সাহচর্যে ইংরেজি সহ বিভিন্ন ভাষায় দক্ষতা অর্জন।তবে তাঁর ভেতরে ছিল প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ও মানসিক শক্তি।
রাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলন থেকে শারীরিক ভাবে প্রায় বিচ্ছিন্ন এবং অবরুদ্ধ অবস্থায় থেকে, সৃষ্টিশীল ক্ষমতা, সংবেদনশীলতা এবং প্রখর আত্মসম্মানবোধের প্রকাশ হিসেবে রোকেয়ার সৃষ্টি সাহিত্যে যেমন কালজয়ী মর্যাদা লাভ করেছে তেমনি চিন্তার অচলায়তন ভাঙার ক্ষেত্রে তার লেখালেখি দিনে দিনে আরও বেশি বিপ্লবী শক্তি লাভ করেছে। বাঙালি সমাজের নারীবাদী চিন্তার পথিকৃৎ হিসেবে তাঁকে অনায়াসে আখ্যায়িত করা যায়।সাম্রাজ্যবাদ,পুরুষতন্ত্র,ধর্মীয় শৃঙ্খল এবং শ্রেণিশোষণকে সমন্বিত করে দেখার অন্তর্দৃষ্টিও যে তিনি অর্জন করেছিলেন তা তাঁর লেখনী থেকেই স্পষ্ট হয়। প্রচলিত বিশ্বাস মিথ ভাঙা এবং নতুন মানবিক জীবনের কল্পনা গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও তিনি অসাধারণ ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন।
বাঙালি নারীর, বিশেষত মুসলিম নারীর মুক্তিসাধনই ছিল তাঁর আরাধ্য বাসনা।নারী শিক্ষার বিস্তারকে তিনি প্রধান চাবিকাঠি হিসেবে গণ্য করেন। প্রকৃত সুশিক্ষা অর্থে তাঁর মতে–তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তথা শিক্ষা অন্ধ অনুকরণ নয়; মানুষের মধ্যে রয়েছে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা তা অনুশীলন বা ব্যবহারের মাধ্যমে বাড়ানো যায়। তিনি সুশিক্ষা অর্থ “মস্তিষ্কও মন ” উন্নত করার কথা বলেছেন। নারী শিক্ষার প্রশ্নে তিনি নারীর সামাজিক অবস্থান, অধিকার ও মর্যাদার বিষয়ে আলোকপাত করেছেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। “প্রথমেই শিক্ষার প্রসঙ্গটা আসেনি, এসেছে সমাজে নারীর অবনতির এক ভয়াবহ বর্ণনা। নারীকে চিত্রিত করা হয়েছে দাসী হিসেবে”–এই দাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়াই ছিল রোকেয়ার শিক্ষাচিন্তার লক্ষ্য।
সাহিত্যিক ও সমাজসেবীর পাশাপাশি রোকেয়া ছিলেন একজন সত্যদ্রষ্ট,মননশীল ও প্রাগ্রসর মানসিকতা সম্পন্ন শিক্ষা দার্শনিক। বিশ শতকের প্রথম শিকিভাগের মধ্যেই তিনি শিক্ষা বিষয়ে যেসব বক্তব্য রেখেছেন সেই রকম বক্তব্য সেই সময়ের এবং তার পরের দশকগুলোর পাশ্চাত্য দার্শনিকদের মধ্যে পাওয়া যায়।
তাঁর চিন্তাধারা এতোটাই আধুনিক -তিনি সেই সময়ে যেখানে পাশ্চাত্যেও নারীর চাকরি শুধুমাত্র বিশেষ কিছু যেমন শিক্ষকতার, নার্সিং,চিকিৎসা বা সেলাইয়ের কাজে সীমাবদ্ধ ছিল সেখানে তিনি লিখেছেন –,এমন কোন কাজ নেই, যা নারীর করা উচিত না।কেরানী থেকে ভাইসরয় পর্যন্ত সব কাজই তারা করতে পারেন যোগ্যতা থাকলে।এমনকি, তারা ব্যবসা করতে পারেন,অথবা পারেন মাঠে গিয়ে কৃষিকাজ করতে।একই সাথে লিখেছেন নারী অর্থনৈতিক ভাবে যতোই স্বাবলম্বী হবে, পুরুষের আধিপত্য থেকে ততোই রক্ষা পাবে।
তাঁর আর একটি গুণ অসামপ্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি।তাঁর প্রবন্ধের কোথাও এই সংকীর্ণতার ছাপ ছিল না।পদ্মরাগ উপন্যাসে তিনি হিন্দু মুসলমান খৃষ্টানের মিলিত যে সংসারের চিত্র এঁকেছেন, তা তাঁর ঔদার্যেরই বহিঃপ্রকাশ। এমনকি যখন সে যুগের মুসলমান সাহিত্যিকরা আরব-ইরানের খোয়াব দেখতেন, সেই সময়ে রোকেয়া লিখেছেন “আমরা প্রথমে ভারতবাসী—তারপর মুসলমান, শিখ বা আর অন্য কিছু।”
শামসুন্নাহার মাহমুদ বি,এ পাস করার পর রোকেয়া এক সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেছিলেন, সেখানে তিনি বলেছিলেন –“আমার সেই বত্রিশ বছর পূর্বের মতিচূরে কল্পিত লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি ব্যারিস্টারের স্বপ্ন আজ বাস্তবে পরিণত হইতে চলিয়াছে –আমার এ আনন্দ রাখিবার স্থান কোথায়?—+যে বাদশাহ কুতুবমিনার আরম্ভ করিয়াছিলেন, তিনি তাহার শেষ দেখিয়া যাইতে পারেন নাই।কিন্তু আমার মিনারের সাফল্য আজ আমি স্বচক্ষে দেখিতে পাইলাম।”
রোকেয়া এমন একটি সমাজ সৃজনের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে সুস্নিগ্ধ বৃষ্টিধারার অভাব হয়না; যেখানে ধর্ম বলতে প্রেম ও সত্য বোঝায়; যেখানে নরনারী উভয়ে সমাজের অঙ্গ, যেখানে কোঁদল করিবার অবসর মেলেনা; যেখানে নারী কেবল বিবিধ বসন ভূষণে সজ্জিত হইয়া পুত্তলিকাবত্‌ জীবন বহন করেনা;। “কিন্তু সত্যিকার অর্থে রোকেয়ার বৈপ্লবিক চিন্তা চেতনার যথার্থ মূল্যায়ন সেভাবে হয়নি।শুধু একটি পরিচয় তিনি মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত। যদিও সেই মহতী কাজেও তাঁকে অনেক প্রতিকূল পরিবেশে এগুতে হয়েছে এবং নিজের স্কুলকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁকে কিছুটা আপোষ করতে হয়েছে।
রোকেয়ার জীবৎকাল (১৮৮০ –১৯৩২) বিশ্লেষণে দেখা যায়,বিশ শতকের প্রথম দশকে তাঁর সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্বের উত্থান ঘটে। তাঁর চিন্তা চেতনার প্রসারও ঘটে এ সময়ে। তখন থেকেই তিনি লেখক, সমাজকর্মী, শিক্ষাব্রতী প্রভৃতি নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।সবচেয়ে বড়ো বিষয় নিজের আত্মসচেতন সত্তা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন আর এই আত্মসচেতন সত্তা মাত্রই বড়ো কোন ক্ষেত্র,উচ্চতর কোন কোন আদর্শের জন্ম দেয়। একই সাথে তিনি বারে বারে বিভিন্ন লেখায় নারীর মানসিক মুক্তি তথা চিত্তের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন যা অর্জন করা খুব সহজসাধ নয়।এই মহীয়সী নারীর প্রতি শ্রদ্ধা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভালোবাসার মৃদঙ্গ সুরে
পরবর্তী নিবন্ধনগরীতে ৮ মাদকসেবীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা