সত্য-সুন্দরে উদ্ভাসিত হোক মানুষের অন্তর্জগত

স্বপন কুমার বড়ুয়া | শুক্রবার , ২১ মে, ২০২১ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

এক সময় পৃথিবী ছিলো মানুষের সুখ সৌরভের আনন্দ আশ্রম। মানুষের চিত্তলোকে সতত বিরাজমান ছিলো শান্তির ললিত বাণী। নগরে, জনপদে মমতার বন্ধনে চারিদিকে উচ্চারিত হতো সৃষ্টি সুখের উল্লাস। সেবা, কল্যাণ আর ভালোবাসার অম্লান ঐশ্বর্যে বিনির্মিত হয়েছিলো মানব সমাজ। সেই সুবচন শুভতা আর সুচরিত জীবন মানস এখন নির্বাসিত। প্রমত্তচারিতা,সংক্ষুব্ধ আর হিংস্র অনুভবে এখন নিমজ্জমান আমাদের সবুজ পৃথিবী। সন্ত্রাসী জীবন পরিমণ্ডলে সমর্পিত আমাদের হরিৎ শস্যের গান। এখন শিউলী ফোটা বকুলের মতো ঝরে জীবন প্রদীপ আর শাওনের বৃষ্টিধারার মতো ঝরে মানুষের লাশ। এমনিভাবে যুগের পর যুগ অতিক্রান্ত হচ্ছে মানুষের দীর্ঘশ্বাসের ভিতর দিয়ে। প্রতিনিয়ত অশান্তির প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা বিচ্ছুরিত হচ্ছে ধ্বংসাত্মক পদচারণায়। চারিদিকে যুদ্ধের রণহুংকার বেজে চলছে এই অশান্ত পৃথিবীতে। অকারণে প্রাণীহত্যা, খুন, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, লুণ্ঠনসহ অশুভ কর্মকাণ্ডের করালগ্রাসে বন্দী মানব বসতি।
পালাবার সব পথ রুদ্ধ। কারণ এখন এক নষ্ট সময় অতিক্রান্ত করছি আমরা। এ নষ্ট সময়ের জন্য দায়ী আমরা মানুষেরাই। মনুষ্য বিবর্জিত হয়ে আমরা ক্রমশ দানবে রূপান্তরিত হচ্ছি দিনের পর দিন। নিজ স্বার্থসিদ্ধ উশুলের জন্যে আমরা অপকর্মের পশরা সাজিয়ে বসেছি। আমরা মুখে মানবিকতার কথা বলি, কিন্তু টুঁটি চেপে ধরি মানবাধিকারের। আমরা সভ্যতার কথা বলি, ভয়ানক অসভ্য হয়ে। আমরা মুক্তির কথা বলি, কিন্তু শৃঙ্খলিত করি অপরকে। আমরা গড়ে তুলি বড় বড় আকাশছোঁয়া টাওয়ার, আবার নিমেষেই আণবিক বোমায় বিলীন করি হিরোশিমা নাগাসিকা’র মতো নগর সভ্যতা। অতএব, সব নষ্টের মূল মানুষেরাই। এই আমরাই বছরে বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করছি শুধু মানুষ মারার জন্যে। একে অপরকে ধ্বংস করার জন্য মারণাস্ত্র বানিয়েছে লক্ষ, কোটি। মানুষ হয়ে মানুষকে ঘায়েল করার জন্য তৈরি করেছি নানান গোপন অস্ত্র। আমরা ধর্মের নামে, দেশের নামে, ভাষার নামে, সাদা আর কালোর নামে মানুষ মানুষকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। চামড়ার রং দিয়ে, গণতন্ত্রের নাম দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে দিয়েছি এই সবুজ পৃথিবীকে। অকারণে নির্বিচারে প্রতিনিয়ত হত্যা করছি অবুঝ, অসহায় নিরীহ পশু-পাখিদের। ঘাতকের বুলেটে প্রতিদিন ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে কত তাজা প্রাণ। নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে আমরা মরিয়া হয়ে উঠেছি। রক্তের হোলি খেলায় আমরা মাতোয়ারা। চারদিকে কি এক অস্থির প্রতিযোগিতা! আদিম উন্মাদনায় আমরা প্রকৃতি আর তার সৃষ্টি’র ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছি অবিরত। তাই মানবতা আজ কেঁদে ফিরে বধ্যভূমিতে। অনাচার-অত্যাচার সইতে সইতে প্রকৃতি বেজায় রুষ্ট হয়ে আছে মানুষের উপর। হয়তো প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিচ্ছে এখন। এক অদৃশ্য শক্তি ‘করোনা’ মহামারি দিয়ে মানব বসতিকে নাস্তানাবুদ করে ফেলেছে প্রকৃতি। এক অদৃশ্য শক্তির কাছে হার মেনে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। স্বজনদের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠছে প্রতিমুহূর্ত। আজ পৃথিবীর মানুষগুলো বড় অসহায়। বড়-ই করুণ-কাতর হয়ে প্রকৃতির দিকে চেয়ে আছে। মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্যে কত শত প্রচেষ্টা। পৃথিবীর তাবৎ অসহায় মানুষগুলো অশ্রুসজল চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে প্রকৃতির দিকে। ‘প্রকৃতি’ কবে মুখ তুলে তাকাবে? কবে শান্তি হবে প্রকৃতি? বিশ্বের বাঘা বাঘা শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির আস্ফালন, রণহুংকার, অস্ত্রের ঝনঝনানি, বিত্ত-ভৈববের অহমিকা ‘করোনা’র কাছে আজ পরাস্ত। প্রকৃতি ইচ্ছে করলে এক নিমিষেই সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে গুঁড়িয়ে দিতে পারে।
এখন সময় এসেছে উপলব্ধি’র। আসুন প্রকৃতিপ্রেমী হই, প্রকৃতিকে ভালোবাসি, প্রকৃতির সন্তানদের ভালোবাসি, প্রকৃতির সৃষ্টিকে ভালোবাসি। তৃষাকাতর সমস্ত ধরণী আজ তোমার প্রতি অবনত ‘হেয় প্রকৃতি’।
‘করোনা’র করালগ্রাসে তো তোমার অনেক সন্তানকে কেড়ে নিয়েছো। তোমার সন্তানেরা বাঁচার আশায়, একটু সুস্থ স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার আশায় কাতর হয়ে আর্তনাদ করছে আজ। এবার ক্ষান্ত হও, এবার করুণা করো, এবার একটু স্বস্তি দাও, শান্তি দাও। ক্ষমা করো তোমার অসহায় সন্তানদের। এই দুঃসময়ে, এই ক্রান্তিকালে করজোড়ে প্রার্থনা- মনের যত অশুভতা, হত্যা, হিংসা, বিদ্বেষ, গ্লানি, হানাহানি, লোভ-লালসা, পাপ-পঙ্কিলতা, অসুন্দরের পদধ্বনি তিরোহিত হোক মানুষের মনের অনিন্দ্য নিলয় থেকে। সত্য-সুন্দরের অবগাহনে উদ্ভাসিত হোক পৃথিবীর মানুষের চিত্তভূম। করোনা মহামারি মুক্ত হয়ে পৃথিবীর সবুজ মানচিত্র আবার সুখ সৌরভে মুখরিত হউক। মানুষের অন্তর্জগত বিকশিত হোক সত্য সুন্দর আর মানবতার জয়গানে।
লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিরহ
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা