‘সবার জন্য ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও সেবা নিশ্চিতকরণ। এখন নয়তো, কখন?’

বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস : ২০২১

ডা. ফারহানা আক্তার | রবিবার , ১৪ নভেম্বর, ২০২১ at ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ

আজ বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। ১৯৯১ সালে আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (International Diabetes Federation, IDF) প্রথম এ দিবসটির পালনের উদ্যোগ নেয়, পরে জাতিসংঘ এ উদ্যোগের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৪ই নভেম্বর এ দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত বিষয়ক বিল পাশ হয়। সেই থেকে পৃথিবীর প্রায় সব ক’টি দেশে প্রতি বছর ১৪ নভেম্বরে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। মূলত এ দিনটি পৃথিবীর কোটি কোটি ডায়াবেটিস রোগীর জীবন রক্ষাকারী ঔষধ, ইনসুলিনের আবিষ্কারক ফ্রেডরিক বেন্টিং এর জন্মদিন। যিনি ১৯২৩ সালে এই আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। বর্তমানে ডায়াবেটিস পৃথিবীতে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। আান্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের ২০২১ সালের তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৫৩৭ মিলিয়ন ব্যক্তি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ এটি ৬৪৩ মিলিয়ন এ পৌঁছবে। এর মধ্যে ৯০ মিলিয়ন বাস করে দক্ষিন এশিয়ায়। প্রতি ১০ জন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। প্রতি ২ জনের মধ্যে একজনই জানেন না, যে তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। প্রতি ৫ জনে ৪ জনই নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে বাস করেন। ২০২১ সালে এ পর্যন্ত ডায়াবেটিসে প্রায় ৬.৭ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গড়ে প্রতি ৬টি সন্তান প্রসবের ১টি মায়ের ডায়াবেটিস দ্বারা আক্রান্ত, যার শতকরা ৮০ ভাগ গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। স্বাস্থ্য খাতের মোট ব্যয়ের ১০% এর বেশি এই রোগের পেছনে ব্যয় হয়। কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর শতকরা ৫০ ভাগেরই ডায়াবেটিস আছে। এছাড়া কোভিড সেরে উঠার পরও অনেকে নতুনভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে প্রতি রোগীর নিজের এবং পরিবারের সদস্যের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।
বাংলাদেশে যেমন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেশি, তেমনি ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হারও বেশি। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ ডায়াবেটিস সংখ্যাধিক্য দেশের মধ্যে দশম। কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে ২০৩০ সালে বাংলাদেশ নবম অবস্থানে উঠে আসবে। পৃথিবীতে বর্তমানে সবচেয়ে উচ্চহারে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে, যেমন বাংলাদেশ, ভারত। বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল দেশে খুব দ্রুত নগরায়ণ, সুষম খাদ্যের গ্রহণের তারতম্যের কারণে মানুষের দৈহিক ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে আনুপাতিক ও কাঙ্ক্ষিত হারের চেয়ে বেশি। কায়িক পরিশ্রম দিনে দিনে কমে যাচ্ছে, বিভিন্ন কারণে মানসিক চাপ বেড়েছে অনেকগুণ। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৮৪ লক্ষ, যা মোট জনসংখ্যার ৮.১% (সূত্র- International Diabetics Federation-03.03.2020) বাংলাদেশের ০ থেকে ১৯ বছরের টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ৫৩৫০ জন।
সমপ্রতি ১২৫৩ জন ডায়াবেটিস রোগীর উপর এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, আমাদের দেশের ডায়াবেটিস রোগীদের প্রায় শতকরা ৮২ ভাগেরই অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস। তার মধ্যে শতকরা ৫৫ ভাগেরই অত্যন্ত বেশি মাত্রায় অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস। এবং প্রতিজন ডায়াবেটিস রোগীর পেছনে বাৎসরিক ব্যয় ৮৬৫ মার্কিন ডলার। তার মধ্যে ঔষধ বাবদ ব্যয় ৬০ ভাগ, এবং হাসপাতালে ভর্তিজনিত ব্যায় ২৮ ভাগ। দীর্ঘ মেয়াদি ডায়াবেটিস, ইনসুলিন এর ব্যবহার ও ডায়াবেটিস রোগের জটিলতা জনিত কারনই এই ব্যায়ের পেছনে দায়ী। এই গবেষণাটি করা হয়েছে দেশের রাজধানী ও উত্তরাঞ্চলের ডায়াবেটিস রোগীদের উপর। অন্য দিকে আমাদের দক্ষিণাঞ্চলে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের যৌথ উদ্যোগে একটি গবেষণা করা হয়েছে, তাতেও একই চিত্র উঠে এসেছে, চট্টগ্রামের প্রায় ৭২ ভাগ ডায়াবেটিস রোগীরই ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত, এবং তাদের মধ্যে মহিলাদের, বিশেষ করে গৃহিনীদের সংখ্যাই বেশি।
যদিও এ বিষয়ে তেমন কোন ডাটা নেই, তবে ধারণা করা হচ্ছে, চট্টগ্রামে প্রতিদিন নতুন করে সনাক্ত হচ্ছে ১০০-১৫০ জন, যাদের মধ্যে মধ্য বয়সী রোগীর সংখ্যা বেশি। এবং প্রতি ৭ জন গর্ভবতীর মধ্যে ১ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। ৫৪১ মিলিয়ন রোগীর ডায়াবেটিস হবার পূর্ববর্তী ধাপে আছে, যাকে আমরা প্র ডায়াবেটিস বলি। এই রোগীগুলোর পরবর্তীতে ডায়াবেটিস হবার উচ্চ ঝঁকিতে থাকে।
শিশুদের যে ডায়াবেটিস হয়, তা সাধারণত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই Type-1, যেখানে শিশুর অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন উৎপাদনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে শিশুদের মধ্যে Type-2, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার প্রবণতা ও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা সাধারণত প্রাপ্ত বয়স্কদের বেশি হয়। শিশুদের Type-2 ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ স্থুলতা। এছাড়া ডায়াবেটিসের পারিবারিক ইতিহাস থাকা ও অলস জীবন যাপন ও এর জন্য দায়ী। আজকাল অনেক বাচ্চাই স্মার্ট ফোনের বিভিন্ন গেমস এ আসক্ত। দিনের বেশিরভাগ সময় টেলিভিশন ও কম্পিউটারের সামনে কাটিয়ে দেয়। কোভিড ১৯ প্যানডেমিকে বাসায় বসে অনলাইন ক্লাস করায় এদের অনেকেরই ওজন বেড়ে যাচ্ছে। বাহিরের খোলা মাঠে খেলাধুলা করার প্রবণতা কমে গিয়েছে। এছাড়া যত্রতত্র এপার্টমেন্ট, শপিংমল গড়ে উঠাতে আগের মতো খেলার মাঠ ও নেই। ফার্স্ট ফুডের অতি সহজ লভ্যতায় বাচ্চারা এসব খাবারে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এসব নানাবিধ কারণে বাচ্চাদের স্থুলতা বেড়ে যাচ্ছে। স্থুলতা ইনসুলিন কে সঠিক ভাবে কাজ প্রদানে বাধা দেয়। যার ফলে পরবর্তীতে এই বাচ্চাগুলো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। প্রকারভেদে ডায়াবেটিসের কারণ বিভিন্ন রকম।
Type-1 ডায়াবেটিসে শরীরে নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজের অগ্ন্যাশয়ের বিটা সেলের বিরুদ্ধে কাজ করে তা পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়- ফলে ইনসুলিনের অভাবে ডায়াবেটিস দেখা দেয়। কিন্তু Type-2 ডায়াবেটিসের কারণ নানাবিধ। অতিরিক্ত স্থুলতা, অলস জীবনযাপন, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, ডায়াবেটিসের পারিবারিক ইতিহাস, জিনগত সমস্যা এসব গুলোর কোন না কোন প্রভাবে এ ধরনের ডায়াবেটিস হয়। এছাড়া গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা থেকে কিছু হরমোন আসে, যা ইনসুলিনের কাজ কে বাধা প্রদান করে, ফলে মহিলাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হয়।
প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে, ফার্স্ট ফুড ও অতিরিক্ত ক্যালরি যুক্ত খাবার বর্জন করতে হবে, ধূমপান পরিহার করতে হবে, রক্তের গ্লুকোজ, চর্বির মাত্রা ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও স্বাভাবিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। গর্ভবস্থায় প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিতের পাশাপাশি ওজন বৃদ্ধি গ্রহণ যোগ্য মাত্রায় রাখতে হবে।
এ বছরের প্রতিপাদ্য- “সবার জন্য ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও সেবা নিশ্চিতকরণ। এখন নয়তো, কখন?”
এ প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে সকল ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসা ও সেবা পাবার অধিকারের কথা বলা হয়েছে, এবং এ অধিকার নিশ্চিতকরণে সময়ক্ষেপণ কাম্য নয়।
আমরা এ বছর ইনসুলিন আবিস্কারের শতবর্ষ পালন করছি, ১৯২১ সালে স্যার ফ্রেডরিক বেন্টিং ইনসুলিন আবিস্কার করেন, এই আবিষ্কারের জন্য পরবর্তীতে ২০২৩ সালে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। কোটি কোটি ডায়াবেটিস রোগীর জীবন রক্ষাকারী ঔষধ ইনসুলিন আবিস্কার, চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর যুগান্তকারী ইতিহাস হয়ে থাকবে। অথচ এ আবিস্কারের ১০০ বছর পরেও এখনও অনেক ডায়াবেটিস রোগী ইনসুলিন প্রাপ্তির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ইনসুলিন Type-1 ডায়াবেটিস রোগীর জন্য জীবন রক্ষাকারী। সে অর্থে ইনসুলিন প্রাপ্তি তার অধিকার। অথচ বিশ্বে প্রতি হাজারে ১০ জন টাইপ ওয়ান এবং প্রায় ৩০ মিলিয়নের ও বেশি Type-2 ডায়াবেটিস রোগী ইনসুলিন প্রাপ্তি বা এর সহজলভ্যতা থেকে বঞ্চিত। নিম্ন আয়ের ৬৩ ভাগ এমনকি উচ্চ আয়ের ২.৮ ভাগ রোগীও ইনসুলিন প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত। এমনকি এদের অনেকেই ডায়াবেটিসের মুখে খাবার মেটফরমিন জাতীয় ঔষধও কিনতে অপারগ।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ১৬ বেডের ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগ চট্টগ্রামের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত জনসংখ্যার তুলনায় কতটা অপ্রতুল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
পৃথিবীর মিলিওনেরও বেশি মানুষ এখনো ডায়াবেটিস সেবার আওতার বাইরে রয়ে গিয়েছে, অথচ এ রোগের চিকিৎসা ও জটিলতা সমূহের নিরসনে দীর্ঘ মেয়াদি সেবা প্রাপ্তির প্রয়োজন। তাই ডায়াবেটিসের ঔষধ, এডুকেশন, অন্যান্য কারিগরি সুবিধা সহজলভ্য করতে হবে, ডায়াবেটিস চিকিৎসা ও এর প্রতিরোধে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ইনসুলিন, ডায়াবেটিস এর মুখে খাবার ঔষধ, ডায়াবেটিস শিক্ষা, মানসিক সাপোর্ট, হাঁটা বা ব্যায়াম করার জায়গা এবং সুষম খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দেশে অত্যন্ত সুচারুরূপে এই সেবাগুলো দেয়া হয় বারডেমে এবং বংগ বন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু এ দুটি প্রতিষ্ঠান একই জায়গায় অবস্থিত, বলা যায়, একটি রাস্তার এপাশ আর ওপাশ, আর অন্যদিকে পুরো বাংলাদেশ। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে যেমন সব ডায়াবেটিস রোগীকে সেবা প্রদান সম্ভব নয়, তেমনি দেশের বেশিরভাগ ডায়াবেটিস রোগীর এই দুটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সেবা গ্রহণও সম্ভব নয়। তাই ডায়াবেটিস সেবাকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হলে, দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর ডায়াবেটিস বিভাগগুলোর মান উন্নয়ন জরুরি। একই সাথে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙেও এ সেবার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি হাসপাতালের ডায়াবেটিস বিভাগগুলোতে, প্রয়োজনীয় লোকবল, নতুন পদ সৃষ্টি ও ঔষধ সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। ডায়াবেটিস সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হলে, সব সরকারি হাসপাতালের ডায়াবেটিস রোগ বিভাগগুলোকে এক একটি বারডেম বানাতে হবে। যদি এখন না করা হয়, তবে কখন? এ চাহিদা পূরণে দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করতে হবে। তবেই সরকারের পক্ষে তৃণমূল পর্যায়ে এ সেবা পৌছে দেয়া সম্ভব।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান স্মরণে
পরবর্তী নিবন্ধ১৯ মাসে সর্বনিম্ন শনাক্ত