সক্রিয় হোক আমাদের ক্রীড়াঙ্গন

সুবীর পালিত | বৃহস্পতিবার , ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ

মেঘে মেঘে বেলা অনেক হয়েছে, কাশখালী, হালদা ও কর্ণফুলীতে অনেক জল গড়িয়েছে। জন্ম, শৈশব, যৌবন, অল্পস্বল্প লেখাপড়া ও কর্মজীবন সবই আবর্তিত হয়েছে সুলতানপুর গ্রামে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে খেলাধুলার প্রতি ঝোঁক ছিল বেশি। বাড়ির সামনের উঠানে অথবা পাড়ার ক্লাবের সামনে ও পেছনে ধানী জমির ন্যাড়া পরিষ্কার করে চাঁদনী রাতে হাডুডু, মোরগের লড়াই, ডাংগুলি, ফুটবল, ভলিবল, টেনিস বা গাছের বল, ব্যাট ও স্ট্যাম্প বানিয়ে ক্রিকেট খেলেছি। বাজার থেকে সবাই চাঁদা তুলে ফুটবল কিনে হাটে মাঠে ঘাটে খেলেছি। মা – বাবার চোখ রাঙানি ও শিক্ষকের বেতের প্রহার উপেক্ষা করে খেলেছি। পরে রাউজান হাইস্কুলের পশ্চিমে বিশাল মাঠে প্রায় নিয়তই খেলেছি বা উপভোগ করেছি। হাইস্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক আমার কাকা প্রয়াত মৃণাল পালিত ও নুরুল ইসলাম স্যার বাঁশি নিয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন। তখন জুনের খেলা প্রতিবছরই হতো। আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় বেশ কয়েকবার ফুটবলের চুড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়ে কলেজিয়েট স্কুল মাঠে বাসে এসে সমর্থক হিসেবে জয়ী হয়ে হল্লা চেঁচিয়ে বাড়ি ফিরেছি।
যতদূর মনে পড়ে, আমাদের স্কুলের হয়ে আমার কাকা সুধীর চন্দ্র পালিত, কান্তি বাবু, জনাব গোলাম মোহাম্মদ, আমিন জুট মিলের শফি, জাফর, বক্কর, মদন, নুরুল ইসলাম, জামাল, মামুন, ঝুন্টু মহাজন, শিবু মহাজন, নাইম ভাই প্রমুখ খ্যাতিমান ছিলেন। স্থানীয় ডাকবাংলো মাঠে নিয়মিত ভলিবল খেলা হতো। ফুটবল যারা খেলতেন, তাদের বাইরেও বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব শরীফ, সোলেমান কাকাদের সাথে খেলেছি। কাঙ্গাল চন্দ্র দাশগুপ্ত ছোট ছোট ছেলেদের নিয়ে কলেজের মাঠে কসরতের পাশাপাশি খেলায় মগ্ন হওয়ার পরামর্শ দিতেন। অধ্যক্ষ নেপাল চন্দ্র দস্তিদার শক্ত হাতে কলেজ পরিচালনা করতেন। তবে সবসময় সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে উৎসাহ দিতেন। অধ্যাপক ইসলাম স্যার মুখে পান দিয়ে বীরেন স্যারসহ প্রেরণা দিতেন। বর্ণিত ব্যক্তিবর্গের অনেকেই পটল তুলেছেন। সেই স্বর্ণালী দিনগুলো কী করে ভুলি!
এখানে উল্লেখ করতে চাই যে অনেক খেলোয়াড়, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী ও পৃষ্ঠপোষকদের নাম আসে নি, ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। অথচ আজকাল দেশে কখন কী ঘটে ক্রীড়াঙ্গনে, তা অবহিত নই, আগ্রহ নেই মোটেও। এই চাঁটগা শহরে ক্রীড়াঙ্গন স্থবির। আউটার স্টেডিয়ামের অনেকটা জায়গা জুড়ে বিভিন্ন যানবাহনের সরাইখানা, দিনের পর দিন গাড়িগুলো বসিয়ে রাখা, উচ্চবিত্ত পরিবারের ড্রাইভিং শেখানো, সব ঋতুতে জল জমে থাকা, প্রশিক্ষণের জন্য দু’টি নেট আছে বটে, কিন্তু তরুণদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। ফুটপাতে অনেকগুলো জায়গায় দোকান, ওপারে বিভিন্ন ক্রীড়াসামগ্রীর বিকিকিনি, আর এম এ আজিজ স্টেডিয়াম নীরব, নিথর। সাগরিকায় জহুর আহমদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে কালেভদ্রে কয়েকটি খেলা হয়, তাতে যাওয়া-আসা, স্টেডিয়ামের ন্যূনতম সুবিধাদি…. ‘নাই’ এর সমাহারে পূর্ণ।
মনে পড়ে এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে পার করে আসা স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা। এই মাঠেই দেশি বিদেশি খেলোয়াড়দের নৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরতাম। আশীষ ভদ্র, আবদুল গাফফার, অমলেশ সেন, আশরাফউদ্দিন চুন্নু, সালাম মুর্শেদী, কাজী সালাউদ্দিন তূর্য, গোলাম রব্বানী হেলাল, জসিমউদ্দিন যোশী, শেখ মোহাম্মদ আসলাম, সত্যজিত দাশ রূপু, আনোয়ার, বাদল রায়, পাকির আলী, প্রেমলাল, এমেকা, চিমা ওকোরি, কৃশানু দে, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য প্রমুখদের পায়ের যাদু, খেলায় ধাক্কাধাক্কি, ফাউল, হলুদ বা লাল কার্ড, মাঝপথে খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়া, খেলোয়াড়দের দিকে ঢিল ছুড়ে মারা, বিশেষ করে আবাহনী – মোহামেডানের খেলা থাকলে সেদিন প্রচণ্ড টেনশন থাকতো। এসব আজ স্মৃতিময় অতীত। এখন ফেডারেশন, কমিটির আধিক্যই হয়েছে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের ফুটবলের অবস্থান একেবারেই তলানিতে। হর্তা কর্তারা হুংকার দেন, কোচ, হেডকোচ, ফিজিও, পরামর্শক, চিকিৎসক – হা-হুতাশেই সীমাবদ্ধ। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ফুটবল এখন অন্তিম শয্যায়। অথচ এই চট্টগ্রামেই প্রফেসর শায়েস্তা খানসহ আরো অনেক ফুটবল বোদ্ধা নানা পরামর্শ দিয়েছেন। ‘সব খেলার সেরা বাঙালির ফুটবল’ বিখ্যাত এই গানটি অন্তত এই বাংলায় আর হবে না তা সুনিশ্চিত। বাফুফে নামের যে প্রতিষ্ঠানটি আছে, তাতে বিকাশের কোনো লক্ষণ দেখি না। অন্য সংস্থার মাঠ পর্যন্ত বেদখল করার ধৃষ্টতা দেখায়, পরে মন্ত্রী পর্যায়ে গেলে তার সমাধান হয়। এই শহরে রাষ্ট্রের শীর্ষ জনের পেছনে সিগারেট ফুঁকে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখেছি।
এবার একটু করে ক্রিকেটের কথা বলি। বিসিবি নামক যে প্রতিষ্ঠানটি আছে, তা অকালকুষ্মাণ্ডদের বাক্যবাণে জর্জরিত। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি গর্ডন গ্রিনিজের নিবিড় অনুশীলনে সাবের হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে ঠিকই টাইগার হয়েছিল। ঐ যে একটু আগে বলেছি ‘দিন শেষে অরণ্যেরোদন’ এখানেও ঠিক তাই। দেশের সবচেয়ে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল এই বোর্ডটি না চাইতেই ক্রিকেটারদের গাড়ি, বাড়ি দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহীর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি ক্রীড়ামোদী। ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি সময় দেন, স্টেডিয়ামে যান। আইসিসির নির্দেশানুযায়ী টেস্ট ক্রিকেটই সবচেয়ে মূল্যবান এবং এটার সাফল্যের ওপর রেটিং নির্ধারিত হয়। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপ নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই কর্তা ও খেলোয়াড়দের। ধীরতা, স্থিরতা, মনোসংযোগ নেই। উইকেটে সেট হওয়ার আগেই ধুমধাম কয়েকটি শট খেলে কিভাবে বাতানুকূল কক্ষে আসবে তার প্রতিযোগিতা চলে। আগে ওয়ানডে ম্যাচ দিয়ে যেভাবে চ্যাম্পিয়নশীপ নির্ধারিত হতো, এখন আর সে সুযোগ নেই।
বাফুফের মতো বিসিবির হর্তা কর্তাদের মুখে কথার বাহাস দেখে অবাক হয়ে যাই। সবকিছুর সুবিধা থাকা সত্বেও আশাতীত ফল না পাওয়ায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ। দর্শক বিনোদন এবং টাকা কামানোর আশায় টেস্ট খেলুড়ে দেশসহ নানা দেশে টি-টোয়েন্টি প্রবলভাবে চলছে। স্পন্সররা অবধারিতভাবেই আসছে। সিঙ্গাপুর ও মরুর দেশ আমিরাতে পর্যন্ত আলোর বাহারি ঝলকানিতে মুখর, সেখানেও আমাদের অর্জন বিশাল একটা অশ্বডিম্ব।
আমি মনে করি দলে কেউ আজীবন নয়। খেলোয়াড় বা কর্তা যেই হোক না কেন। অযথা তাদের দলে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। বিসিবির স্বেচ্ছাচারিতা ও অদক্ষ লোকদের এই মুহূর্তে সরিয়ে দেওয়া উচিত। দিন কয়েক আগে আমাদের ক্রিকেটারেরা অপরাধীর মতো বিমানবন্দর ত্যাগ করেছে গণমাধ্যমকে এড়িয়ে। আমি মনে প্রাণে চাই পুরোনোদের বাদ দিয়ে জেমি সিডন্স মূল দল আর স্টুয়ার্ট ল-এইচপি দল দেখভাল করবেন এই দুই অস্ট্রেলিয়ান পেশাদার কোচ। সারা বিশ্বে অস্ট্রেলিয়ার কোচদের নাম ডাক বেশি। মোসাদ্দেক, লিটন, আফিফ, মেহেদি মিরাজ, নাঈম শেখ, বিজয়, সোহান, এবাদত, খালেদ, সৌম্যসহ প্রতিশ্রুতিশীল তারুণ্যের প্রতীকদের ডাকা হোক। অমুকের তমুক খেলোয়াড় পছন্দ, তাকে দলে রাখতে হবে- এই মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। কোচদের উপর পুরো দায়িত্ব দিতে হবে। তাঁরাই সবকিছু নির্ধারণ করবেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা আর কত? সময় আর নেই। টেস্ট খেলুড়ে সব দেশকে আমরা হারিয়েছি। একজন মনোবিদ প্রয়োজন। ‘ব্যর্থতা সাফল্যের চাবিকাঠি’, ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’ – এসব এখন পুরোনো কাসুন্দি। যুদ্ধ ক্ষেত্রের মতো ‘হয় সামনে যাও নইলে মরে যাও’ – এই নীতি আঁকড়ে ধরে দলের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। ক্রিকেট হচ্ছে পুরোপুরি অনিশ্চয়তার খেলা। ভাষাগত সমস্যা খুবই প্রকট। বিদেশি কোচদের কথা অনেকেই বোঝে না। দোভাষী থাকতে হবে। দেশি কোচদের দায়িত্ব দিলে উপকার বৈ অপকার হবে না। এক্ষেত্রে পাশের দেশ ভারতের উদাহরণ আনা যেতে পারে। রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ দক্ষতার সাথে দল পরিচালনা করছেন। ফুটবল ও ক্রিকেটের মতো আউটডোর বা ইনডোর গেমসে আমাদের অবস্থা শোচনীয়। হাডুডু এখন জাতীয় খেলা। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে!
সে তুলনায় গ্রামেগঞ্জে অনাদরে অবহেলায় থাকা কন্যাসম মেয়েরা সাফল্যের বিজয়কেতন উড়িয়েছে। জনাব গোলাম রব্বানী হেলালের নিবিড় তত্ত্বাবধানে ন্যূনতম সুযোগ সুবিধায় তাঁরা দেখিয়েছে দীপ্ত অঙ্গীকার। কী ফুটবল বা ক্রিকেট সবখানেই তাদের জয়জয়কার। অথচ তাদের কারো কারো ঘরে একটা টিভি পর্যন্ত নেই, দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত। তাদের বসতভিটা, খাওয়ার চাল ডাল নেই। বয়সভিত্তিক খেলায় প্রত্যেকটিতে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। ওয়াসফিয়া হিমালয় জয় করেছে। নারীরা সমাজের গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের অচলায়তন ভেঙে শিক্ষাদীক্ষা, চাকরি, প্রশাসনের শীর্ষ পদ অলংকৃত করেছে। সুতরাং তাদের প্রতি একটু যত্ন নেওয়া আমাদের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করি।
সব মিলিয়ে এটুকুই আশা করি যে আমাদের ক্রীড়াঙ্গন সক্রিয় হোক, চট্টগ্রাম ও বৃহত্তর চট্টগ্রামে খেলার জাগরণ ঘটুক। লেখক : সংস্কৃতিকর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধমেয়েদের নিরাপত্তা কোথায়
পরবর্তী নিবন্ধআমার দেশ আমার শহর