একটি আড্ডা হচ্ছে। আড্ডার বিষয়বস্তু সংগীত নিয়ে। তা–ও আবার রাহুল দেব বর্মনের সংগীতের উপর। হিন্দি সিনেমা জগতে সর্বকালের অন্যতম ব্লকব্লাষ্টার হিট সিনেমা “শোলে।” এই সিনেমার একটি উত্তেজনাকর দৃশ্যের মিউজিকে তবলার ব্যবহার করেছিলেন রাহুল দেব বর্মন। আলোচনাটা মূলত এই দৃশ্যে তবলার ব্যবহার ও সাহসিকতা নিয়ে। “শোলে” মুক্তি পায় ১৯৭৫ সালে। ঐ সময়ে এমন তবলার নান্দনিক ব্যবহার রীতিমতো বিস্ময়কর। যা হোক, এই নিয়েই আড্ডায় আলাপচারিতায় মশগুল বাংলাদেশের সংগীত ভুবনের তিন বরপুত্র। এঁরা হলেন গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী, সুরকার ও গায়ক নকীব খান, গায়ক ও সুরকার কুমার বিশ্বজিৎ। “নকীব রিদমের উপর রাহুলের অসাধারণ দখলের কথা উল্লেখ করে বললেন: একমাত্র রাহুলই তাল নিয়ে নিত্যনতুন এক্সপেরিমেন্ট করেছেন।” (পৃ: ৮০)
এরই সূত্র ধরে কুমার বিশ্বজিৎ বললেন, “আর ডি বর্মন এশিয়াতে এই ধরনের কাজ প্রথম করেছেন। তুলনাহীন পাকশনিষ্ট ছিলেন। একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব এই ধরনের কাজ করা।” বিশ্বজিৎ অনলাইনে যুক্ত করলেন কলকাতার মিউজিশিয়ান রকেট মন্ডলকে। যিনি রাহুলের সঙ্গে কাজ করেছেন। এই বিষয়ে তিনি একটি শব্দই উচ্চারণ করলেন– ‘ঐশ্বরিক’। জানালেন, তবলা বাজিয়েছিলেন সমতা প্রসাদ। (পৃ: ৮১) আড্ডা থেকেই জানা গেল: “শোলে” সিনেমায় নায়ক বীরু ও নায়িকা বাসন্তীকে নিয়ে ছুটে চলা ঘোড়াকে ভিলেন গব্বর সিং–এর ডাকাত দলের সদস্যদের ধাওয়া করার উত্তেজনাকর দৃশ্যে মিউজিকে তবলার ব্যবহার করে রীতিমতো চমকে দিলেন আর ডি বর্মন। একটি আড্ডা থেকে কতকিছু হয়, এটি তার প্রমাণ। কুমার বিশ্বজিতের সেই সময়ে অনলাইনে যুক্ত করা রকেট মন্ডলকে এবং তবলাবাদক সমতা প্রসাদের নামটি জানানো– সবই কিন্তু এগিয়েছে সংগীতের পিতা–পুত্রের অবদানের কথা ও তাঁদের কীর্তি নিয়ে। এভাবেই একটি বই লেখার রসদ পেয়ে যান শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। ভাবনায় ছিল বটে। গাঁথুনি গড়তে তাঁকে রসদ যোগাতে হয়েছে অনেক বই–পুস্তক ও সাক্ষাৎকার পড়ে। গান শুনে। সর্বোপরি এইরকম আড্ডার আলোচনা। এবং পরবর্তীতে রচিত হয়েছে একটি বই। নাম “সংগীতে পিতা–পুত্র।” শচীন দেব বর্মন–রাহুল দেব বর্মন।
উপমহাদেশের সংগীত ভুবনে শচীন দেব বর্মন এবং রাহুল দেব বর্মন– এই নাম দুইটি যেমন বিস্ময়কর, তেমনি সংগীতপ্রেমীদের কাছে তাঁরা দুইজনই পরম শ্রদ্ধার। আলোচ্য এই বইটির দুইটি পর্ব। প্রথম পর্বে শচীন কর্তা এবং দ্বিতীয় পর্বে রাহুল দেব বর্মন সর্ম্পকে ঘটনাবহুল চমকপ্রদ তথ্য।
শচীন কর্তার জন্ম কুমিল্লায়। ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা পিতা নবদ্বীপ চন্দ্র বর্মন ছিলেন সেতারবাদক। ছবি আঁকা ও ভাস্কর্যে দক্ষ ছিলেন। সুতরাং, এমন বাবার সংগীত ও শিল্প সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ, পুত্রের মধ্যেও প্রভাব পড়ে। সবচেয়ে বড় বিষয় শচীন কর্তার জন্য দেখাশোনা ও তদারকির দায়িত্বে থাকা আনোয়ার ও মাধব এই দুইজনের মুখে গান শুনে শচীন কর্তাও তাদের গান গাইতেন। আবার বাবা নবদ্বীপ চন্দ্র বর্মনের কম্পোজে গান গেয়ে শচীন কর্তা প্রশংসিত হয়েছিলেন। তখন মাত্র পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। বলা যায়, বাল্যকাল থেকেই সংগীতের প্রতি অনুরাগ–মোহ শচীন কর্তার মধ্যে কাজ করেছে।
“১৯২০ সাল–এ শচীন কর্তা মেট্রিকিউলেশন পাশ করেন। তিনি পরবর্তী পড়াশোনার জন্য কলকাতা যেতে চাইলেও পিতা নবদ্বীপের ইচ্ছায় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেই সময়ে তিনি পড়াশোনার জন্য অল্পই সময় দিতেন। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে বেড়াতেন। নদীতে সময় কাটাতেন। লোকগান সংগ্রহ করতেন। বাসায় যখন থাকতেন তখনো বাঁশী হাতে তাঁকে দেখা যেতো দীঘি–র পাড়ে। মাধব বলতেন, “ছোট কর্তা যাবার সময় হয়েছে।” রাণীর দীঘিতে সন্ধ্যার ছায়া। কিন্তু ছোট কর্তার চেহারায় বা আচরণে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তিনি তখনো বাঁশীতে মগ্ন।” (পৃ. ২০) বাল্যকাল ও কৈশোরকালের এই ঘটনাগুলো থেকেই শচীন কর্তার গানের প্রতি একনিষ্ঠতার পরিচয় মেলে।
শচীন কর্তার বর্ণাঢ্য সংগীত জীবনের অনেক কিছুই জানা যায় এই বইয়ে। ১৯২৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিষয়ে মাস্টারস্–এ ভর্তি হন। মূলত এই সময়কাল থেকেই শচীন কর্তার আরেক জীবন শুরু হয়। শচীন কর্তা বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ কৃষ্ণ চন্দ্র দে–র শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কৃষ্ণ চন্দ্র তাঁর প্রিয় ছাত্রকে সর্বোত্তমটুকুই দিয়েছিলেন। তিনি বড় বড় মেহফিলে শচীন কর্তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। যার ফলে পরিচয়ের পরিধি বেড়েছিল (পৃ.২৩)
১৯২৮ সালে শচীন কর্তা মাত্র ২২ বছর বয়সে কলকাতা রেডিও–তে প্রথম গান করেন। রেডিও–তে গান গাওয়ার জন্য দশ টাকা পেয়েছিলেন। (পৃ.২৪)। কলকাতায় এভাবেই শুরু হলো শচীন কর্তার পেশাগত সংগীতজীবন। ১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হিন্দুস্তান রেকর্ডস থেকে প্রকাশিত হলো শচীন কর্তার প্রথম রেকর্ড। রেকর্ডের একদিকে ছিল “ডাকলেই কোকিল রোজ” এবং অন্যপাশে “এই পথেই আজ এসো প্রিয়।” শচীন কর্তার নিজের সুরে গাওয়া গান দুটো প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হিট। (পৃ.২৭)
শচীন কর্তা হিন্দি সিনেমা জগতেও দারুণভাবে সফল। দেব আনন্দ, চেতন আনন্দ, বিজয় আনন্দ ও গুরু দত্ত শচীন কর্তাকে যথেষ্ট উৎসাহ দিতেন। গান নিয়ে গবেষণা শচীন কর্তার মজ্জাগত। নানান ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। শচীন কর্তা মানতেন, হিন্দি ছবিতে উচ্চাঙ্গ সুরে গান জনপ্রিয় করা সহজ নয়। এটা জেনেও তিনি ১৯৫১ সালে শহীদ লতিফ পরিচালিত “বুজদিল” ছবিতে “ঝন ঝন ঝন ঝন পায়েল বাজে” গানটি যুক্ত করেন। এই গানটি নটবেহাগ রাগের ওপর আগ্রা ঘরানার। গান জনপ্রিয় হয়। (পৃ. ৭৩)
হিন্দি সিনেমার পাশাপাশি বাংলা সিনেমায় সংগীত পরিচালনা করেছেন। শচীন কর্তা বাংলা ও হিন্দি সিনেমা জগতে একজন দামী ও গুণী সংগীত পরিচালক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কিশোর কুমার, মান্না দে, গীতা দত্ত– এই চারজন শিল্পীর সারা ভারতে পরিচিতি শচীন কর্তার হাত ধরে।(পৃ.৭৫)
শচীন কর্তার সংগীত জীবনে মীরা দেব বর্মনের ভূমিকার কথা বলতেই হয়। ১৯৩৮ সালে ১০ ফেব্রুয়ারি তারিখে তাঁদের বিয়ে হয়। মীরা দেব বর্মনের লেখা বেশ কিছু গান কালোত্তীর্ণ হয়ে আছে।
এবার আসা যাক, শচীন–মীরা দেব বর্মনের পুত্র রাহুল দেব বর্মন প্রসঙ্গে। শেষ পর্যন্ত যখন সিদ্ধান্ত হলো যে, রাহুল সংগীতে কাজ করবেন–তখন শচীন কর্তা রাহুলকে পরামর্শ দিলেন, প্রতিদিন একাধিক সুর সৃষ্টির জন্য। কম্পোজার হতে হলে রিদম সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান থাকার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে রাহুলকে জানালেন। এবং তবলা শিক্ষার জন্য ব্রজেনকে মনোনীত করলেন। ব্রজেন যে সাধারণ গুরু নন এবং ব্রজেনের কাছে শিখলে, তবলা শিক্ষার গুরুত্ব রাহুল নিজেই বুঝতে পারবে, একথাও শচীন কর্তা বললেন। (পৃ. ৮৩/৮৪) বাবার এই পরামর্শ রাহুলের জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। সুর নিয়ে যেমন এক্সপেরিমেন্ট করেছেন, তেমনি তাল–লয় ব্যবহারে সাহসী করে তুলেছে। যেমন, উদাহরণ হিসেবে সেই “শোলে” সিনেমার কথা উল্লেখ করতে হয়। কী মুন্সিয়ানার সাথে তবলার ব্যবহার করে চমকে দিলেন রাহল।
সেই দিনের তিনজনের আড্ডায় এই বিষয়টিও উঠে এলো। কুমার বিশ্বজিৎ জানালেন: আর ডি বর্মন পানি ভর্তি হাঁড়ির উপর পশুর রগ টান টান করে বেঁধে তার থেকে সাউণ্ড বের করে আনেন। এই সাউণ্ড ব্যবহার করা হয়েছে “শোলে” সিনেমায় ভিলেনের প্রবেশের সাথে সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে স্বল্প দৈর্ঘ্যের একটানা সাউণ্ড ব্যবহার করা হয়েছে। (পৃ.৯৪)
আরও চমকপ্রদ তথ্য। রাহুল দেব বর্মন “প্যাডেল মটকা” আবিষ্কার করেন। হাঁড়ির উপর চামড়া লাগিয়ে, প্যাডেল দিয়ে বাজানো হয়। নরেন্দ্র বেদি পরিচালনায় “জাওয়ানি–দিওয়ানি” সিনেমার সংগীত পরিচালক ছিলেন রাহুল দেব বর্মন। আনন্দ বকশির লেখা “সামনে ইয়ে কোন আয়া” – গানে প্রথম এই “প্যাডেল মটকা” ব্যবহার করা হয়। (পৃ.৯৫)
রাহুলের অসাধারণ সৃষ্টি সংগীতের ভুবনে নতুনত্ব এনেছে। শ্রোতারাও আনন্দ ও মুগ্ধতার সঙ্গে এই ব্যতিক্রমী মিউজিক গ্রহণ করেছেন। রাহুলের প্রতিটি গানেই ব্যতিক্রমী প্রতিভার ছোঁয়া, সুরের বৈচিত্র্য থাকবেই। সুরের ভিন্নতার কারণে সৃষ্ট গান শ্রোতার কাছে কখনো একঘেয়ে মনে হয় না। প্রতিটি গানই যেন আলাদা।
সংগীতের ভুবনে পিতা–পুত্রের এমন সুন্দর অবদান নিঃসন্দেহে গৌরবের। আনন্দের। সবচেয়ে বড় ভালোলাগার বিষয় আমরা তাঁদের গান শুনেছি। এখনও শুনছি। আমরা যারা শচীন কর্তা এবং রাহুলের ভক্ত আছি, তাদের জন্য এই বইটি অনেক কৌতূহল মেটাবে। জানার পরিধি বাড়াবে।
শহীদ মাহমুদ জঙ্গী বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান গীতিকবি। তাঁরও গানের জগতে বিচরণ দীর্ঘদিনের। ফলে তাঁর গবেষণালব্ধ এই বইটি সংগীতপ্রেমীদের জন্য বিশাল পাওয়া। “সংগীতে পিতা–পুত্র” বইটি সংগীতানুরাগী ও সংগীত বিষয়ে পড়ুয়াদের কাজে আসবে বলে আশাবাদী।