সবুজের বিদায় ঘন্টা!

এমরান হোসাইন | বুধবার , ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৪:৫২ পূর্বাহ্ণ

হে প্রভু আমাকে দেখতে দাও। দু’চোখ ভরে দেখবো আর বুক ভরে শ্বাস নেব- তোমার দেয়া সবুজ গালিচায় মোড়ানো সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি) এলাকায়। যার সৌন্দর্য বাঁচাতে লাখ প্রাণের বাঁধভাঙা জোয়ারের ঢেউ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে থাকা চট্টগ্রামবাসীর মনে আঘাত করেছে। ইদানীং এতে নতুন মাত্রা যোগ হলো-পরীর পাহাড় বাঁচাও আন্দোলন। চট্টগ্রাম শহরের একখণ্ড সবুজ (সিআরবি) বাঁচাতে প্রকৃতির ডাকা আন্দোলনে আমরা সবাই আজ এক।
এখানে বলে রাখা ভালো- সবুজ বাঁচানোর মূলে কুঠারাঘাত করতে সবার আগে চাই প্রকৃতির দেয়া চট্টগ্রাম শহরে সবুজের স্ট্যাডি। গদবাঁধা নিয়মে (হাইপোথেসিস) বলে দেয়া হয় ৮০ শতাংশ পাহাড় কাটা শেষ। ব্যক্তিমালিকানাধীন /প্রাতিষ্ঠানিক/ সরকারি খাসজমি এ তিন শ্রেণীর পাহাড়ের মধ্যে এখন ব্যক্তিমালিকানার পাহাড়ের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রতিষ্ঠানিক ও সরকারি খাস জমি যা আছে তা উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংসের উৎসবে মেতেছে সবাই। এ সময়ে প্রয়োজন ছিল প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীর মত সাহসী উচ্চারণ- ‘চট্টগ্রাম বাঁচাও ; দেশ বাঁচবে’ আন্দোলন। রেলওয়ে মানে আমার প্রাণ। বাবা আসাম বেঙ্গল রেলওয়েতে চাকরি করতেন। রেল থেকে বড় ভাইও অবসরে গেছেন। ছোটবেলায় বড় ভাইয়ের হাত ধরে রেলওয়ে হাসপাতালে কতো গিয়েছি। সে সময় পোস্তারপাড়ের কৃতী সন্তান ডা. মোসলেহ উদ্দিন ডিএমও ছিলেন। যাকে আমরা মানু দা বলে ডাকতাম। শহরের ধনিওয়ালা পাড়ার পাশে পোস্তার পাড় ঘেঁষে রেলপথ চলে গেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। পাশে চট্টগ্রাম রেল স্টেশন। ছোট বেলায় এমন কোনদিন ছিলো না রেলপথ ক্রস করে পলোগ্রাউন্ড মাঠে খেলতে যায়নি। মনে পড়ে সে সময় চিটাগাং স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা বেশ জমতো। দেওয়ানহাট, কদমতলী, সুপারীওয়ালা পাড়া, মতিয়ারপুল, আগ্রাবাদ থেকে দল বেঁধে ফুটবলপ্রেমীদের সাথে সবুজের হাত ধরে সিআরবি এলাকা হয়ে স্টেডিয়ামে যেতে কী না ভাল লাগতো। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। সে আবেগের জায়গা সিআরবিতে কারো হাতের আঁচড় পড়ুক চাটগাঁর মানুষ মেনে নেবে না। অনেক ফুটবল টিমের মধ্যে ‘রেলওয়ে রেঞ্জাস টিম’ একসময় বেশ জনপ্রিয় ফুটবল টিম ছিল। বড় ভাই ও দলে খেলতো। সে সুবাদে ভাইয়ের সাথে প্লেয়ার বাসে করে পলোগ্রাউন্ড হয়ে উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ বেয়ে স্টেডিয়ামে যেতাম। ছোটবেলায় মনে হতো স্টেডিয়াম অনেক দূরে। সিআরবি-ছোট-ছোট পাহাড়কে মনে হতো হিমালয়। তবুও দুরন্ত কৈশোরে স্কুল ছুটির পর কালোকুঠির পাহাড়, অফিসার্স ক্লাব হয়ে ঢালু পথে সোজা সিআরবির বটমূলে। গাঢ় সবুজ গাছের তলায়-লতায়-পাতায় জড়ানো শৈশবের স্মৃতিতে কতিপয় বাণিজ্যিক চিন্তার ফসল যেন- চট্টগ্রামের মানচিত্রে শুকুনের থাবা। এ অফুরন্ত ভাললাগার জায়গা রক্ষার আন্দোলনে আজ সবাই এক-অভিন্ন পথে। দেশের নানাশ্রেণী-পেশার মানুষ প্রতিদিন যোগ দিচ্ছেন এ পরিবেশ আন্দোলনে। কবির ভাষায়, কেউ কথা রাখেনি দিনের পর দিন সবায় নিজেদের স্বার্থে চট্টগ্রাম শহরের নান্দনিক সৌন্দর্য পাহাড়টিলা ধ্বংসের মহৌৎসবে মেতে উঠেছে। টাকার খেলায় হেরেছে সবাই। জিতেছে ওরা। যাদের শেষ থাবার অপেক্ষায় সিআরবি।
অনেক তো হলো আন্দোলন। এবার প্রকৃতিকে তার মতো থাকতে দিন। যেখানে লতাপাতায়-ফুলে ফলে পাখির কলরবে ভোর হবে। ফাগুনের গানে জেগে উঠবে নতুনের জয়গান। দলছুট কিশোর-তরুণ পাহাড় চূড়া দেখে আকাশ ছোঁয়ার কবিতা লিখবে। ছেলেবেলার আলতো পায়ের ছাপ-ভোরের শিশিরে নরম ঘাসের মায়াভরা চাহনি আজও টানে। সে না ফিরে পাওয়ার কৈশোর-তারুণ্যের মুগ্ধতা ছড়ানো সিআরবি। উঁচু-নিচু পাহাড়-টিলার হাত ধরাধরিতে নেচে গেয়ে পথচলার দৃশ্যপট চোখের জলে ফিকে হয়ে আসছে।
টাইম ট্রাভালারের গতিতে নিভু নিভু বাতি ধব করে আবার যেন জ্বলে উঠে। সিআরবি তোমাকে খুঁজে পাব অন্ততকালের যাত্রায়- শেষ দেখায়। তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ সম্পর্কের উৎকর্ষতা বাড়ায়
পরবর্তী নিবন্ধস্বপ্নের সারথি বাংলাদেশের প্রতিবিম্ব