বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশের পেলব সোঁদামাটিপ্রজ সাহিত্যে নদী একটি স্বাভাবিক অনুষঙ্গ। এদেশে নদীকে নিয়ে যতটা সাহিত্য রচিত হয়েছে, সে তুলনায় সমুদ্র নিয়ে রচনা একেবারেই অপ্রতুল। এখানকার প্রাচীন সভ্যতাগুলো নদীকেন্দ্রিক ছিলো বলে বাংলা সাহিত্যের সূচনালগ্নে কবিতায় নদী গতিময়তা পেয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদেও নির্বাণের রুপকে এসেছে নদী। আদি মহাকাব্যগুলোতে নদীকে দেব-দেবীর সাথে তুলনা করে তাদের বন্দনা গাওয়া হয়েছে। তবে পরবর্তীতে কবিতার চেয়ে উপন্যাসে নদী ও নদীকেন্দ্রীক জীবন প্রাধান্য পেয়েছে বিস্তৃত পরিসরে। কাজী আবদুল ওদুদের ‘নদীবক্ষে’(১৯১৯), মানিক বন্দােপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ (১৯৩৬), তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ‘কালিন্দী’ (১৯৪০), বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’ (১৯৫০), অদ্বৈতমল্ল বর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৫৬), সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’ (১৯৫৭), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ (১৯৬৮), সত্যেন সেনের ‘একূল ভাঙে ওকূল গড়ে’ (১৯৭১), আবু ইসহাকের ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ (১৯৮৫), হরিশংকর জলদাসের ‘জলপুত্র’ এর মতো উপন্যাস আমাদেরকে সেকথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। আসলে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রতটে আমাদের বাংলাদেশের অবস্থান হলেও সমুদ্র আমাদের সাহিত্যকে সেভাবে প্রভাবিত করতে পারে নি।
প্রাচীন ও মধ্যযুগে নদীকেন্দ্রীক জীবন- জীবিকার প্রবাহ দেখা গেলেও ক্রমান্বয়ে ‘ভূমি নির্ভর জীবিকায় ভূমির উবর্রতা ক্রমহ্রাসমান হারে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছালে দারিদ্র জেঁকে বসা মানুষগুলো নদী নিয়ে যা ভেবেছে, সে তুলনায় সমুদ্র নিয়ে ভাববার ফুরসৎ পেয়েছে কমই। এ-কারণে দেখা যায়, নদীর তুলনায় আমাদের আবেগ বা কল্পনায় সমুদ্রচর্চার স্থান নিতান্তই নগন্য। অথচ ইউরোপীয় কবিতায় এক বর্ণিল স্থান দখল করে আছে সমুদ্র। শেলি, বায়রন, কীটস, টেনিসন, ব্রাউনিং, সুইসবার্ণ, হুইটম্যান, পাউন্ড, এলিয়ট সহ অনেকরই কবিতায় নানা ভাবনার সংকেত, উপমা, রূপক, প্রতীক, চিত্রকল্পে সমুদ্র ধরা দিয়েছে নানা ভাঙ্গিতে, নানা রূপ ও রহস্যে। যেমন রবার্ট ব্রাউনিং লিখেন-
‘ধূসর সমুদ্র আর দীর্ঘ এক কৃষ্ণ তটরেখা,
এবং হলুদ অর্ধচন্দ্র স্ফীতমুখে চেয়ে আছে হেলে’
(অনুবাদ- বিষ্ণু দে)
টি. এস. এলিয়টের কথায় –
‘সমুদ্র ভূমিরও প্রান্ত, স্পর্শ করে যায়
গ্রানিটের স্তর আর তটভূমিবক্ষে দেয় ছুঁড়ে
বিচিত্র প্রাক্তন যত সৃষ্টির ইঙ্গিত ; ’
(অনুবাদ- শঙ্খ ঘোষ)
বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘ ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য গ্রন্থে সমুদ্র প্রথম সমহিমায় উপস্থাপিত হয়। তিনি লেখেন-
‘রাবণ, ফিরায়ে আঁখি, দেখিলেন দূরে
সাগর- মকরালয়। মেঘশ্রেণী যেন
অচল, ভাসিছে জলে শিলাকুল, বাঁধা
দৃঢ় বাঁধে। দুই পাশে তরঙ্গ- নিচয়,
ফেনাময়, ফণাময় যথা যণিবর,
উথলিছে নিরন্তর গম্ভীর নির্ঘোসে। ’
মূলত কবি নবীনচন্দ্র সেন, বিহারিলাল চক্রবর্তী, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ রবীন্দ্র পূর্ববর্তী অনেকের কবিতায় নিজস্ব ভঙ্গিতে সমুদ্র উঠে আসলেও প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রোত্তর যুগেই নানা ব্যঞ্জনায়, বিষয়- বৈচিত্র্যের অভিনবত্ব ও প্রাচুর্যে সমুদ্র কারুময় হয়ে উঠে। রবীন্দ্রনাথ ‘সোনার তরী’ কবিতায় সমুদ্রের প্রতি বা ‘বসুন্ধরা’ কাব্যে সমুদ্রের সাথে নিজের আত্মিক বন্ধন খুঁজে পান। সৌন্দর্যের কবি নজরুলও সমুদ্রে বিভোর ছিলেন। তিনি চাঁদের সাথে সমুদ্রের সখ্যতা লক্ষ করেছেন,-
‘চাঁদের চাঁদিনী বুঝি তাই এত টানে
তোমার সাগর প্রাণ, জাগায় জোয়ার
কী রহস্য আছে চাঁদে লুকানো তোমার ?
…ঐ চাঁদ সে কি প্রেয়সী তোমার ? ’
(সিন্ধু)
কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সমুদ্র এক অনন্য চারিত্র্য পেয়ে যায়। তার কবিতায় যেমন, –
‘পৃথিবীর শঙ্খমালা নারী সেই ; -আর তার প্রেমিকের ম্লান
নিঃসঙ্গ মুখের রূপ, – বিশুস্ক তৃণের মত প্রাণ,
তুমি তাহা কোনোদিন জানিবে না ;
(সিন্ধু সারস)
কবি আল মাহমুদ মানিক কুড়াতে সমুদ্রের অথৈ জলে নামতেও রাজি, –
‘ঢেউয়ে ভেসে গিয়ে নামবো গিয়ে অথৈ জলে,
কেনো মিছামিছি তটের বালুকা গোনো
নেমে এসো সাথে মানিক কুড়াবো জলে ’
(সমুদ্র নিষাদ)
আসলে নিছক সমুদ্র বর্ণনাার যুগতো শেষ হয়ে গেছে সেই কবেই ! সমুদ্র এখন আমাদের নিত্য জীবনের উর্বও অনুষঙ্গ। চন্দন চৌধুরী যেমনটা ভেবেছেন,
‘যে মেয়েটা কাল বলেছিল গ্রহণের নাম সম্পর্ক হয় না /
তাকে সূর্যাস্ত দেখিয়ে বলেছি, দেখো সমুদ্র সিগারেটের মতো / সূর্য পান করছে …’
( স্নান)
বিষ্ণু দে-র কাছে সমুদ্র সমকালীন রাজনীতির নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন ও আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠে-
‘পার্থের পৃথিবী নগ্ন দুঃশাসন দুর্বার মরুতে
বালিতে ছুটেছি- ব্যর্থ বর্তমান জীবনের মত।
ছায়া কোথা ? শুধু সোনা পুড়ে পুড়ে বালিতে নিষ্ঠুর ,
আমাদের জীবনের মত ব্যর্থ, লবণাক্ত জলে। ’
(সমুদ্র রেখা)
অন্যদিকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল বুভুক্ষ সমুদ্রে দেখেছেন,
‘তিনভাগ গ্রাসিয়াছে … এক ভাগ বাকি
সুরা নাই পাত্র হাতে কাঁপিতেেেছ সাকি’।
(সিন্ধু)
মহাদেব সাহা’ও একইভাবে সমুদ্রকে পেয়েছেন,
‘তাই সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বারবার আমি
দেখেছি জলের দম্ভ’
(আমার সমুদ্র দেখা, আমার পাহাড় দেখা)
কবি অঞ্জন সেন লক্ষ করেছেন, উদ্বিগ্ন মানুষ যেন জলের কাছে সমর্পিত। সমুদ্রের কাছে তার আকুতি –
‘আমাদের এই তিনভাগ জলে একভাগ ডাঙা
উঁচু হয়ে আছে জল ঘোরে
আকাশ পাহাড় কৃষিক্ষেত ঘুরে সমুদ্র হয়ে যায় প্লাবন
আমরা মাছ হয়ে ভেসে আছি
তুমি আমাদের শান্ত করো হে জল ’
(জলের)
মানুষের জীবনের মতো সমুদ্র পালা বদলের এক দীর্ঘ উপাখ্যান। একূল ভাঙে তো ওকূল গড়ে। কূল ছাপিয়ে আসে জোয়ারের জল, ফিরে যায় ভাটাতে। জোয়ার-ভাটার ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় মেতে থাকা সমুদ্রের নিত্য দিনের অভ্যাস। অমিয় চক্রবর্তীর কথায়-
‘নীল কল। লক্ষ লক্ষ চাকা। মর্চে পড়া। শব্দের ভিড়ে
পুরনো ফ্যাক্টরী ঘোরে।
নিযুত মজুরি খাটে পৃথিবীকে
বালি বানায়, গ্রাস করে মাটি, ছেড়ে দেয়, দ্বীপ রাখে, ’ ( সমুদ্র)
সমুদ্রের আগ্রাসী রূপ দেখে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন,
‘জোয়ারে ফুলিছ তুমি, ঢেউয়ে ঢেউয়ে স্ফূলিঙ্গ ছড়ােেয় /
গ্রাসিছ সৈকত — ভূমি তৃপ্তিহীন রাক্ষসের পারা ! ’
(অন্ধকারে সমুদ্রের প্রতি)
একইভাবে চৈতালী চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন,
‘যে-সব শরীরে একবার সমুদ্র ঢুকেছে, তারা
সুইসাইডাল নোট লিখে রেখে যেতে আর সময় পায়নি।’
কিন্তু তারপরও বুদ্ধদেব বসু সমুদ্রের মধ্যে অন্তহীন স্নেহ খুঁজে পেয়েছেন মানুষের মতোই-
‘সমুদ্র অপরিসীম, সমুদ্র ভীষণ,
কিন্তু সে ভালবাসে তোমার সঙ্গে খেলা করতে,
তার মধ্যে অন্তহীন স্নেহ।’
(সমুদ্র স্নান)
মানুষ এজন্য বার বার সমুদ্রে যায়। সমুদ্রকে উপভোগ করে। নিভৃতে পেতে চায় নিশিরাতের সমুদ্র। যেখানে নিস্তব্ধ মুহুর্তগুলো অজিত দত্তের কবিতার মতো,
‘নিস্তব্ধ মুহুর্তগুলো সাগর গর্জনে ওঠে কেঁপে,
স্রোতের বিদ্রুপ শুনি প্রতিবার দাঁড়ের নিক্ষেপে’
(নোঙর)
নিশিরাতে সমুদ্রের আগ্রাসী রূপ- তীব্র চিৎকার, বিপুল গর্জন আর মুখচোরা গোঙানি মানুষকে নিয়ে যায় মহাকালের দোরগোড়ায়। কান পাতলেই শোনা যায় সে সুর। কবি শঙ্খ ঘোষ তা শুনেছেন, তিনি বলেছেন,
‘কানে এসে কান পাতো শোনা যাবে সমুদ্রের স্বর
প্রতিটি হাড়ের গায়ে লেগে আছে ঝিনুকের দাগ
বাকি রেখে চলে যাব শেষ মুহুর্তের কথাগুলি।’
( সমুদ্র সূর্যাস্ত শবদেহ)
বিনয় মজুমদারের কথায়,
‘সুদূর সমুদ্রজলে একটি গিটার ভেসে চলেছে এখন
যখন সকলে ডুবে নিশ্চিহ্ন হয়েছে সব হারিয়ে গিয়েছে
তখন সমুদ্রজলে একটি গিটার ভেসে ভেসে চলেছে এখন’
(কবিতার খসড়া)
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এজন্য রাত্রির সমুদ্র তীরে যেতে বলেছেন,
‘রাত্রির সমুদ্রতীরে দেখা হবে রাত্রির সমুদ্র
আর কিছু নয়
জলের কিনার ঘেঁষে জলের গভীর মর্ম ছুঁয়ে
বসে থাকা হবে
শব্দ দেবে প্রতিচ্ছবি বর্ণ দেবে নিবিড় বন্ধুত্ব
স্বপ্নে যে রকম ’
(দেখা হবে)
হয়তো তাই শক্তি চট্টোপাধ্যায় লক্ষ করেছেন,
‘খালি বৃষ্টি হয় এই সমুদ্রের উপকূলে, তীরে ’
(সমুদ্রের উপকূলে তীরে)
আদিকালে সমুদ্রোপকূলে গড়ে উঠতো সভ্যতা। সমুদ্রশাসিত মানুষের জীবন, চিন্তা, ও কল্পনার সাথে সমুদ্র কীভাবে মিশে আছে মহাকালের খেরোখাতার পরতে-পরতে রয়েছে তার অনুরণন। সমুদ্র ভাঙনের শব্দ আর চর জাগানোর গল্পই শুধু শোনায় না ; তীরবর্তী প্রান্তিক মানুষের জীবনচিত্র ও ঢেউয়ের ভাঁজে মিশে থাকা অশ্রুজলের কাহিনিও শোনায়। শোনায় জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকা মানুষের নানা গল্প। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করে ‘জন্মদিনে’ কবিতায় লিখেছেন, ‘কত যে ইঙ্গিত ভঙ্গি জেগে ওঠে, ভেসে চলে যায়।’
আসলে মহাকালের শতসহস্র আনন্দ-বেদনা, ঘটনা-দুর্ঘটনার সাক্ষী এই সমুদ্র। কবি নির্মলেন্দু গুণের কথায়, ‘সইতে জানে বইতে জানে সারা জগৎময় ’ (ঐক্যবদ্ধ জল) অথবা ভাগ্যধন বড়ুয়া’র ,
‘সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলা ছিপিবদ্ধ বোতলে বার্তা
কালে কালে খুঁজে নেবে নিয়তি তাড়িত পাঠক!’
(সমুদ্রের পানি মূলত শাদা)
অথচ এই সমুদ্রই দিনেরবেলায় তরল রূপোর উজ্জ্বলতা নিয়ে নিরবধি বয়ে প্রশান্ত চিত্তে আমাদের মন জুড়িয়ে দেয়। প্রমথ চৌধুরীর কথায়,
‘সমুদ্রের ভাষা শুনি খুলি অন্তঃকর্ণ,
ব্যঞ্জন তাহাতে নাই, শুধু স্বরবর্ণ ।
(তত্ত্বদর্শীর সিন্ধুদর্শন)
প্রত্যেক মানুষের ভেতর একএকটি সমুদ্র থাকে। বিশাল জলদি তরঙ্গমালার স্পর্শ পেলে তা উথলে ওঠে। কবিরা তা ব্যারোমিটারে মাপতে পারে। সমুদ্রের কাছে গেলে তার বিশালতার তীরে দাঁড়ালে মন মুগ্ধতার প্রশান্তিতে ভরে যায়। মাতাল, চঞ্চল সমুদ্রের ঢেউ দোলায়িত করে চিত্তের বিচিত্র তরঙ্গমালা। সমুদ্রের অথৈ নীল জলরাশি কার না ভালো লাগে! আর বাংলার কবি-সহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মে বিশেষত কবিতায় সমুদ্র এসেছে ঘুরেফিরে, নিত্যনতুন ব্যঞ্জনায়।
কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের মনোভূমে বিস্তার লাভ করা দুটি লাইন দিয়ে শেষ করছি-
সমুদ্রের নীল গাইয়ের পিঠে পিঠে চড়ে বেড়ানোর শখ
সবরকম কড়ি আর ঝিনুকের যোনির ভিতর
প্রবেশ করতে চায় আকাঙক্ষা আমাদের…’
(সমুদ্র পাশের এ্যাকুয়ারিয়ামে)।