সমাজের মানুষ হঠাৎ অসহিষ্ণু হয়ে উঠলো কেন

| বুধবার , ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৭:৩৪ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের মানুষ হঠাৎ অসহিষ্ণু হয়ে উঠলো কেন। সামাজিক জীবনের ঘটমান বাস্তবতায় সামগ্রিক ভাবে অসহিষ্ণুতার প্রসঙ্গ ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সহিষ্ণুতা ও অসহিষ্ণুতার ভারসাম্য যথাযথভাবে রক্ষিত হচ্ছে না মানুষের জীবনে। পাশাপাশি বৃহত্তর সমাজের সর্বত্রই চাপা উত্তেজনা ও অসহিষ্ণুতা কারণে প্রায়শই মানুষের স্বাভাবিক আচরণ ও কার্যক্রমসমূহ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

১১ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত ‘যুবলীগ কর্মীর ছুরিকাঘাতে আওয়ামী লীগ নেতা খুন’ শীর্ষক সংবাদে অসহিষ্ণুতার প্রকাশ স্পষ্ট। সংবাদে বলা হয়েছে, নগরের পাহাড়তলীতে ভোটের ‘টাকা ভাগাভাগি’ নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে যুবলীগ কর্মী জসিমের ছুরিকাঘাতে মো. হোসেন (৪৫) নামে এক আওয়ামী লীগ নেতা খুন হয়েছেন। আহত হয়েছেন নিহতের ছেলে অমিত হোসেন (২০)। নিহত হোসেন মান্না ওই এলাকার মধ্যম সরাইপাড়া এলাকার মো. নুরু মিয়ার ছেলে। তিনি পাহাড়তলী ১২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। গত রোববার দুপুর ২টার দিকে পাহাড়তলী থানার সরাইপাড়া এলাকায় এবতেদায়ি মাদ্রাসার সামনের পুকুরপাড়ে এ ঘটনা ঘটে। তিনি চট্টগ্রাম বিমানবন্দর এলাকায় ব্যবসা করতেন।

পাহাড়তলী থানার ওসি মো. জহির উদ্দিন বলেন, পূর্ব শত্রুতার জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে স্থানীয় একটি বায়িং হাউজের কর্মী মো. জসিম জড়িত বলে ধারণা করছে পুলিশ। জসিমকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে। ঘটনার পর তিনি পুরো পরিবার নিয়ে বাসা থেকে পালিয়ে গেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানায়, হোসেন ও জসিম দুজনই নগরীর সরাইপাড়ার বাসিন্দা। দীর্ঘদিন ধরে তাদের মধ্যে বিরোধ চলছিল। রোববার দুপুরে রাস্তায় কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে হোসেনকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে জসিম পালিয়ে যায়। স্থানীয় কয়েকজন হোসেনকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তাদের মতে ১০ আসনের নির্বাচনের ৮ হাজার টাকা নিয়ে দ্বন্দ্বে হাতাহাতির একপর্যায়ে ছুরিকাঘাতে হোসেনের মৃত্যু হয়েছে।

অন্যদিকে, আরেকটি সংবাদ এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। সেটি হলো, ‘শাশুড়ি হত্যায় জামাই গ্রেফতার’। এতে বলা হয়েছে, নগরীর বন্দর থানার কলসীদীঘি রোডে পারিবারিক কলহের জেরে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে শাশুড়িকে হত্যার অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার করেছে মেয়ের জামাই মো. আজিম (৫৩) কে। খুন হওয়া শাশুড়ির নাম রুমা আক্তার প্রকাশ মঞ্জুরা বেগম (৫০) বলে জানা গেছে। সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টার দিকে নগরীর ডবলমুরিং থানার সুপারিওয়ালা পাড়া এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে গত রবিবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার যেকোনো সময়ে গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরীর বিল্ডিংয়ের ৪র্থ তলায় ৯ নম্বর রুমে শাশুড়িকে হত্যা করে মেয়ের জামাই আজিম পালিয়ে যায় বলে অভিযোগ। গ্রেফতার মো. আজিম কর্ণফুলী থানার শিকলবাহা জামালপাড়ার মৃত মো. আলী জোহারের ছেলে। বন্দর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কিশোর মজুমদার বলেন, “পারিবারিক কলহের জেরে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে শাশুড়ি রুমা আক্তার প্রকাশ মঞ্জুরা বেগমকে হত্যা করে মেয়ের জামাই আজিম। হত্যা করে গলায় গামছা পেঁচিয়ে ঝুলিয়ে রেখে আজিম পালিয়ে যায়। সোমবার দশটার দিকে সুপারিওয়ালা পাড়া এলাকা থেকে আজিমকে গ্রেফতার করা হয়।” তিনি আরও বলেন, “প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আজিম শাশুড়িকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। আসামি জানিয়েছে, শাশুড়ি পরিবারের নানান বিষয় নিয়ে অশান্তি সৃষ্টি করার ক্ষোভে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করে আজিম।

এসব ঘটনায় সহজেই অনুমান করা যায় যে, বাংলাদেশের মানুষ ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। সামাজিক জীবনের ঘটমান বাস্তবতায় সামগ্রিক ভাবে এই অসহিষ্ণুতার প্রসঙ্গ ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। স্পষ্টত বলা যায়, ‘মানুষের জীবনে সহিষ্ণুতা ও অসহিষ্ণুতার ভারসাম্য যথাযথভাবে রক্ষিত হচ্ছে না। পাশাপাশি বৃহত্তর সমাজের সর্বত্রই চাপা উত্তেজনা ও অসহিষ্ণুতার কারণে প্রায়শই মানুষের স্বাভাবিক আচরণ ও কার্যক্রমসমূহ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে’। সামাজিক মূল্যবোধ কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছেতা ভাবতে গেলেই শিউরে উঠতে হচ্ছে। এই প্রবণতা কতটা বিপজ্জনক, তা ধারণার বাইরে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রমক্ষয়িষ্ণু ভঙ্গুর অবক্ষয়গ্রস্ত, অসভ্য, নিষ্ঠুর ও অমানবিকতার ঘেরাটোপে বন্দি আমাদের সমাজব্যবস্থা। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের একপাক্ষিক দাবি পরাজিত এই অসভ্যতায়। অবক্ষয়ের তলানির দিকে ক্রমধাবমান সমাজ, সমাজব্যবস্থা। এই হিংসা, সহিংসতার স্থায়ী সমাধান জরুরি। তা না হলে আমাদের রক্ষা নেই। এজন্য পরিবারকে দায়িত্ব নিতে হবে, সমাজকে দায়িত্ব নিতে হবে; দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকেও।

আমাদের মনে রাখা জরুরি যে, সহনশীলতা বিশেষ একটি গুণ। একটি সামাজিক মূল্যবোধ। এই সহনশীলতার ওপর নির্ভর করে সমাজের স্থিতিশীলতা। স্থিতিশীলতা না থাকলে সহনশীলতাও আর থাকতে পারে না। মানুষ যতই এগিয়ে যাচ্ছে, ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে তার জ্ঞান। আবার ততই তার মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে অস্থিরতাও। মানুষের ভেতরে কেমন জানি চাহিদা বেড়ে গেছে। সারাক্ষণই কেবল পাওয়ার আশা। ফলে তার মধ্যে চাওয়াপাওয়ার তীব্রতা বাড়ছে। বাড়ছে মনের মধ্যে প্রচণ্ড চাপ। আর এই ক্রমবর্ধমান চাপ মানুষের জীবনকে ধৈর্যহীন করে তুলছে। ধৈর্যের অভাব একদিকে মানুষের আত্মবিশ্বাস থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তার সাহসও কমিয়ে দিচ্ছে। এজন্য প্রয়োজন সহনশীল মনোভাব। ধৈর্য ও সহ্যগুণ মানুষকে অনেক দূর অগ্রসর করে। অস্থিরতা থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে। তাই সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকেই অসহিষ্ণুতার বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে