সংবাদপত্র জগতের পথিকৃৎ

মো: খোরশেদ আলম | রবিবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের সাংবাদিকতা জগতের পথিকৃৎ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার এর ৬০ তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আজকের এই দিনে ৬৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। চট্টগ্রামের প্রথম মুসলিম প্রকৌশলী, সম্পাদক, প্রকাশক দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এই মহান ব্যক্তি ১৮৯৬ সালে রাউজান সুলতানপুর গ্রামের এক সম্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বেলায়েত হোসেন ও মাতা ফজিলাতুন নেছা এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিলেন। নিজ গ্রাম থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন রাউজান আর আর সি ইনিস্টিটিউশন থেকে ১৯১২ সালে প্রবেশিকা এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯১৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর ১৯১৯ শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে স্বর্ণপদকসহ তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর নিজগ্রামে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। তড়িৎ প্রকৌশলী হয়ে কিছুকাল রেঙ্গুনে চাকরী করেন। চট্টগ্রামের ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানীতে তড়িৎ প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান এবং চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা চালু করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। পরে চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন।
ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ১৯২৯ সালে পুস্তক প্রকাশনা ও বিক্রির প্রতিষ্ঠান কোহিনুর লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামে প্রথম বিদ্যুৎ চালিত প্রেস কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস এবং ১৯৫০ সালে নিজের সম্পাদনায় কোহিনুর প্রেস থেকে একটি সাপ্তাহিক সাময়িকি প্রকাশ করেন। ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম থেকে দৈনিক সংবাদপত্র আজাদী সম্পাদনার মাধ্যমে ন্যায়নিষ্ঠা ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতায় অসমান্য অবদান রাখেন তিনি। এরপর অদ্যবধি পত্রিকাটি তার সুনাম অক্ষুণ্ন রেখে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও প্রগতিশীল ধারায় এর প্রচার ও প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছে। চট্টগ্রামে মুদ্রণ ও প্রকাশনায় থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। তাঁর প্রেস এবং প্রকাশনা সংস্থা থেকে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ এবং ড. এনামুল হকের যৌথ গ্রন্থ চট্টগ্রামী ভাষার রহস্যভেদ, আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য প্রকাশিত হলে চারিদিকে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও শতকত ওসমান, আবুল ফজল, সাদাত আলী আখন্দ, মাহবুব আলম চৌধুরী, সুচরিত চৌধুরী সহ বহু সাহিত্যিকের গ্রন্থ ছড়া ও বিভিন্ন পত্রিকা সাময়িক প্রকাশিত হয়।
বাঙালি সংস্কৃতি বিদ্বেষী পাকিস্তান সরকারের দমননীতি উপেক্ষা করে ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে মাহবুব আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম কবিতা কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি কোহিনূর প্রেস থেকেই গোপনে মুদ্রিত হয়। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার শিশুপাঠ ও শিশুতোষসহ বহু গ্রন্থের রচয়িতা। তাঁর মাঝে উল্লেখ্যযোগ্য গ্রন্থ হলো, শহীদের কারবালা হযরত হোসাইন (র:), হযরত ইমাম আবু হানিফা(র.), বার আউলিয়া, চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন, শেখই চাঁটগাম কাজেম আলী মাস্টারসহ বহু গ্রন্থ প্রকাশনা করেছেন।
মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার পাঁচ মেয়ে এক ছেলে সন্তান রেখে গেছেন। এ ছয়জনের মাঝে আজাদীর সম্পাদক এম.এ মালেক সবার ছোট। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের মৃত্যুর পর তার জামাতা বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা, সাবেক গণপরিষদ সদস্য স্বাধীনতা পদক (মরণোত্তর) প্রাপ্ত অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ পত্রিকাটির হাল ধরেন। তিনিও ইহজগত ত্যাগ করেছেন। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের যোগ্যতম উত্তরসূরি তার সন্তান এম.এ মালেক বর্তমানে আজাদীর সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। তাঁর বিচক্ষণ ও বলিষ্ঠ সম্পাদনায় আজাদীর জনপ্রিয়তা আরো বেশি বৃদ্ধি পাবে এবং ভবিষ্যতে এর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ও সফলতা আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যে তিনি ২১ শে পদক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তাকে নিয়ে আমরা চট্টগ্রামবাসী গর্ব করি। পিতার মত তাঁরও সুখ্যাতি সমগ্র দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। পত্রিকাটির ঐতিহ্য ও সুনাম ধরে রাখতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি। বর্তমান পত্রিকাটির অর্ধ লক্ষাধিক সার্কুলেশন রয়েছে বলে জানা যায়। অন্য পত্রিকার তুলনায় এর পাঠক চাহিদাও বেশি।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক সিডিএ এর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ সালাম আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের নাতনি জামাই। সাপ্তাহিক স্লোগান পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ জহির তার মেয়ের ঘরের নাতি। সম্পর্কে তিনি আমারও নানা হন। এই মহান ব্যক্তির শূন্যস্থান কখনো পূরণ হওয়ার নয়। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পশ্চিম ষোলশহর জামিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে তিনি ছিলেন একজন দ্বীনদার, ফহ্‌রেজগার ব্যক্তি। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার উপমহাদেশের অন্যতম সুফি সাধক হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ্‌ চিরকুটি (র.) এর প্রধান খলিফা ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বহু সামাজিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। চট্টগ্রামের মানুষের চেতনার বাতিঘর ছিলেন তিনি। তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে চট্টগ্রামে ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা আন্দরকিল্লা মোড়টি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এর উদ্যোগে আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার চত্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে তাঁর নামে মিলনায়তন করার পাশাপাশি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের নামে শিক্ষা বৃত্তি চালু করা হয়েছে। ৬০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমি এই মহান ব্যক্তিত্বের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। দোয়া করি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে যেন জান্নাতবাসী করেন। আমীন।
লেখক : শ্রম বিষয়ক সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅভিনন্দন
পরবর্তী নিবন্ধআজাদীর মাধ্যমে চট্টগ্রামবাসীর অন্তরে জাগরুক থাকবেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব