অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান স্মরণে

কাজী সাইফুল হক | রবিবার , ১৪ নভেম্বর, ২০২১ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ


মর্সিয়া শোকের অন্যনাম। শোক শব্দটি বেদনার-কান্নার। সব শোক শক্তির নয়- কোনো কোনো শব্দশোকে শক্তি থাকে। কোনো শোক উজ্জ্বলতর, কোনো শোক শোভনময় আবার কোনো শোক চিরায়ু। সেমতে স্যার অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খানের চলে যাবার শোক আমাদের কাছে উজ্জ্বল, শোভন ও চিরায়ু-ত্রয় অভিধাসম। তাঁর প্রস্থিত হওয়া আমাদের কাছে শোককান্না বয়ে আনে না; বরং প্রেরণার প্রোজ্জ্বল আলো হয়ে থাকেন নিত্য নব। তিনি আমাদের জীবনে তথা সমাজে, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও লিখনীতে সত্য হয়ে এসেছিলেন। সত্যের বিলয় নেই এবং এর জন্য শোকের দাবি অনর্থক-অসার্থক। কোনো জন যখন মানুষের পক্ষে সত্য হয়ে ওঠেন তখন তাঁর ইন্তেকালে শোক শব্দমাত্র হয়ে থাকে না, তখন সেইটে হয়ে ওঠে হাহাকার-হাহাশ্বাস। সেই হাহাকার গগনদীর্ন এবং দীর্ঘায়ু হাহাশ্বাস। তিনি যে আমাদের স্যাটায়ার সাহিত্যে নব ঝলক দিয়ে গেছেন, এখন তা আরো বেশি ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে- এমতই ধারণা আমার। তাঁর সুলিখন পাঠ অধ্যয়নে হাহাকার মিয়ে যায় আলোকদীপ্তে। তখন তিনি আরো প্রদীপ্ত উচ্চারণ হয়ে ওঠেন আমাদের মধ্যে। শোকের আবহ থাকে না। শোক- অভিধান নিবাসী হয়ে পড়ে। তাঁর সঙ্গে কারো মেলানোর স্পেস দেখা যায় না খালি চোখে-খোলা চোখে। তাঁর মতো মনস্বী প্রতিভাধর জ্যোতিষ্মানকে ফ্রেমে-ছাঁচে আটকে রাখা যায় না। তাঁরা কালের মানুষ, কাজের মানুষ। খান স্যার সেইজন।
স্যার অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান যে চোখ দিয়ে জগৎ অবলোকন করেছেন সেইটে দৃষ্টিগ্রাহ্য-অন্তরভেদী লিখনশৈলে প্রকাশও করেছেন। লিখনশৈলী কেন; তাঁর রচনায় রয়েছে শেল এবং শৈলও। তিনি সামাজিক ঠগবাজি, শঠামী, বুজরুকি ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে সফল কলম চালিয়েছেন। তিনি প্রতারিত-প্রবঞ্চিত মানুষের পক্ষে বলেছেন প্রস্থিত হওয়ার পূর্বাবধি। অর্ধসত্য বয়ান-বর্ণন তাঁর লেখায় পাওয়া যায় না। অর্ধসত্যকে তিনি মিথ্যার চেয়েও জঘণ্য মনে করতেন। মিথ্যাকে মিথ্যা বলার অসম-নিঃসঙ্ক প্রকাশ রয়েছে তাঁর লেখাজোকায়। তাঁর লিখনীতে ব্যাপকহারে দেশি-বিদেশি উপাখ্যান, শ্লেষগল্প, প্রবাদ-প্রবচন, চিরায়ত বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের উদ্ধৃতি এবং সমকালিন ঘটনা ও খবরের বিশ্লেষণ-টিপ্পনীর ব্যাপক সম্ভার রয়েছে। আজাদীর জন্য লেখা ‘বিরস রচনা’ তো মহাকালের দলিল হয়ে থাকবে। শিল্প হিসেবে তাঁর গদ্যগুলো অনন্য সুলিখিত। গদ্যের সুলিখন স্টাইল তাঁর একার এবং নিজস্ব। কারো সঙ্গে খান স্যারের গদ্যের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মিল নেই বললেই চলে। এখানেই তাঁর স্বতন্ত্র ও স্বাতন্ত্র্যিকতা।
সময় সচেতক খান স্যারের কালের দুর্যোগ উপলব্ধি করতে সময় লাগেনি। আড়াই দশক আগেই তিনি এই সময়কে ‘দুশ্চরিত্র সময়’ হিসেবে চিহ্নিত করে গেছেন। ‘বিরস রচনা’ গ্রন্থের সাতকাহনে ভবিষ্যদ্বাণীর মতো উচ্চারণ করেছিলেন:
“দুশ্চরিত্র সময়ে ইতিহাস ভাঙা ঢোলে, দর্শন ভেংচানিতে, নীতিকথা ভাঁড়ামিতে পরিণত হইয়া গিয়াছে যেন। আমাদের খাদ্যে- বাদ্যে-আসনে- ভূষণে- সম্ভাষণে- ব্যঞ্জনে- রন্ধনে- নয়নে- রঞ্জনে নতুনত্ব আসিয়াছে। … কিন্তু মেধা ও মননে, কর্মে ও আচরণে ধরিয়াছে পচন। উদার অর্থনীতির নামে উদর অর্থনীতি, মুক্তির পরিবর্তে কু-যুক্তি, সংস্কৃতির পরিবর্তে বাঁদরামিপূর্ণ ইতরামি যোগ হইয়াছে। দয়া, মায়া, প্রেম, স্নেহ, ভালোবাসা, শ্রেয়বোধ, শ্রদ্ধাবোধ, সততা, মানবতা, পরার্থপরতা, আত্মত্যাগ ইত্যাদি শব্দাবলি আজ জীবন হইতে উবিয়া গিয়া অভিধানে মমি হইয়া রহিয়াছে। লাভ ও লোভ, শঠতা ও প্রতারণা, ঘুষ-দুর্নীতি, প্রবঞ্চনা-হঠকারিতা আমাদের নিত্যকর্ম হইয়া উঠিয়াছে। এই মজ্জাগত প্রবণতাকে রুখিয়া দাঁড়াইবার শক্তি এই অধমের নাই। সত্য ও সুন্দর পশুবিষ্ঠার সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে। ভুতুড়ে সমাজের জন্য রহিয়াছে হাতুড়ে বুদ্ধিজীবী।”
তাঁর এ মন্তব্য আজও বেশ প্রাসঙ্গিক এবং দুঃসাহসিক! সমাজচেতন স্যার অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান সর্বত্রই সামাজিককে ধারণ করেছেন। তিনি তাঁর অপার চোখ দুটিতে প্রয়াণের পূর্বপর্যন্ত এই সামাজিক শূন্যতায় বিচলিত ছিলেন। চলমান সামাজিক দুর্দিনের কথা তাঁর খালিচোখ এড়িয়ে যায়নি। ‘দুশ্চরিত্র সময়’-এর দৃষ্কর্মগুলো ধরা দিয়েছে, দোলা দিয়েছে। তাঁর চিন্তা, দর্শন ও লিখনী আজকের এমতই মানসিক পচন ও সামাজিক অবক্ষয় উত্তরণে সাফল্য দেখাতে পারে বলে প্রবীন-প্রাজ্ঞরা স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁর ‘বিরস রচনা’র সরস আলোচনাকে কেন্দ্র করে পঁচিশ বছর পরে এসে আমাদের বিবেচনা আজ উপস্থিত করা যেতে পারে।
খান স্যার রস-সরসে প্রদীপ্ত ব্যক্তিত্ব। তাঁর গদ্যজুড়ে বুদ্ধি প্রদীপ্তির ঘনঘটা সমুপস্থিত। মানুষের শ্লেষ আকর্ষণ মজ্জাগত। বাঙালি শ্লেষপ্রিয় জাতি। হাসে-হাসায়। হাসি কোনো হালকা বিষয় নয়। মানুষের আবেগের সফলতম বহিঃপ্রকাশ এটি। হাসিটে সৌন্দর্য, আধুনিকতা ও স্মানর্টনেসের সঙ্গে যুক্ত। এই যুক্ততা মন-মননের যুক্ততা। রবীন্দ্রনাথ হয়তো তাই বলেছেন-
‘এত বুড়ো কোনোকালে হব নাকো আমি
হাসি-তামাশারে যবে কব ছ্যাব্‌লামি।’
কলম হাতে সবার পক্ষে সেই হাসি হাসানো সম্ভব নয়। মানবিক শক্তির পূর্ণ উদঘাটন ও এর সার্থক নিয়ন্ত্রণ না হলে মানুষের মুখে হাসি ফোটানো দুরূহ। খান স্যার সেই হাসিরই চাষ করেছেন দীলে ও কলমে। মানবিক মন্বন্তর ও মানবতার বিপর্যয়কে তিনি নিজের অর্থে ও অন্তরাখ্যানে প্রকাশ করেছেন। এই প্রকাশ সার্থক ও সফল। রম্যসাহিত্যে তাঁর হাস্যরস শুধুই মুখের হাসি নয়, মনের ও মননের হাসিতে স্বরূপ পেয়েছে। সামাজিক জড়তার প্রতি প্রাণের আক্ষেপ-আকুতির আশ্রয়স্থল বিবেচিত হয় তাঁর রম্য-গদ্যগুলো। তাঁর প্রতিটি গদ্যে রস ও বাস্তবের একটি আদর্শ সমন্বয় সাধিত হয়েছে।
আজ তাঁর প্রস্থানের আট বছর। তাঁর কলম-কলাম-সম্ভাষণ অক্ষরে অক্ষরে মনে পড়ে এবং মন পোড়ে। ‘বিরস রচনা’ দেখি না। তবুও মন পড়ে থাকে পুরনো কাগজের বিরস-কলামে। এমতই শক্তি তাঁর কলামের- গোরে শুয়ে থেকে আমার মতো অনেককে হাসান তিনি। যে হাসি কালের হাওয়ার সঙ্গে যুক্ত-প্রযুক্ত। আশ্চর্য, হাসি যে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের একটি মাধ্যম- সেই প্রবাদবাক্য মিলে যায় খান স্যারে। স্যারের প্রস্থানে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে সেই শূন্যতা সওয়া যায় না; সইতে পারে না মানুষ, প্রকৃতি, শিল্প-সাহিত্যও। তাঁর চলে যাওয়া আপাতদৃষ্টে শূন্য মনে হলেও প্রকৃতে আমরাই হয়ে গেছি শূন্য। এই শূন্যতা পূরণ কবে হবে কিংবা শূন্যস্থান পূর্ণতা পাবে কিনা এসব ভাবতে ভাবতে হয়তো আমরাই একদিন প্রস্থিত হয়ে যাবো। কেননা তাঁর মতো জ্ঞানতাপসের শূন্যতা বহন করার শক্তি-সাহস-হিম্মত না আছে মানুষের, না আছে প্রকৃতির। করুণানিধান তাঁর সাথে উত্তম আচরণ করুন, আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধ‘সবার জন্য ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও সেবা নিশ্চিতকরণ। এখন নয়তো, কখন?’