শীর্ষ সন্ত্রাসী বিধান বড়ুয়ার ছয় মাসের জামিন, মুক্তি পাচ্ছে আজ

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:১৭ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী এনডিপির দুর্ধর্ষ ক্যাডার দুই ডজন মামলার আসামি বিধান বড়ুয়া লক্ষ্মীপুর কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার তাকে দুটি মামলায় ছয় মাসের জামিন দেওয়া হয়েছে। আজ রোববার লক্ষ্মীপুর কারাগার থেকে মুক্তি পাবে বলে আজাদীকে নিশ্চিত করেন রাউজান থানার ওসি আবদুল্লাহ আল হারুন। এ দিকে বিধান বড়ুয়ার জামিনের খবর ছড়িয়ে পড়লে রাউজান এলাকার শান্তিপ্রিয় মানুষের মাঝে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দেখা গেছে।
কারণ এমন একটা সময় ছিল, যখন বিধান বড়ুয়ার কথা বলে রাউজানে শিশুদের ঘুম পাড়ানো হতো। তাই তার ফিরে আসার খবরে আবারো অপরাধ বেড়ে যাবে বলে মনে করছে সাধারণ মানুষ। বিধান বড়ুয়ার নামে খুন, অস্ত্র, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে দুই ডজনের বেশি মামলা রয়েছে। বার বার গ্রেপ্তার হলেও আইনে ফাঁকফোকরে জামিনে বেরিয়ে এসে বার বার অপরাধ সংঘটিত করেছে।
কে এই বিধান : পূর্ব গুজরা আঁধারমানিক বড়ুয়া পাড়ায় মৃত হিমাংশু বড়ুয়ার তিন ছেলের মধ্যে ছোট বিধান। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়া হয়নি তার। ছাত্র জীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতো বলে জানিয়েছেন তার আত্মীয় বাদেলেন্দু বড়ুয়া। পরবর্তীতে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয়। এরপর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি) প্রতিষ্ঠা করলে তার আশীর্বাদ পেতে মরিয়া বিধান যোগ দেয় এনডিপিতে। সা-কা চৌধুরীর ছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠে বিধান। রাউজানই শুধু নয়; চট্টগ্রাম জুড়েই আধিপত্য বিস্তারের নেশায় মেতে উঠে বিধান। রাজনৈতিক ভাবে তার প্রয়োজন বুঝাতে এবং নেতাকে খুশি রাখতে নিজের নামে গঠন করে বাহিনী, যেটি আজো বিধান বাহিনী নামে পরিচিত। মূল পেশা ছিল জোরপূর্বক চাঁদা আদায়। দাবিকৃত টাকা না পেলে ভয়ংকর হয়ে উঠতো বিধান। ওয়ান ইলেভেনের সময় পাড়ি জমায় দুবাই। সেখান থেকে কাতারে কাটায় ছয় বছর। পাসপোর্ট ও ভিসায় তার নাম ছিল ইউসুফ আলী। সেখানে সী-ট্র্যাক নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতো। রাউজানের অপর দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ফজল হকের আশ্রয়ে নিরাপদেই ছিল প্রবাসজীবনে। কয়েক বছর পর দেশে ফিরে ঢাকায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু তার রাজনৈতিক গডফাদার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ধরা পড়ার পর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে বিধান। পুনরায় দুবাই চলে যাওয়ার চেষ্টায় ছিল, কিন্তু তার আগেই র‌্যাবের হাতে নাইন এম এম পিস্তলসহ ধরা পড়ে। যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে সাকা চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলে বিধানের মাথা থেকে ছায়া সরে যায়।
গুরু মারা শিষ্য বিধান: ছাত্রজীবনে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আকতার হোসেন রাজুর মাধ্যমে ছাত্রলীগে যোগ দেয় বিধান। স্থানীয়রা জানায়, সন্ত্রাসী হিসাবে উত্থানের আগে বিধানের সাথে আকতার হোসেন রাজুর বেশ সখ্যতা ছিল। রাজনৈতিক গুরু আকতার হোসেন রাজু চেয়ারম্যান হিসাবে নির্বাচিত হলে বিধান বড়ুয়ার বিরুদ্ধে স্থানীয়রা এলাকার একটি চুরির সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনে। এ সময় অভিযোগের সত্যতা পেয়ে চেয়ারম্যান বিধানকে শাস্তি দেন। এই ঘটনার পর থেকে বিধান বড়ুয়া চেয়ারম্যানের সাথে সর্ম্পক ছিন্ন করে।
যোগ দেয় জাতীয় পার্টিতে। পরে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করে যোগ দেয় এনডিপিতে। ৯৩ সালে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে ঢুকে নির্মম ভাবে হত্যা করে এলাকার জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ও তার এক সময়ের রাজনৈতিক গুরু আকতার হোসেন রাজুকে। তখন থেকেই গুরু মারা শিষ্য হিসেবে তার পরিচিতি গড়ে উঠে। এরপর একে একে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে থাকে এই দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। অপর দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ফজল হকের সাথে হাত করে খুন করে ছাত্রলীগ নেতা ইকবাল ও কর্মী জামিল মোহরম আলীকে, চাঁদা না দেয়ায় ধনা বৈদ্যকে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসাজনিত কারণে নাছিম ও মিয়াকে, একই কারণে বিয়ে বাড়িতে ঢুকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে ছাত্রলীগ নেতা লিটন ও সোহেলকে, চাঁদা না দেয়ায় বাড়িতে ঢুকে হত্যা করে প্রতিবন্ধী স্কুল মাস্টার গাওস আলমকে, একই কারণে হত্যা করে কৃষ্ণ দত্ত ও ইউছুফ মিয়াকে। এ ছাড়া আরো বহু হত্যাকাণ্ডে তার জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে পুলিশের কাছে।
বিদেশেও থেমে ছিল না চাঁদাবাজি : বিধান বড়ুয়া বিদেশে পলাতক অবস্থায়ও তার সহযোগীদের দিয়ে ঠিকই চাঁদা আদায় করতো প্রবাসীদের থেকে। জানা গেছে, দুবাইয়ে ফজল হকের সাথে মিলে বিধান বড়ুয়া রাউজান প্রবাসীদের থেকে চাঁদা চেয়ে হুমকি দিতো। তাদের দাবিকৃত চাঁদা সেখানে আদায় করা হতো। কেউ যদি তাদের প্রস্তাবে রাজি না হতো তবে দেশে আসার পর তাদের সহযোগীদের মারফত ওই প্রবাসী ও তার পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর হুমকি দিয়ে খবর পাঠানো হতো। দাবিকৃত টাকার পরিমাণ সর্বনিম্ন পাঁচ লাখ থেকে বিশ লাখ টাকা পর্যন্ত।
আমাদের রাউজান প্রতিনিধি রাউজান থানার ওসি আবদুল্লাহ আল হারুনের বরাত দিয়ে জানান, রাউজান থানার মামলা নং ২(১০)১৪ এবং জিআর মামলা নং ১৬৯/১৪ অস্ত্র আইন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে (নম্বর ৫৯/১৫) বিধান বড়ুয়ার দশ বছর এবং সাত বছরের সাজা হয়েছিল। আদালত তাকে ছয় মাসের জামিন দিয়েছেন। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বিধান বড়ুয়াকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব)। এরপর ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর অস্ত্র আইনের একটি মামলায় বিধানের ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। ২০১৪ সালের ৪ অক্টোবর রাতে বিধান বড়ুয়ার বসতঘর থেকে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারের ঘটনায় রাউজান থানা পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করে। ২০১৬ সালের ২৩ নভেম্বর আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। গ্রেপ্তার-হাজতবাস আর জামিনে আসা যাওয়ার
ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের আলোচিত বিধান বড়ুয়া ২০২০ সালে একটি মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত শুনানি শেষে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। রাউজান থানার একটি অস্ত্র মামলায় বিধান বড়ুয়াকে ১৭ বছরের সাজা দিয়েছেন আদালত।
রাউজান থানা সূত্রে জানা যায়, বিধান বড়ুয়ার নামে রাউজান থানাসহ বিভিন্ন থানায় অন্তত দুই ডজন মামলা রয়েছে। ওই সব মামলায় বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগও করেছে। বার বার জামিন নিয়ে বের হয়ে আবারো অপরাধ কর্মে জড়ানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে তার মধ্যে। সর্বশেষ চট্টগ্রামের ভয়ঙ্কর এই সন্ত্রাসী গত ঈদুল ফিতরের দুইদিন আগে কুমিল্লা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিল। পরে আবারো গ্রেপ্তার হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা
পরবর্তী নিবন্ধনির্বাচিত হলে চট্টগ্রামের উন্নয়নে সাধ্যমতো চেষ্টা করব