শুদ্ধাচার সমন্বিত প্রযুক্তি নির্ভর মানবসম্পদ

নাসের রহমান | সোমবার , ৩০ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

ধৈর্য ও সহনশীলতা না থাকলে অনেক মেধা সম্পন্ন মানুষও বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারে না। কিছু কিছু মানুষ আছে কোন কিছুই তাদের নাড়া দেয় না। অনেক কিছু ঘটে গেলেও তারা তাদের মতো করে চলে। কিছুতেই মাথা ঘামায় না। অনেকটা না শোনার মতো হয়ে থাকে। কেউ শোনাতে চাইলেও কানে নেয় না। সমাজে এরকম মানুষের সংখ্যা কম না, হিসাব করলে অনেক পাওয়া যাবে। এসব মানুষ কোনো সমস্যা তৈরি করে না। এদের নিয়ে কোনো অসুবিধাও হয় না। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ স্থির থাকতে পারে না। অল্প কিছু হলে অস্থির হয়ে উঠে। এদের সহজে থামানো যায় না। কোনো বিষয়ে কতটুকু কথা বলা প্রয়োজন তা বুঝতে পারে না। অপ্রয়োজনীয় প্রসঙ্গ নিয়ে মেতে থাকে। কখনো কখনো সমস্যা তৈরি করে ফেলে।

বর্তমানে এমন লোকের সংখ্যা একেবারে কম যারা স্কুলে বা মাদ্রাসায় যায়নি। প্রাথমিক স্তরে হলেও কোনো না কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়েছে। রিক্সা চালক, ভ্যান চালক থেকে শুরু করে দিন মজুর, শ্রমিক কৃষক সবাই স্কুলের দারস্থ হয়েছে। অনেকে হাই স্কুলেও পড়েছে। কেউ কেউ এসএসসি পাস করেছে। এ শিক্ষা তাদেরকে অক্ষরজ্ঞান দিয়েছে কিন্তু অন্য দিকগুলো উম্মোচিত করতে পারেনি। শুধু এসব শ্রমজীবীরা নয় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পাস করাও অনেকের কাছে শিক্ষার প্রকৃত আলো পৌঁছেনি। সবদিক সমন্বয় করে মানুষ হয়ে গড়ে উঠার যে শিক্ষা তা থেকে দূরে থেকে গিয়েছে। যে কারণে অতি তুচ্ছ বিষয় বা সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক বড় কিছু হয়ে যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত ঘটনা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। যার মীমাংসা সহজে হয় না। জের অনেক দিন ধরে চলে। এসব কিছু যে শুধু সুশিক্ষার অভাবে হয় তা নয়। আসলে সবার মাঝে ধৈর্য ও সহনশীলতার অভাব রয়েছে। কোনো কিছুকে ধৈর্যসহকারে বিবেক বিবেচনা দিয়ে ভেবে দেখা হয় না। হুজুগে মেতে উঠতে চায় সবাই।

শিষ্টাচারের আধুনিক সংস্করণ হলো শুদ্ধাচার। শিষ্টাচারের মধ্য দিয়ে মানুষ শুদ্ধাচারের দিকে এগিয়ে যায়। শুদ্ধাচারের ব্যাপকতা এখন সর্বত্র। অফিস আদালত সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধাচারের পরিপালন অপরিহার্য করা হয়েছে। ব্যাংক বীমা থেকে শুরু করে অন্যান্য সকল কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধাচার পরিপালন নিয়ে প্রশিক্ষণের শেষ নেই। বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা সমূহ শুদ্ধাচারের উপর সেমিনার সেম্পোজিয়ামের আয়োজন করে থাকে। যে কোনো প্রতিষ্ঠানের অফিসার কর্মচারী থেকে শুরু করে সকল অ্যামপ্লয়ীকে শুদ্ধাচারের আওতায় আনতে হয়। শুদ্ধাচার নিয়ে জাতীয় নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। কতগুলো বিষয়কে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতি অর্জনের মধ্যে দিয়ে শুদ্ধাচারের মান নির্ণয় করা হয়। আপাতত দৃষ্টিতে শুদ্ধাচার বলতে নিজেকে শুদ্ধ বা বিশুদ্ধ করে তোলা, আচরণ শুদ্ধ করা বা দুর্নীতি মুক্ত রাখা মনে হয়। আসলে শুদ্ধাচার ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত একটি সমন্বিত পদ্ধতি। যার মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সামগ্রিক চিত্র ফুটে উঠে। একই সাথে অগ্রগতির সূচক নির্ণয় করে।

কর্মক্ষেত্রের সর্বত্র শুদ্ধাচার পরিপালনের প্রচেষ্টা থাকলেও কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে এ ব্যাপারে সচেতনতার অভাব দেখা যায়। শুদ্ধাচারের শর্তাবলী যথাযথভাবে পরিপালন করতে পারলে কোনো প্রতিষ্ঠানে অসংগতি থাকবে না। সমন্বয়হীনতার অভাব থাকবে না। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় যে সমস্যা, কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে সমন্বয়হীনতা। যার ফলে অনেক বড় বড় প্রকল্পও সময়মত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। দীর্ঘ সূত্রতার ফাঁদে পড়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও অমীমাংসিত থেকে যায়। অনেক ক্ষেত্রে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। শুধু প্রকল্প বাস্তবায়ন নয় অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বিলম্ব হয়।

মানুষকে সম্পদে পরিণত করে তার কর্মক্ষেত্র। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করলেও মানুষকে কর্ম উপযোগী করে তোলে তার কর্মক্ষেত্র। এখনে বিভিন্ন মুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়। হাতে কলমে কাজ শিখতে না পারলে কর্ম ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে পারে না। শিক্ষা লাভের পর যে কোনো মানুষ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করলে তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। যে লোক যে কাজটি করবে তা আগে বুঝতে হয়, ভাল করে জানতে হয়। শিক্ষিত হলেও প্রশিক্ষণ ছাড়া লোকেরা কাজ করতে পারে না। এক এক কাজের ধরন একেক রকম, কাজের প্রশিক্ষণও আলাদা। এজন্য কর্মক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের গুরুত্ব অনেক। দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলতে হলে প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। জনবলকে দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করতে পারলে কর্মক্ষেত্রে অনেক সুফল পাওয়া যায়।

নৈতিকতা বলে যে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা যেন উপেক্ষিত থেকে গিয়েছে। একজন ব্যক্তির ছোটবেলা থেকে শুরু করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে নৈতিকতার প্রয়োজন। এখন নৈতিকতা নিয়ে ভাবার সময় অনেকের নেই। একসময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এর উপর অনেক গুরুত্ব প্রদান করা হতো। নৈতিকতাকে ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়। শুধু ধর্মের সাথে নয় সব ক্ষেত্রে নৈতিকতার প্রয়োজন। অনেক মানুষ আছে যারা ধর্মীয় অনুশাসন সেভাবে অনুসরণ করে না। কিন্তু নৈতিকতার প্রশ্নে কোনো রকম ছাড় দেয় না। সব ক্ষেত্রে নৈতিকতাকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরে। এদেরকে সহজে কেউ টলাতে পারে না। নৈতিকতাকে ভিত্তি করে তারা দিন যাপন করে। বিভিন্ন রকম বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হয়। তারপরও নৈতিকতা বিসর্জন দেয় না। নৈতিকতাহীন মানুষেরা অনেক সময় বিবেক বর্জিত হয়ে পড়ে। নানা রকম অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়, অপকর্মের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। সততার সাথে নৈতিকতার সম্পর্ক নিবিড়। সৎ মানুষেরা কখনো অনৈতিক কাজ করতে পারে না। সবসময় বিবেক দিয়ে পরিচালিত হয়। সহজে ভাল মন্দের পার্থক্য করতে পারে। মন্দ কাজ পরিহার করে ভাল কাজে সহয়তা করে।

বর্তমান সময়ে তথ্য প্রযুক্তির জ্ঞান না থাকলে কোন কাজ করা যায় না। প্রত্যেক কাজই এখন তথ্য প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত। সব কাজই কম্পিউটার নির্ভর। তরুণদের জন্য এটা খুব সহজ। অতি দ্রুত তারা তথ্য প্রযুক্তির সাথে যুক্ত হতে পারে। কিন্তু যাদের বয়স চল্লিশ বা পঞ্চাশ উর্ধ্ব তাদের আয়ত্ত করতে সময় লেগে যায়। তারপরও অফিস আদালতে বা অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে কম্পিউটারে কাজ করতে পারে না এমন লোক নেই বললে চলে। যারা কম্পিউটার জানে না তারা এখন আর অফিসে কাজ করতে পারে না। যে কোনো প্রতিষ্ঠানে লোকবল নিয়োগের সময় তথ্য প্রযুক্তির জ্ঞান বা প্রশিক্ষণ আছে কিনা যাচাই করা হয়। কিন্তু তাদের মাঝে নৈতিকতা বা মানবিকতা এসব গুণাবলী আছে কিনা তা দেখা হয় না। যে কারণে এসব মূল্যবোধের উপর এখন কেউ আর তেমন গুরুত্ব দিতে চায় না।

মানবিক মূল্যবোধগুলো এখন আগের মত মানুষের মাঝে দেখা যায় না। যদিওবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক প্রচার অনেক হয়ে থাকে। ব্যক্তির যে মানবিক গুণাবলী তার অভাব দেখা যায়। মানুষ নি:সন্দেহে মানবিক গুণাবলীর অধিকারী। কিন্তু এ গুণ আরেক জনের কাজে আসতে হয়। পরিবারের কাছে, সমাজের কাছে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে মানবিক গুণাবলীর বহি:প্রকাশ ঘটাতে হয়। অসহায়, দুস্থ, আর্তপীড়িত ও দুর্গতদের মানবিক সহায়তা প্রদান করতে হয়। মানবিকতার ক্ষেত্র অনেক বড় ও ব্যাপক। আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসা, বিপদে আপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো মানবিকতার অংশ। বিপন্ন মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করা, গরীব নিঃস্বদের আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা করা মানবিকতার পরিচয় বহন করে। যে কোনো মানুষকে মানবিক হতে হয়। মানবিকতা না থাকলে মানুষ হিসেবে গণ্য হওয়ার কথা নয়। এজন্য ছোটবেলা থেকে অন্যসব শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিকতা ও মানবিকতার শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতুমি শুধু একবার এসো মা
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজার রেলপথ, বঙ্গবন্ধু টানেল পর্যটনের সম্ভাবনা ও কালুরঘাট সেতু