আজাদীর মাধ্যমে চট্টগ্রামবাসীর অন্তরে জাগরুক থাকবেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব

এম. নাসিরুল হক | রবিবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ


ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত অনেকগুলো কাজে চট্টগ্রাম অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে- তা নিঃসন্দেহে বলা যেমন চলে, তেমনি এর জন্য গৌরববোধ করার অধিকারও রাখে চট্টগ্রাম তথা চট্টগ্রামবাসী।
বাংলাদেশের প্রান্তবর্তী জনপদ চট্টগ্রাম-প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপম আধার। যুগে যুগে এর বন্দনা করে গেছেন কবিরা। বলেছেন, শৈল-কিরীটিনী, নদী মালিনী, বনানী-কুন্তলা। প্রকৃতি যেন অকৃপণ হাতে ঢেলে দিয়েছে তার সকল সৌন্দর্য। ইংরেজদের কাছে চট্টগ্রাম ছিল প্রাচ্যের রানী।
এ ভূখণ্ডের অবস্থান যেমন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, তেমনি সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম-ভাষা, সাহিত্য এক কথায় মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে এখানকার জনগোষ্ঠীর কর্মকৃতি স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত, স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে অনেকগুলো ঘটনার মর্মমূলে যে চট্টগ্রাম তার বিস্তারিত বিবরণ না দিয়েও বলা যায়, মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে মাহবুবউল আলম চৌধুরীর একুশের উপর প্রথম কবিতা প্রকাশ, পাকিস্তানোত্তর চট্টগ্রামে হরিখোলার মাঠে সংস্কৃতি সম্মেলন, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ৬৬ তে ছয় দফা ঘোষণা, ৭১ এ স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বৈরাচারী সরকার উৎখাতে ২৪শে জানুয়ারিতে ৩৭ জনের রক্তদান সবই চট্টগ্রামবাসীর অহংকার করার বিষয় হিসেবে জাতীয়ভাবে স্বীকৃত।
এমন কোনো বিষয় নেই, আন্দোলন নেই যেখানে চট্টগ্রামবাসী ভূমিকা রাখেনি। তেমনি অনেকগুলো ক্ষেত্রের মধ্যে একটি হচ্ছে সংবাদপত্র শিল্প। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য সম্পর্কে প্রজন্মকে সচেতন করা, জাতীয় জীবনে চট্টগ্রামের গুরুত্বকে তুলে ধরা, সর্বোপরি, চট্টগ্রামের আপামর জনগোষ্ঠীর সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, বঞ্চনার কথা তুলে ধরার জন্য যে ব্যক্তিটি আজ থেকে ৬৩ বছর আগে চট্টগ্রামে দৈনিক আজাদী নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন, তিনি হচ্ছেন মরহুম আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার। অনাড়ম্বর আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর পালিত হচ্ছে তাঁর ৬০ তম মৃত্যুবার্ষিকী।
সংবাদপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য গৌরবময় ও প্রাচীন। কলকাতার বাইরে গোটা বাংলা ভাষাভাষী-অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে মুদ্রিত ও প্রকাশিত প্রথম দৈনিক পত্রিকা (জ্যোতি-১৯২১ খ্রিস্টাব্দ) হিমালয়ান উপমহাদেশে মহিলা সম্পাদিত প্রথম দৈনিক পত্রিকা সরহদ ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ) তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা ও বিনোদন পত্রিকার (উদয়ন-১৯৫০ সালে) প্রকাশনা ঘটে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম যে দৈনিকটি প্রকাশিত হয় তা হচ্ছে ‘জ্যোতি’-প্রথম প্রকাশ ৫-৮-১৯২১ ইং। এর সম্পাদক ছিলেন কালী শংকর চক্রবর্তী। এরপর অম্বিকা চরণ দাশ এর সম্পাদনায় দৈনিক হিসেবে ‘পাঞ্চজন্য’ প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালের অক্টোবর মাসে যা আগে সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হত। এরপরে সংবাদপত্রের ইতিহাস বিরাট।
উত্তর চট্টগ্রামের প্রথম ডিগ্রিধারী ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ১৯৫০ সালে ‘কোহিনূর’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এরপর তিনি ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ‘দৈনিক আজাদী’ প্রকাশ করেন। কোন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নয়, সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে আধুনিক প্রগতিশীল একটি সমাজ গঠনের মনোভাব নিয়ে যে কাজটি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব শুরু করেছিলেন আজো সেটি অব্যাহত রয়েছে। দৈনিক আজাদী বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দ, শিক্ষা বিস্তার, চট্টগ্রামের সমস্যা ও সম্ভাবনা তুলে ধরার প্রত্যয় নিয়ে যে যাত্রা শুরু করেছিল আজো অব্যাহত থাকায় এ পত্রিকাটি চট্টগ্রামবাসীর স্নেহধন্য হয়ে ৬২ টি বছর পূর্ণ করেছে। মরহুম আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের (১৯৬২) মৃত্যুর পর থেকে তাঁর জামাতা অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের নেতৃত্বে এটি দীর্ঘদিন পরিচালিত হয়। কালের প্রয়োজনে এই পত্রিকার আঙ্গিক, কলেবর, রং এর পরিবর্তন ঘটলেও পত্রিকাটির চারিত্রিক গুণাবলীর পরিবর্তন ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না। এই পত্রিকাটি কোন দিন ঢাকার পত্রিকার সাথে প্রতিযোগিতায় যাবার চেষ্টা করেনি, বরং দিন দিন চট্টগ্রাম শহর ও এর আশেপাশের উপজেলা ও কক্সবাজার এবং পার্বত্য জেলাগুলোকে সংবাদপত্রে তুলে আনার চেষ্টা করেছে এবং সার্থকও হয়েছে। দীর্ঘ ৬৩ বছর এই পত্রিকাটি সাংবাদিক তৈরির কারখানা হিসেবে কাজ করেছে। আজকে যারা জাতীয় এবং স্থানীয় পত্রিকায় ভাল সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত, তাদের অনেকের হাতেখড়ি এই আজাদীতে। সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী সৃষ্টির ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। জাতীয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত অনেকেই তাদের জীবনের প্রথম লেখাটি ছাপার অক্ষরে দেখেছেন দৈনিক আজাদীতে। দৈনিক আজাদীর ‘আগামীদের আসর’ শিশু-কিশোরদের জন্য একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় পাতা ছিল। চট্টগ্রামের সমস্যাকে চিহ্নিত করে এর জন্য প্রয়োজনীয় আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা আজো ভাস্কর। শ্রমজীবী মানুষের কথা তুলে ধরা তথা শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েম, অসামপ্রদায়িক চেতনায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা, জনগণের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি তথা সর্বোপরি দেশ ও জনগণের প্রতি সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে চেতনাবোধ জাগ্রত করার ক্ষেত্রেও দৈনিক আজাদী আজো কাজ করে যাচ্ছে। প্রত্যেক ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তথা সকল ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহ্যমণ্ডিত দিনগুলির ব্যাপারে একইভাবে গুরুত্ব দিয়ে দৈনিক আজাদী সকল ধর্মের মানুষের সম্মান অর্জনেও সক্ষম হয়েছে বলে আমার মনে হয়। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের পর ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের একমাত্র পুত্র এম এ মালেকের সম্পাদনায় দৈনিক আজাদী সফলভাবে তার প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছে। আমরা চাই দৈনিক আজাদী দীর্ঘজীবী হোক, যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার চট্টগ্রামবাসীর হৃদয়ে চির জাগরুক হয়ে থাকবেন। আমি তার মাগফেরাত কামনা করি ।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধসংবাদপত্র জগতের পথিকৃৎ
পরবর্তী নিবন্ধইঞ্জিনিয়ার আলহাজ্ব মোহাম্মদ আবদুল খালেক